Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন উপসগ

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাদান পদ্ধতি, পাবলিক পরীক্ষা ও পরীক্ষায় নকল, প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং পরীক্ষার ফলাফল-এ সবকিছু নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, বক্তৃতা-বিবৃতি, সভা-সেমিনার গত একান্ন বছরে কম হয়নি আমাদের দেশে। অবশ্য একদিক দিয়ে বিবেচনা করলে এমনটাই হওয়ার কথা। একটি উন্নত ও মর্যাদাসম্পন্ন জাতি বিনির্মাণে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। অধিকন্তু একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন কিংবা বাস্তবায়নের জন্য এ সবকিছুই হচ্ছে চলমান প্রক্রিয়া।

তবে আলোচনা-সমালোচনায় বেশ কয়েক বছর ধরেই অনেকটা মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এসএসসি-এইচএসসিসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় পাশের উচ্চহার এবং একই সঙ্গে এ-প্লাস পাওয়ার বিষয়টি। বিশেষ করে জিপিএ-৫সহ এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করার পর উচ্চশিক্ষা স্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে গিয়ে একেবারে আশি ভাগ শিক্ষার্থীর উপর্যুপরি বিফল হওয়ার বিষয়টি সচেতন সবাইকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। বেশ মোটা দাগে প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষার মান নিয়ে। পীড়াদায়ক হলেও সত্য, পাবলিক পরীক্ষায় পৌনঃপুনিকভাবে এ-প্লাসের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বিড়ম্বনা নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের মুখরোচক আলোচনা।

জানি না এর শেষ পরিণাম-পরিণতি কী হবে। ২০২১ সালে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নেয় মোট ২২ লাখ ৪০ হাজার ৩৯৫ জন পরীক্ষার্থী। তাদের মধ্যে পাশ করে ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৪৬ জন। ১১ বোর্ডে গড় পাশের হার ৯৩.৫৮। ২০২২ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১১ বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দেয় ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন। পাশ করে ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৯ জন। ১১ বোর্ডে গড় পাশের হার ৮৭.৪৪। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে প্রায় আড়াই লাখ পরীক্ষার্থী কমেছে, কমেছে পাশের হারও। অন্যদিকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং পাশের হার কমলেও সবকিছুকে ছাড়িয়ে বেড়েছে এ-প্লাস পাওয়াদের সংখ্যা। গত বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় রেকর্ডসংখ্যক; ১১ বোর্ডে মোট ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী এ-প্লাস পেয়েছে। এর আগের বার এ-প্লাসধারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৮০। তার মানে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এ-প্লাসের সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ হাজার ২২২-এ।

১৯৪৭ সালে পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৯ সালে আমাদের বাংলাদেশ অঞ্চলে স্থাপন করা হয় ইস্ট বেঙ্গল সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ড (পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড)। জানা যায়, এ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রথমবারের মতো মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা (বর্তমানের এসএসসি) অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫০ সালে। সেবারের (১৯৫০) পরীক্ষায় সারা পূর্ববঙ্গের স্কুলগুলো থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয় মোট দুইশ’র মতো পরীক্ষার্থী। খুব ধীরলয়ে কিছু ব্যতিক্রমসহ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণের সংখ্যা। উপজেলা (সাবেক থানা) তো বটেই, অনেক সময় গোটা জেলাতেও (সাবেক মহকুমা) এসএসসি বা এইচএসসি স্তরে হাতেগোনা দু-চারজন পরীক্ষার্থীর ভাগ্যেও জুটত না প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার সনদপত্র। ষাটের দশকের প্রথমার্ধে পৃথক শিক্ষা বোর্ড হিসাবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী ও যশোর বোর্ড যার যার মতো করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। গোটা পাকিস্তান আমলে একেকটি বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো পরীক্ষায় গড়ে দুই-আড়াইশ করে চারটি বোর্ডে সারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে সর্বমোট এক হাজার পরীক্ষার্থী প্রথম বিভাগে পাশ করেছেÑএমনটি ছিল বলতে গেলে ভাবনারও অতীত। পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৫৬ সালের মেট্রিকুলেশন (এসএসসি) পরীক্ষায় নিয়মিত ৩৮ হাজার ৫৭৭ জন আর অনিয়মিত ৩ হাজার ৪৫ জন মিলে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৪১ হাজার ৬৬২ জন। তাদের মধ্যে সর্বমোট ৫৫০ জনের মতো পরীক্ষার্থী পাশ করে প্রথম বিভাগে (সারা প্রদেশে); আর ১২টি থানা নিয়ে গঠিত আমার নিজ মহকুমা কিশোরগঞ্জ থেকে মাত্র ১১ জন (১৯৫৬ সাল)। নিজ থানা করিমগঞ্জের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ প্রথম বিভাগ পায়নি।

বলে রাখা ভালো, ২০০১ সালে পাবলিক পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত সনাতন পদ্ধতি অনুযায়ী কোনো পরীক্ষার্থী প্রতি বিষয় বা পত্রে গড়ে শতকরা কমপক্ষে ৩৩ নম্বর পেলে তৃতীয় বিভাগ, ৪৫ পেলে দ্বিতীয় বিভাগ এবং ৬০ বা এর বেশি নম্বর পেলে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ বলে গণ্য হতো। এ ছাড়া শতকরা ৭৫ ভাগ নম্বর পাওয়াকে বলা হতো ‘স্টার’।

এইচএসসি এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফলেও দেখা গেছে একই চিত্র। পরীক্ষা পাশের অস্বাভাবিক হার বৃদ্ধির পাশাপাশি ১৯৭১ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় (’৭২ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত) চারটি বোর্ড থেকে প্রথম বিভাগ পায় প্রায় ১২ হাজার পরীক্ষার্থী। ওই পরীক্ষায় কেবল ঢাকা বোর্ড থেকেই প্রথম বিভাগ পায় ৩ হাজার ৮০৭ জন। কিন্তু কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অর্জন করা রেকর্ডসংখ্যক প্রথম বিভাগ এবং সর্বকালের সর্বোচ্চ পাশের হার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র দুই-তিন বছর এমন ‘আত্মপ্রসাদে আত্মহারা’ ছিল দেশের মানুষ। এরপর কী হলো? ’৭২ সালে এসএসসিতে ৭০ হাজার প্রথম বিভাগের স্থলে ’৭৫ সালে চারটি বোর্ডে প্রথম বিভাগ পায় মাত্র ৩,৩০০ পরীক্ষার্থী (ঢাকা ১৪৪৬, রাজশাহী ৭১৭ এবং যশোর বোর্ডে ৫৭৯ জন)। আর আমাদের করিমগঞ্জ (কিশোরগঞ্জ) হাইস্কুলে? স্বাধীনতা লাভের পরপর ’৭২ সালে ১৭ জন প্রথম বিভাগ পেলেও ’৭৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় কেউই প্রথম বিভাগ পায়নি। দ্বিতীয় বিভাগও শূন্য। থানা সদরে অবস্থিত একমাত্র হাইস্কুলটিতে নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তিনজন মাত্র পাশ করে; কোন বিভাগে তা বোধকরি স্পষ্ট করে উল্লেখ করার দরকার নেই। অন্যদিকে এইচএসসি পরীক্ষায় ’৭২ সালে চার বোর্ডে ১২ হাজারের স্থলে ’৭৫ সালে প্রথম বিভাগ পায় ১২শ-রও কমসংখ্যক পরীক্ষার্থী (ঢাকা বোর্ডে প্রথম বিভাগ ৪৩১ জন)।

দেশে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করার সময় সবক’টি শিক্ষা বোর্ড থেকে এ-প্লাস পায় এসএসসিতে মোট ৭৬ জন (২০০১ সাল) আর এইচএসসিতে ২০ জন (২০০৩ সাল)। ১০-১২ বছরের ব্যবধানে এ-প্লাসের সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় এসএসসিতে ১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ এবং এইচএসসিতে ৭০ হাজার ৬০২-এ।

যুগ যুগ ধরেই কোনো পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পাওয়াটা ছিল খুবই আনন্দ আর স্বস্তির বিষয়। অনেকটা যেন হাতে চাঁদের নাগাল পাওয়া। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর এ ‘বস্তুটি’ (প্রথম বিভাগ) খুবই সহজলভ্য, অথচ অনেক ক্ষেত্রেই দুঃসহ বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে দ্রুতই সে সময়কার পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু আজ এ-প্লাসের ক্ষেত্রে? স্বাধীনতা লাভের ৫১ বছরের মাথায়? কোমলমতি কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা এ-প্লাস ও অপেক্ষাকৃত ভালো জিপিএ গ্রেড নিয়ে প্রতিনিয়ত যে বিড়ম্বনা পোহাচ্ছেন, জানি না এ থেকে কবে ও কীভাবে মুক্তি মিলবে।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষকর্

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম