মেট্রোরেল ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা
মিফতাহুর রহমান
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) কথাটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘দ্রুত গণপরিবহণ’। এমআরটি প্রকল্প বর্তমান সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর আওতাধীন মহাসড়ক বা গণপরিবহণের অংশ।
এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে সড়ক ও মহাসড়ক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, নদী ও সমুদ্রবন্দর, প্রতিরক্ষা, সরকারি ভবন, ক্রীড়া, বাঁধ, ডেল্টা প্ল্যান, স্যাটেলাইট, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রভৃতি।
অতিজনবহুল ঢাকা মহানগরীতে আধুনিক গণপরিবহণ অবকাঠামো না থাকায় একদিকে তীব্র যানবাহন সমস্যা, অন্যদিকে অসহনীয় যানজটের কারণে নগরবাসীকে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হয়। এ দুর্ভোগ লাঘবের উদ্দেশ্যেই হাতে নেওয়া হয়েছে এমআরটি প্রকল্প।
দেশের আর্থসামাজিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে গণপরিবহণ অবকাঠামোর জন্য সঠিক নীতিমালা ও দূরদর্শী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি, যা দলমতনির্বিশেষে সবার প্রত্যাশা। এমআরটি প্রকল্পের আওতা বাড়িয়ে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হলে দেশে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিসহ বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করি।
এমআরটির আওতাধীন দেশের প্রথম মেট্রোরেল গত ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন, যা দেশের গণপরিবহণের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায় বলে মনে করি।
এমআরটি-৬ লাইনের প্রথম ধাপে উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত জনসাধারণের চলাচলের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর উন্মুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, ঢাকায় নির্মিতব্য মেট্রো লাইনের মোট সংখ্যা ৬ এবং প্রথম ধাপে উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১ কিলোমিটার এমআরটি লাইন-৬-এর কাজ ২০১৬ সালের ২৬ জুন উদ্বোধন করা হয়।
মেট্রোরেল প্রকল্প জাইকার অর্থায়নে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের অনেক কারিগরি দিক আছে, যা বাস্তবায়ন করতে একাধিক দেশ বা একাধিক আন্তর্জাতিক কোম্পানির সম্পৃক্ততা স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি। এখানে বলা বাহুল্য, ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ এ প্রকল্পের বিভিন্ন ধরনের কাজের দায়িত্ব দিয়েছে জাপানের মারুবেনি, কাওয়াসাকি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ, মিটসুবিশি এবং ভারতের লারছেন অ্যান্ড টোব্রো কোম্পানিকে।
দেশে মেট্রোরেলে চড়ার আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির ওপর আলোকপাত করার ইচ্ছা পোষণ করি। আমি আমার স্বচালিত গাড়ি নিয়ে উত্তরা সেক্টর-৪ থেকে সকাল ১০টার দিকে দিয়াবাড়ী স্টেশনে পৌঁছে যাই এবং গাড়ি পার্ক করার সুনির্দিষ্ট কোনো জায়গা না থাকায় স্টেশনের নিচে রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করে লাইনে দাঁড়াই এবং সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে দ্বিতীয়তলায় উঠি।
ভবিষ্যতে মেট্রোরেল সেবা পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু হওয়ার আগে ঢাকার উত্তর প্রান্তের যাত্রীদের জন্য শাটল সেবার পাশাপাশি গাড়ি পার্কিং ও আনুষঙ্গিক নিরাপত্তা সুবিধার ব্যবস্থা করা হলে তা অনেক স্বচালিত গাড়িচালকের কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতে সাশ্রয়ী হবে বলে মনে করি। এ ধরনের ব্যবস্থা অন্যান্য দেশের মেট্রোরেলে রয়েছে। ১ জানুয়ারি বছরের প্রথম দিনে আতশবাজি ও ফানুস উড়িয়ে আনন্দ করতে গিয়ে মেট্রারেলের বৈদ্যুতিক লাইনে আটকে যাওয়া ফানুস সরাতে কয়েক ঘণ্টা দেরি হলেও পরে আমাদের ভ্রমণ অত্যন্ত আনন্দদায়ক হয়।
যাত্রীদের জন্য দ্বিতীয়তলায় মানুষ পরিচালিত টিকিট কাউন্টার ও স্বয়ংক্রিয় টিকিট ভেন্ডিং মেশিন থেকে যাতায়াতের একমুখী টিকিট কেনার ব্যবস্থা আছে। এখানে লক্ষণীয়, মানুষ পরিচালিত টিকিট কাউন্টার সংখ্যায় আর বাড়ানোর দরকার নেই, কিন্তু টিকিট ভেন্ডিং মেশিনের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। এ যুগের ছেলেমেয়েরা নিজেরাই ভেন্ডিং মেশিনে টিকিট কিনতে স্বচ্ছন্দবোধ করবে। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মেট্রোরেল ব্যবহার এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নিরাপত্তা, কারিগরি, কম্পিউটার সিস্টেম ও সফটওয়্যার ব্যবহার এবং এসবের সময়োপযোগী পরিবর্তন ও পরিবর্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিক ‘ব্রেইন ড্রেন’ থেকে মুক্ত করে দেশের আর্থসামাজিক প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও বাস্তবমুখী কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে।
মেট্রোরেল প্রকল্পে আমাদের দেশের অসংখ্য শ্রমিক ও কারিগর অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন এর সিভিল ও বৈদ্যুতিক অবকাঠামো তৈরিতে। এ শ্রমিকশ্রেণির প্রায় কেউই আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ডিগ্রিধারী নন। পরমুখাপেক্ষী, পুথিগত শিক্ষাব্যবস্থার শিকার আমাদের দেশের ছাত্রশ্রেণি ও জনগণ। উন্নত দেশের কারিগরি বিদ্যা ও ব্যাবহারিক জ্ঞান অবশ্যই আমরা গ্রহণ করব ও শিখব, কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজিয়ে এবং ‘প্রযুক্তি স্থানান্তরের’ মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নীতিমালা গ্রহণ করে সরকার গৃহীত সব মেগা প্রকল্পে আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত না করতে পারলে নিকট ভবিষ্যতে এ প্রকল্পগুলোর অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ শুধু ব্যয়বহুল হবে না, বরং তা শ্বেতহস্তীতে রূপান্তর হবে। প্রযুক্তি স্থানান্তরের সঠিক সরকারি নীতিমালার অভাবে আজ আমাদের দেশের মূল্যবান প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন প্রক্রিয়ার কারিগরি দায়িত্ব বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে। একইভাবে আমাদের মোবাইল টেলিফোন সার্ভিস, সেট ও প্রযুক্তির অবকাঠামো সম্পূর্ণভাবে বিদেশি কোম্পানির হাতে, বিদ্যুৎ প্রকল্পের জেনারেটর, ট্র্যান্সফরমার ও আনুষঙ্গিক সব ধরনের যন্ত্রাংশ আমাদের উন্নত দেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
যা হোক, তেতলায় মেট্রোরেলে চড়ার প্ল্যাটফরমে তথ্যসংবলিত বোর্ডগুলো আমাদের সবাইকে মনোযোগ সহকারে পড়ে এর সুযোগ-সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো দেশের প্রগতি সম্ভব নয় বিধায় গণপরিবহণের সুবিধা সবার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়া সরকারের মৌলিক কর্তব্য।
পৃথিবীর অন্যান্য আধুনিক পুঁজিবাদী দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও শহরকেন্দ্রিক। এ প্রক্রিয়ায় রাজধানী ঢাকা সব সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি, এনজিও ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ঢাকা অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় এ শহরে জনসংখ্যা ও যানবাহন সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাধীনতার পরপর সময় উপযোগী সিটি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অনেক কারণেই ব্যাহত ও অপূর্ণ থাকায় ঢাকা শহরের যানবাহন চলাচল ও গণপরিবহণ এক জটিল রূপ ধারণ করেছে। এ অবস্থায় মেট্রোরেল জনমনে ব্যাপক আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। তবে দেশের সভ্য নাগরিক হিসাবে আমাদের সবাইকে এ বিশাল সম্পদ রক্ষায় ও তত্ত্বাবধানে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
বিলম্বিত হলেও বর্তমান সরকার গৃহীত মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে পদ্মা বহুমুখী সেতু ও রেলপথ এক দৃষ্টান্তকারী উদাহরণ স্থাপন করেছে। দুই তলাবিশিষ্ট এ বহুমুখী সেতুর ওপরের তলায় গাড়ি চলাচলের জন্য চার লেনের হাইওয়ে ও নিচতলায় এক ট্র্যাকবিশিষ্ট রেললাইনসংবলিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ জুন উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল (কর্ণফুলী টানেল) চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকে আরও সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে দেশের পর্যটনশিল্পকে বিকশিত করবে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্প হলো ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, যা শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে শুরু করে মহাখালী হয়ে কুতুবখালী, তেজগাঁও হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করবে। এছাড়া মেগা প্রকল্পের আওতায় পৃথিবীর অন্যান্য আধুনিক শহরের মতো প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সাবওয়ে’ নামে নির্মিত হবে পাতাল রেল নেটওয়ার্ক, যা তৈরি করবে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। যদিও ঢাকা সাবওয়ে প্রথমদিকে একটি পৃথক পরিবহণ প্রকল্প নামে শুরু হবে, কিন্তু ভবিষ্যতে ঢাকা মেট্রোরেল ও ঢাকা সাবওয়ে একই ম্যাস ট্র্যানজিট কর্তৃপক্ষের অধীনে আসবে।
আমাদের দেশের মেট্রোরেল এবং এর অবকাঠামো উন্নত অনেক দেশের তুলনায় আধুনিক ও আরামদায়ক বলে মনে করি। অপেক্ষমাণ যাত্রীদের দাঁড়ানোর প্ল্যাটফরম এবং একাধিক স্বয়ংক্রিয় গেটসংবলিত মেট্রোরেলে ঝামেলাবিহীন নিরাপদ আরোহণ ও অত্যন্ত প্রশস্ত কামরা যাত্রীদের জন্য স্বস্তিদায়ক। এছাড়া সমগ্র রেলপথ ওপরে স্থাপিত হওয়ায় পারিপার্শ্বিক সব ধরনের শব্দদূষণ থেকে এটা মুক্ত। উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে এ মেট্রোরেল তৈরি হওয়ায় এর শব্দ উৎপাদনের ক্ষমতা বা ডেসিবেল অনেক কম এবং মানুষের কানের সহন ক্ষমতার মধ্যে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন ছিল একটি আধুনিক রাজধানীর। দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে আজও সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সাধারণ মানুষ তাদের অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর ঢাকা ও অন্যান্য শহরে অপরিসীম যানজট নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে। দেশের নেতাদের কাছে তাদের প্রত্যাশা, তারা এ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেবেন। দেশের সাধারণ মানুষকে মুক্তি ও কল্যাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সবার নৈতিক দায়িত্ব। আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের দেশের এ কষ্টার্জিত স্বাধীনতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশবাসীর সব ধরনের প্রত্যাশা পূরণের সংগ্রামে শামিল হই।
মিফতাহুর রহমান : শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিজ্ঞান ও কারিগরি পরামর্শদাতা
miftahur1710@gmail.com