Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষাক্রম : পরিবর্তনের নতুন ধারা

Icon

এএসএম রিয়াজ উদ্দিন

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষাক্রম : পরিবর্তনের নতুন ধারা

শিক্ষাক্রম ভবিষ্যৎমুখী। আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা ভবিষ্যতে কী ধরনের নাগরিক হিসাবে দেখতে চাই কিংবা একটি জাতির মিশন, ভিশন কী-তার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা এতে চিত্রায়িত থাকে। একটি শিক্ষাক্রম শুরু হওয়া মাত্রই এটি শতভাগ সফল বা ব্যর্থ, এটি বলার সুযোগ নেই। কেননা, শিখনফল কিংবা নতুন শিক্ষাক্রমে বর্ণিত শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতা কতটা অর্জিত হলো, তা শ্রেণিশিক্ষক পরিমাপ করতে পারলেও শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য বা রূপকল্প কতদিনে বাস্তবায়িত হবে, তা নির্ণয় করার সুযোগ তার নেই। তাছাড়া একটি শিক্ষাক্রম কতদিনে বাস্তবায়িত হবে, তা বলা কঠিন আর শিক্ষাক্রম আংশিক বাস্তবায়নের টার্গেট নিয়ে অগ্রসর হওয়াও বিপজ্জনক।

জ্ঞানের পরিধি দ্রুতবর্ধনশীল। যন্ত্রনির্ভরতা-আরও বৃহত্তর অর্থে বলতে গেলে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা বদলে দিচ্ছে পৃথিবীর মানুষের জীবন-জীবিকার মানচিত্র। মানব ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রযুক্তির বিপ্লব এগিয়ে চলেছে অভাবনীয় গতিতে। স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নতুন বিশ্বে একদিকে যেমন সীমাহীন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাচ্ছে, অন্যদিকে বর্তমানের চিরচেনা অনেক পেশা হারিয়ে যেতে পারে, যা আমরা কিছুটা আঁচ করতে পারলেও পুরোটা এখনো অজানা। সংক্ষেপে বলা যায়, একদিকে সীমাহীন সম্ভাবনা, অপরদিকে অপরিসীম ঝুঁকি। বিশ্বব্যাপী বেশির ভাগ মানুষ উন্নয়নের স্পর্শ পেলেও জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, পরিবেশদূষণ, সন্ত্রাসবাদ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, অভিবাসন ও জাতিগত সহিংসতার সংকট অতি প্রকট। কোভিড-১৯-এর মতো অতিমারি প্রচলিত সব চিকিৎসাপদ্ধতি ব্যর্থ করে দিয়ে পৃথিবীর অতি ধনী দেশটিরও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। দরজা-জানালা বন্ধ করে থাকলেও এর কোনো সমস্যা থেকে আমরা মুক্ত নই। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমাদের এখন আর পুরোনো সক্ষমতা বা যোগ্যতা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। নতুন বিশ্বের সঙ্গে অভিযোজন ঘটাতে প্রয়োজন আগের ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে সময়োপযোগী যোগ্যতা অর্জন আর আজকের শিশুকে এখন থেকেই গড়ে তুলতে হবে দেশপ্রেমিক বিশ্বনাগরিক হিসাবে। আর তখনই জনসংখ্যা চ্যালেঞ্জ না হয়ে সম্পদে রূপান্তরিত হবে। তাই শিক্ষাক্রমের সংস্কার বা উন্নয়ন সময়ের দাবি; আর আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে উপরিউক্ত লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা।

দেশের শিক্ষাক্রম উন্নয়নের ইতিহাসে ১৯৯৫-৯৬ সালের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও নবায়ন কমিটি প্রথমবারের মতো শিক্ষাক্রমে ‘শিখনফল’ শব্দটি সংযোজন করে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি-এ তিনটি ভাগে শিখনের উদ্দেশ্যকে শ্রেণিবিভাগ করে। পরবর্তী সময়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে স্বাধীনতার পর দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণীত হয় এবং তার আলোকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ বাস্তবায়িত হয়; যেখানে শিখনফলকে শিক্ষকের চোখের সামনে নিয়ে আসার জন্য পাঠ্যপুস্তকেও শিখনফল শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু আমাদের পঠন-পাঠন, প্রশ্নের ধরন, শিক্ষদের উদাসীনতা, অভিভাবকদের ফলাফলকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কোচিং নামক নার্সিংয়ের প্রাধান্যের কারণে জ্ঞানের লক্ষ্যমাত্রার দিকে খুব একটা বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায়নি।

নবপ্রবর্তিত শিক্ষাক্রমে শিখনফল-এর পরিবর্তে যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে এবং শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতা ও একক যোগ্যতা নির্দিষ্ট করা হয়েছে, যার আলোকে পাঠপরিসর এবং বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে, যা শুধু শ্রেণিকক্ষের ভেতরে সম্পন্ন হবে তা নয়; শিক্ষার্থীদের বাইরেও নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে নানাবিধ যোগ্যতা অর্জন করতে হলে বাইরে কিংবা তার জানাশোনা পরিবেশে অথবা তার পাশের কোনো বাগান, কারখানা, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, ঐতিহাসিক স্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত কোনো প্লট, মৃৎশিল্প, কুটির শিল্প ও বৃহদায়তন শিল্পে নিয়ে যাওয়া হবে-যা এতদিন ছিল তার কল্পনা, এখন তা নিজ চোখে বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পর্যবেক্ষণ করবে। এর মধ্য দিয়ে তার অনুসন্ধিৎসু মন গড়ে উঠবে। আর এটির পোশাকী নাম দেওয়া হয়েছে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, শিক্ষার্থী কেন শিখবে তা এখানে মুখ্য, কী শিখবে সেটা পরে; অর্থাৎ ‘কেন’-এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে কী কী-এর উত্তর পেয়ে যাবে, এতে তার গভীর শিখনও হয়ে যাবে।

যেকোনো শিক্ষাক্রমের দার্শনিক ভিত্তি থাকে। নতুন এ শিক্ষাক্রমের দার্শনিক ভিত্তি হলো, ডেভিড কোব-এর অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন। তিনি মনে করেন, শিখনের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শেখা। তিনি ১৯৮৪ সালে প্রণীত তার মডেলে চারটি বিষয়ের অবতারণা করেন। প্রথমত, প্রেক্ষাপটনির্ভর অভিজ্ঞতা; দ্বিতীয়ত, প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ; তৃতীয়ত, বিমূর্ত ধারণায়ন; এবং চতুর্থত, সক্রিয় পরীক্ষণ। অর্থাৎ নতুন কোনো ক্ষেত্রে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন। এতে পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থী উদ্ভাবনীমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ হবে। এ নতুন ধারণা আসলে করে শেখা (Learning by doing ), যার কথা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে অ্যারিস্টটল বলে গেছেন।

নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নে নতুনত্ব হলো, শুধু কাগজ-কলমনির্ভর পরীক্ষা নয়; বরং যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়নের মাধ্যমে নির্দিষ্ট যোগ্যতা অর্জনে শিক্ষার্থী কোন অবস্থানে আছে, তা জানা। শিক্ষার্থী মূল্যায়নে শিক্ষকের পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবক, সহপাঠী এবং কমিউনিটি অংশগ্রহণ করবে। মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় শিখনের জন্য মূল্যায়ন (Assessment for Learning) ও মূল্যায়নের মাধ্যমে শিখন (Assessment as Learning)-এ দুটিকে প্রাধান্য দিয়ে সামষ্টিক মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। আচরণভিত্তিক সূচক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা বহুল প্রত্যাশিত ছিল। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত গতানুগতিক কোনো পরীক্ষা থাকবে না। ফলাফল প্রকাশের তিনটি স্ট্যান্ডার্ড থাকবে যথা-প্রারম্ভিক, বিকাশমান ও দক্ষ। দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী অভিন্ন বিষয় পড়বে।

নতুন শিক্ষাক্রম যেমন শিক্ষার্থীসহ সবার মনে নতুন আশা জাগায়, তেমনি এর বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শিক্ষালয়গুলোতে অবকাঠামোগত সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি নেই যথোপযুক্ত শিখনসামগ্রী। আর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে গেলে এ দুটিও যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন ফুল প্যাকেজ, অর্থাৎ নীতিনির্ধারকদের মাথায় নিতে হবে শিক্ষার্থীর আবাসন, খাদ্য, যাতায়াত সুবিধা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন যে একটি সুবিশাল ও জটিল প্রক্রিয়া, এটি সর্বমহল পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নয়। এ কারণে অনেক জায়গায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মূল্যায়ন ব্যবস্থায় অস্পষ্টতা রয়েছে। শিক্ষকদের সদিচ্ছার ঘাটতি, বাণিজ্যিক মনোভাব, শিক্ষা প্রশাসনের যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব এবং অভিভাবকদের যেকোনো উপায়ে নিজ সন্তানের ভালো ফলাফল লাভের আগ্রাসী মনোভাব।

কোভিড-১৯-এর প্রভাব কেউ ভুলে গেলেও এর দগদগে ঘা এখনো শুকোয়নি। করোনাকালীন শিক্ষার্থীদের যে মনোসামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে জীবনঘনিষ্ঠ মানসসম্মত শিক্ষা অর্জনের জন্য নতুন শিক্ষাক্রম অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা দেখি, নিজের ত্রুটি ঢাকতে অন্যের ত্রুটি খোঁজার একটা প্রবণতা রয়েছে। এ অভ্যাসটুকু পরিহার করে আশাবাদী হয়ে সংশ্লিষ্টরা নিজ দায়িত্ব পালন করলে শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমের স্বাদ আস্বাদন করতে প্রস্তুত। অনেকে বলেন, শিক্ষার্থীরা এ চাপ নিতে পারবে কি? আমি মনে করি, তারা সবসময় পেরেছে, এবারও পারবে; বরং আপনি নিজের ঘাটতিগুলো দূর করে প্রস্তুতি নিন।

এএসএম রিয়াজ উদ্দিন : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম