Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন’ কোর্স থাকা জরুরি

Icon

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন’ কোর্স থাকা জরুরি

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দেশের সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারদের কাছে আইন বিভাগের কোর্সে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ কোর্স অন্তর্ভুক্তিকরণের লক্ষ্যে একটি পত্র পাঠিয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা থেকে প্রাপ্ত পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি ওই পত্র পাঠায়। নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে দেশের বাস্তব অবস্থা ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের কোর্সে উক্ত নিরাপদ আইন কোর্সটি অন্তর্ভুক্তিকরণ এখন সময়ের দাবি। কারণ, মানুষের জীবনধারণ ও জীবনযাপনের জন্য যতগুলো চাহিদা রয়েছে, খাদ্য হচ্ছে তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান মৌলিক চাহিদা। কিন্তু দেশের জনগণ প্রতিদিন যেসব খাবার খায়, তা কি সম্পূর্ণরূপে ভেজালমুক্ত? নিশ্চয় না। অর্থাৎ প্রতিনিয়তই জনগণ ভেজাল খাদ্য খাচ্ছে। ভেজালযুক্ত খাদ্য থেকে জনগণ মুক্তি চাইলেও যেন কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছে না। তবে একদিনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অসাধু ও মুনাফালোভীদের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

ভেজালমুক্ত খাদ্য যেমন-দেহের ক্ষয় পূরণ, বৃদ্ধি সাধন এবং রোগ-প্রতিরোধ করে, তেমনি ভেজালযুক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জীবন বিপন্ন হয়। তাই ‘সকল সুখের মূল’ নামক স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখতে ভেজালমুক্ত খাবার গ্রহণের বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের দেশে শাক-সবজি, ফল-মূল, মাছ-মাংস, দুধ, গুড়, মসলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যই ভেজালে পরিপূর্ণ। এমনকি এ দেশে শিশুখাদ্যসহ জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল মেশানো হয়েছে এবং ভেজালযুক্ত ওষুধ খেয়ে অনেক শিশুর মৃত্যুও হয়েছে। আবার এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত ছাড়ও পেয়েছেন, যে লজ্জা গোটা জাতির। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত এমনই এক বিষয় যে, এ ক্ষেত্রে কাউকে ন্যূনতম ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ আমাদের দেশে ঘটে উলটো ঘটনা।

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কঠিন সময়েও এ দেশে থেমে ছিল না খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা। অনেক সময় দেখা যায়, ফল পাকানোর ক্ষেত্রে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে। ফল পাকানোয় ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিকের কিছু অংশ ফলের খোসার সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে ফলের ভেতরে প্রবেশ করে। আর এ ধরনের ফল খাওয়ার ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের অংশবিশেষ শরীরে ঢুকে লিভার, কিডনিসহ মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে থাকে। বিকল্প উপায় না থাকায় জনগণকে এক প্রকার বাধ্য হয়েই এসব ভেজাল খাদ্য খেতে হচ্ছে। ফলে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালেই মারা যাচ্ছেন। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল (যেমন-ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম পাউডার বা পিপিটি, ইথেফেন ইত্যাদি) মেশানোর বিষয়টি দেশে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত ও নিন্দিত হলেও জনগণ যেন এ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে শিল্প খাতে ফরমালিনের প্রয়োজন ৪০-৫০ টন। কিন্তু গত অর্থবছরে ফরমালিন আমদানি করা হয়েছে ২০৫ টন। তার মানে বাড়তি ১৫০ টনের বেশি ফরমালিন বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে দেশবাসীর পেটে গেছে।

অনেক সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে বিভিন্ন বাজারকে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করতে দেখা যায়। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ফরমালিনমুক্ত ঘোষিত ওই বাজারে নিয়মিত কোনো পরীক্ষাই করা হয় না। ভেজালযুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে দেশের জনগণ স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে অগণিত শিশু, যাদের বলা হচ্ছে আগামীর ভবিষ্যৎ। এ ধরনের পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সবার জন্যই উদ্বেগজনক। আমাদের পুরো খাদ্যচক্রের মধ্যে প্রতিনিয়ত যেভাবে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে করে মনে হয় জাতি হিসাবে আমরা দ্রুতগতিতে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অথচ এসব বন্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তেমন কোনো বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। এমনকি আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়নি ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ প্রশাসন’ ধরনের কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, উচ্চ আদালতের নির্দেশ জারির দীর্ঘদিনেও খাদ্যে ভেজাল রোধে সারা দেশে স্বতন্ত্রভাবে খাদ্য আদালত গঠন করা হয়নি।

বস্তুত অবস্থা এমন যে, জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করার কেউ নেই। খাদ্যে ভেজাল রোধে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মধ্যেই যেন কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। অথচ এর মাধ্যমে দূরদর্শিতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রতি বছর ১৫ মার্চ এলে ঘটা করে ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করা হয়। সারা দেশ যখন ভেজালযুক্ত খাদ্যে ভরে গেছে, তখন এমনি পরিস্থিতিতে কনজ্যুমার রাইটস সোসাইটি ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) একসঙ্গে আন্দোলন করার পর ২০১০ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর গঠন করা হয়। তথাপি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অব্যাহত গাফিলতি এবং দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বহীনতার কারণে কোনোভাবেই খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এভাবেই চলছে মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর ভেজাল খাদ্য খেয়ে তিন লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন মরণব্যাধি ক্যানসারে। আর প্রায় দেড় লাখ মানুষ ডায়াবেটিস এবং প্রায় দুই লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে শিশু ও গর্ভবতী মহিলারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। ভেজাল খাদ্যের কারণে গর্ভবতী মায়ের শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয় এবং গর্ভজাত অনেক শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। ভেজাল খাদ্যের কারণে শিশু বিকলাঙ্গ হওয়া এবং শিশুখাদ্যে ভেজাল মেশানো আগামী প্রজন্মের জন্য নিঃসন্দেহে এক অশনিসংকেত।

নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীতে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারে সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে অধিক মুনাফার লোভে খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশাচ্ছে। অনেক সময় এদের কাউকে হাতেনাতে ধরা হলেও তারা ঘুস, পেশিশক্তিসহ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা এবং জনগণ সচেতন ও সোচ্চার না হওয়ায় খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এ অবস্থার যদি দ্রুত ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন ঘটানো না হয়, তাহলে আগামীতে এর কুফল যে কী ভয়ানক ও বিপজ্জনক হবে, তা সময়মতোই হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে। আর তখন হয়তো করার মতো তেমন কিছুই থাকবে না।

আশার কথা, সরকার সম্প্রতি ফরমালিন আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ যেন বাস্তবায়িত হয়, সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া উচিত। এ আইনে খাদ্যে ভেজাল বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর অভিযোগে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া খাদ্য নিয়ে মিথ্যা বিজ্ঞাপন, নিবন্ধন ছাড়া খাদ্য বিপণন, ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত এমন কাউকে দিয়ে খাদ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়ন করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। সরকার জনস্বাস্থ্যের তথা জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে দেশের সব জেলায় খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠা করতে যথেষ্ট আন্তরিক হবে বলে সবার প্রত্যাশা।

খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক বিভিন্ন পদার্থ মেশানো রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকার, বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন; প্রয়োজন নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তবে খাদ্যে ভেজালরোধে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজের নৈতিকতাবোধ ও বিবেককে জাগ্রত করা। দেশের ৬৭টি প্রাইভেট এবং ১৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু আইন বিভাগ রয়েছে, তাই ইউজিসির সম্প্রতি ইস্যুকৃত পত্রের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন বিভাগের কোর্সে নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ কোর্সটি অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ইতিবাচক গবেষণাসহ বিভিন্নভাবে কাজে আসবে বলে আশা করা যায়।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

kekbabu@yahoo.com

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম