Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্মার্ট ক্লাসরুম ও শিক্ষার উন্নয়ন

Icon

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার ও ড. মো. বিল্লাল হোসেন

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্মার্ট ক্লাসরুম ও শিক্ষার উন্নয়ন

উন্নত-অনুন্নত, ছোট-বড় সব দেশের সব মানুষের জন্য উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে সব মানুষকে দক্ষ করে গড়ে তুলে মানবসম্পদে পরিণত করার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান বিশ্ব। তবে এ ক্ষেত্রে অতিক্রম করতে হবে মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক সব বাধা ও সীমাবদ্ধতা। এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে নিয়ে, পিছিয়ে না থাকে যেন কেউ। ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে চলমান রয়েছে এসডিজি। প্রযুক্তির আরও উন্নয়নের নিরলস চেষ্টা চলছে। উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগাতে চলছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। বিশ্বব্যাপী এসব প্রচেষ্টা মূলত মানুষের শান্তি ও উন্নয়নকে ঘিরে। শান্তি ও উন্নয়ন চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব আসলে শিক্ষার মাধ্যমে। তাই মানুষ কোমর বেঁধে নেমেছে গুণগত শিক্ষা, জীবনমুখী শিক্ষা, কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষা, সৃজনশীল শিক্ষা, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা, সহযোগিতামূলক শিক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন নামের শিক্ষার সন্ধানে। এসব শিক্ষার প্রতীকী নাম হতে পারে ‘স্মার্ট শিক্ষা’।

স্মার্ট শিক্ষার জন্য প্রয়োজন স্মার্ট ক্লাসরুম। যথাযথ আলো-বাতাস, বিস্তৃত পরিসর, প্রজেক্টর, স্মার্ট বোর্ডসহ আধুনিক সুবিধাযুক্ত একটি কক্ষ স্মার্ট ক্লাসরুমের প্রাথমিক শর্ত হলেও এটিই মূল কথা নয়। এ ক্লাসরুমে পাঠদান করবেন যোগ্য, দক্ষ ও উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশ্বমানের শিক্ষক, যার কথায় ও আদর্শে শিক্ষার্থীরা উদ্বুদ্ধ হবে, স্বপ্ন দেখবে এবং অনুপ্রাণিত হবে; অর্থাৎ উন্নত শিখন পরিবেশে উপযুক্ত শিক্ষক কর্তৃক পাঠদান এবং আধুনিক উপায়ে মূল্যায়ন হবে। সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো না হলেও সিঙ্গাপুর, জাপান, দ. কোরিয়ার মতো হওয়া জরুরি। থাকবে নির্ভুল ও আধুনিক তথ্য-উপাত্ত সমৃদ্ধ পাঠ্যবই। এ শিক্ষার্থীরা হবে দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীল আদর্শ নাগরিক। এ শিক্ষার্থীরাই হবে স্মার্ট সিটিজেন এবং এরাই তৈরি করবে স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি আর জনগণ পাবে স্মার্ট বালাদেশ।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের অনেক অগ্রগতি হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আরও কিছু বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এখনো সেকেলে। যেখানে শিক্ষক সংখ্যা অপ্রতুল, সেখানে তা বাড়ানো প্রয়োজন। ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন অবকাঠামোর ক্ষেত্রে। আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষায়। কারিগরি শিক্ষা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আমাদের অর্জন এখন প্রায় অর্ধেক। কারিগরি শিক্ষায় বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ জার্মানি। সেখানে কারিগরি শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের পরে, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আমরা এগোতে পারিনি। তারা ব্যবহার করেছিল ডুয়েল ভোকেশনাল ট্রেনিং। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা ভোকেশনাল ট্রেনিং চলাকালেই কোনো কারখানায় উচ্চ বেতনে কাজ করে বাস্তব জ্ঞান লাভ করে। এভাবে তাদের কারিগরি শিক্ষা জনপ্রিয়তা পায়।

শিক্ষায় উন্নতি লাভের জন্য দরকার এ খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ। এ খাতে আমাদের ব্যয় এখনো জিডিপির ২ শতাংশের কাছাকাছি, যেখানে ভারতে ৪.৪ শতাংশ, ভুটানে ৫.৯ শতাংশ ও নেপালে ৪.১ শতাংশ। আর গুণগত শিক্ষার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এ ব্যয়ের আদর্শ মান হলো জিডিপির ৪-৬ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ। প্রযুক্তি শিক্ষার ভিত্তি হলো গণিত এবং আন্তর্জাতিক ভাষা হলো ইংরেজি। অথচ এ দুটি মৌলিক বিষয়ে মাধ্যমিক স্তরে পাঠদানকারী শিক্ষকের প্রায় ৮০ শতাংশই বিষয়সংশ্লিষ্ট নন (বেনবেইস গবেষণা)। এটি গবেষণায় প্রমাণিত যে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের শিক্ষার্থীরা শিখন ফল বিবেচনায় এগিয়ে থাকে। এ শিক্ষকরা অন্য বিষয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে গণিত বা ইংরেজি বিষয়ে কখনো কোনো ধরনের প্রশিক্ষণও পান না। তারা প্রশিক্ষণ পান তাদের নিজ বিষয়ে। স্বাভাবিক কারণেই এদের পাঠদান হয় শিক্ষককেন্দ্রিক এবং বক্তৃতা পদ্ধতিতে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয় ধারাবাহিকভাবে বিষয়ভিত্তিক ভীতি (গণিত ভীতি, ইংরেজি ভীতি), শিক্ষক ভীতি, পরীক্ষা ভীতি, স্কুল ভীতি বা শিক্ষা ভীতি।

অন্যদিকে গণসাক্ষরতা অভিযানের ২০১৯ সালের গবেষণায় প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকদের ৫৫ শতাংশের বিষয়ভিত্তিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। আবার মাউশি পরিচালিত ‘ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অফ সেকেন্ডারি স্টুডেন্ট’ গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, ইংরেজি ও গণিতে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা খারাপ বা খুবই খারাপ। শিক্ষার অন্যান্য স্তরেও আমরা প্রত্যাশিত অবস্থার তুলনায় অনেক পিছিয়ে। গবেষণায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি নয়। এদিকে শিক্ষা গবেষণাসহ সার্বিকভাবে গবেষণা খাতে আমাদের ব্যয় খুবই কম। যেসব দেশ যত উন্নত, তাদের গবেষণা খাতে ব্যয় তত বেশি। যাদের হাত ধরে যে কোনো শিক্ষা বাস্তবায়ন হবে, সেই শিক্ষকদের সম্মান প্রদানে আমরা খুবই পিছিয়ে। শিক্ষার মূলভিত্তি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের জন্য আজও তৈরি হয়নি যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক ক্যারিয়ার-পথ। সমগ্র চাকরি জীবনে সহকারী শিক্ষক নামের একই পদ থেকে অবসর নেন অধিকাংশ শিক্ষক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এ ক্ষেত্রে আরও বেশি বঞ্চিত। উল্লেখ্য, মাধ্যমিক স্তরের ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই পড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে (ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২’)। টেকসই উন্নয়ন ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে হলে আমাদের অতিক্রম করতে হবে এসব সীমাবদ্ধতা। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ অর্থাৎ উন্নত বাংলাদেশ পেতে এখনই প্রয়োজন শিক্ষায় প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার তথা স্মার্ট ক্লাসরুমের ব্যবহার। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিশেষ পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ।

শান্তি ও উন্নয়নে শিক্ষার অবদানকে স্বীকার করে এবং যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে জাতিসংঘ ২৪ জানুয়ারিকে ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস হিসাবে। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মানবসম্পদে বিনিয়োগ, শিক্ষায় অগ্রাধিকার’। অর্থাৎ মানবসম্পদ তৈরির উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করতে চাইলে শিক্ষা খাত অগ্রাধিকারযোগ্য। সব সমস্যার সমাধান যেহেতু শিক্ষায়, সুতরাং বিশ্বব্যাপী সংগঠিত হতে পারে শিক্ষাবিপ্লব। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে শ্রেণিকক্ষে শিখনের উপযুক্ত পরিবেশ তথা স্মার্ট ক্লাসরুম। তাই আগামী দিনে শিক্ষায় গবেষণা হয়ে উঠতে পারে খুবই জরুরি ও জনপ্রিয়। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষাবিপ্লবের এ মিছিলে শরিক হতে হবে আমাদের সবার।

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার এবং ড. মো. বিল্লাল হোসেন : শিক্ষক ও গবেষক

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম