Logo
Logo
×

বাতায়ন

নারী-পুরুষ বৈষম্য ও ডিজিটাল বিশ্ব

Icon

রোকেয়া কবীর

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নারী-পুরুষ বৈষম্য ও ডিজিটাল বিশ্ব

বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহার বিশ্ববাসীকে পরস্পরের কাছাকাছি এনে দিয়েছে। এর ফলে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে। তবে সব শ্রেণির মানুষের যেহেতু প্রযুক্তিতে অভিগম্যতা সমান নয়, তাই এ অগ্রগতির সুফল সব মানুষের কাছে সমানভাবে পৌঁছেনি। যেহেতু বিদ্যমান প্রযুক্তি নারীবান্ধব নয়, সেখানে অভিগম্যতা ও সুফল ভোগ করার ক্ষেত্রে নারীরা ব্যাপকভাবে পিছিয়ে রয়েছে।

জাতিসংঘের উইমেনস জেন্ডার স্ন্যাপশট প্রতিবেদন ২০২২ অনুযায়ী, গত দশকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের দেশজ উৎপাদন কমেছে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের, যা ২০২৫ সালে ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। অন্যদিকে ৫১টি দেশের ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ সময়ে অনলাইনভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৩৮ শতাংশ নারী। এ প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে প্রযুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করাসহ সবার জন্য টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৩-এর মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘ডিজিট-অল : ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি ফর জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি’, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সমভাবে তাৎপর্যপূর্র্ণ। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এ প্রতিপাদ্য জাতিসংঘের নারীর অবস্থা সম্পর্কিত কমিশনের ৬৭তম অধিবেশনের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়বস্তুর সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সব নারী ও মেয়ের ক্ষমতায়নের জন্য ডিজিটাল উৎকর্ষের যুগে উদ্ভাবন, প্রযুক্তিগত রূপান্তর ও শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

আমরা জানি, বাংলাদেশের সমাজ উন্নয়নে নারীরা পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাজনীতি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক খাতের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তার মূলেও নারীর অবদান সর্বাধিক। বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণকালে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও আমাদের দেশের প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকার মূল কারণ গার্হস্থ্য, কৃষি, গার্মেন্টসহ আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সব ক্ষেত্রে নারীর নিরলস শ্রম, যা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও তার লেখায় দেখিয়েছেন। অথচ একই সময়ে বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে নারীকে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে না তুলে অদক্ষতার অজুহাতে শ্রমবাজার থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সম্পদহীনতার কারণে আধুনিক সরঞ্জাম ক্রয়ে অসমর্থতার কারণেও শ্রমবাজারের প্রতিযোগিতায় নারীরা পিছিয়ে পড়ছে।

অন্যদিকে পারিবারিক কাজে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সরঞ্জামাদির জোগান না থাকায় নারীর মজুরিবিহীন কাজের ভার কমছে না। এক্ষেত্রে পরিবারগুলোর অনীহা পেশাগত কাজের জন্য নিজের দক্ষতা বাড়িয়ে উপার্জনমূলক কাজে নারীর যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার এটিও লক্ষণীয়, যেসব কাজের সঙ্গে নারীরা বেশি যুক্ত থাকে, যেমন পরিচ্ছন্নতাকর্ম, খাদ্যশস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার গুরুত্ব না পাওয়ায় নারীদের পরিশ্রম বেশি হওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে।

বর্তমান বিশ্ব যে সাইবার বিপ্লব সাধন করে চলেছে তার অংশ নারীরাও। বিপ্লব সাধিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও। তথ্য আদান-প্রদান ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা থেকে শুরু করে বিনোদন ও বাণিজ্যের প্রয়োজনে আজ নারী-পুরুষ সবাইকেই এ জগতের দ্বারস্থ হতে হয়; কিন্তু দুঃখজনকভাবে নারী ব্যবহারকারীদের বেশির ভাগকেই এখানে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়। প্রতিমুহূর্তে সতর্ক থেকেও তারা সাইবার সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহাই পায় না। পাশাপাশি কোনো কোনো গোষ্ঠী ডিজিটাল মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজব, ভুল তথ্য ও মিথ্যা ছড়িয়ে নারীবিরোধী ঘৃণ্য প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে এবং অসহিষ্ণুতা উসকে দিয়ে সমাজে সম্প্রীতি ও সহনশীলতার পরিবেশ বিনষ্ট করছে; নারীবিদ্বেষকে উসকে দিচ্ছে এবং বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করছে। এ প্রেক্ষাপটে এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবস থেকে প্রেরণা নিয়ে আমাদের দাবি হওয়া উচিত-ডিজিটাল খাতে বর্তমান বিশ্বের অগ্রগতিকে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে কাজে লাগানো হোক, যাতে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা ও যৌন সহিংসতা মোকাবিলায় প্রযুক্তি হয় গণতান্ত্রিক, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সহায়ক ও সৃজনশীল।

আমাদের মনে রাখতে হবে, অনলাইনে নারীকে হেনস্তাকারী নারীবরোধী গোষ্ঠীকে প্রতিহত করা না গেলে ডিজিটাল খাতের অগ্রগতি নারীর জন্য কোনোই ইতিবাচকতা বয়ে আনবে না। সুতরাং বিদ্যমান আইনি, প্রশাসনিক ও জনবল কাঠামোর সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিত করে এবং প্রয়োজনীয় হলে এ ক্ষেত্রে সক্ষমতা আরও বাড়িয়ে হলেও অনলাইনে নারীকে সার্বিক নিরাপত্তা দিতে হবে। তাহলেই এবারের নারী দিবসের সুফল আমাদের নারীদের কাছে পৌঁছাবে এবং দেশ ও সমাজ হবে সমৃদ্ধ।

পাশাপাশি এখানে আমি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তোলার ওপর জোরারোপ করতে চাই, যাতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই নারীর সমানাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানসিকতা নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অনলাইনে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীর প্রতি হেনস্তার সঙ্গে যুক্তদের বেশির ভাগই শিক্ষিত মানুষ। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ, সংবিধান ইত্যাদির প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনমানসিকতা তৈরি করতে না পারে, তাহলে সেই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আশান্বিত হওয়ার কিছু থাকে না।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যতটা মুখস্থবিদ্যা অর্জন করে পরীক্ষার বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল শিক্ষা দেয়, ততটা চিন্তাভাবনাকে উসকে দেয় না। এখানে প্রসঙ্গক্রমে সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তকে বিবর্তনবাদ ও মাসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে যে তুলকালাম হয়ে গেল, তারও উদাহরণ টানা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা পাঠ্যপুস্তকে বিবর্তনবাদ ও মাসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে অভিযোগ করেছেন, তারা শিক্ষিতজন এবং সবাই এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা। যদি প্রচলিত শিক্ষা মুখস্থবিদ্যার বাইরে যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে কোনো কিছু মূল্যায়ন করার যোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হতো, তাহলে তারা এর বিরোধিতা করাকে মূর্খামি বা মতলববাজি মনে করত। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার সনদধারী হয়েও সুযোগ পেলেই অনলাইনে-অফলাইনে নারীকে হেনস্তা করার মানসিকতা তাদের মধ্যে তৈরি হতো না। প্রায়ই বিভিন্ন গুজবের পেছনে ছুটে যেসব লোক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে, তাদেরও একটা বড় অংশ থাকে শিক্ষিত মানুষ। এসব উদাহরণ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ তৈরি করে দেয়। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই জেন্ডার, সংবিধান, ইতিহাস, প্রাথমিক বিজ্ঞান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে সনদধারীরা বের হয় না বলেই পেশাগত দায়িত্বে যুক্ত হওয়ার পর তাদের এসব বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হয়। এতে রাষ্ট্রের বিপুল অঙ্কের অর্থের অপচয় হয়।

প্রতিবছর নারী দিবসকে ঘিরে যেসব আয়োজন হয়, সেগুলোকে আমরা স্রেফ আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত করে তুলতে না চাইলে সত্যিকার অর্থেই বিদ্যমান অবস্থা পরিবর্তনে কার্যকর হবে এমন উদ্যোগ গ্রহণে আমাদের যত্নবান হতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রের নাগরিকদের অর্ধেক অংশ নারীসমাজের চলার পথের সমুদয় প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।

রোকেয়া কবীর : মুক্তিযোদ্ধা ও নারীনেত্রী; নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম