Logo
Logo
×

বাতায়ন

রেলের মহাপরিকল্পনা কোন পথে

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রেলের মহাপরিকল্পনা কোন পথে

আমাদের দেশের পরিবহণ খাতের প্রধান তিনটি মাধ্যম হলো-সড়কপথ, জলপথ ও রেলপথ। এর বাইরে বিমান পরিবহণ আছে অনুল্লেখযোগ্য পরিমাণে। সড়কপথের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার, যার মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার ব্যবহৃত হয় মহাসড়ক হিসাবে।

আমাদের পরিবহণযোগ্য জলপথের দৈর্ঘ্য বর্ষা মৌসুমে আট হাজার কিলোমিটার হলেও শুকনো মৌসুমে তা সাত হাজার কিলোমিটারের বেশি নয়। সে তুলনায় রেলপথের দৈর্ঘ্য অনেক কম, মাত্র তিন হাজার ৬০০ কিলোমিটার। দেশের সড়কপথের ধারণক্ষমতার চেয়ে পরিবহণের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই জনগণের ভোগান্তির আরেক নাম সড়কপথ। সড়কপথের ভোগান্তি কমানের লক্ষ্যে রেলপথকে সম্প্রসারিত ও অধিকতর কার্যকর করার প্রত্যাশা ও দাবি দীর্ঘদিনের। জনসাধারণের সেই প্রত্যাশাকে নীতিনির্ধারকরা কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। রেলকে দেশের প্রধান পরিবহণ মাধ্যমে পরিণত করতে চায় সরকার। সরকারের এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে ২০১৬ সালে নেওয়া হয় ৩০ বছর মেয়াদি এক মহাপরিকল্পনা। নতুন রেলপথ নির্মাণ, বিদ্যমান রেলপথের সক্ষমতা বৃদ্ধি, নতুন ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিচালন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং রেলওয়ের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের পরিসর বাড়াতে এ মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

এ মহাপরিকল্পনাকে ছয়টি ধাপে বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়েছে এবং পরিকল্পনার মোট ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৫৩ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। উল্লেখিত ৩০ বছরে ২৩০টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ৮৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল। এ ধাপের মেয়াদকাল ২০১৬ থেকে ২০২০; এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা আছে এক লাখ ৪৭ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় ধাপের সময়সীমা ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল। এ পর্বে ৬৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা এবং এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। তৃতীয় ধাপে ৩৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ব্যয় করা হবে ৯৪ হাজার ১৬১ কোটি টাকা, যার মেয়াদকাল হবে ২০২৬ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। মহাপরিকল্পনার চতুর্থ ধাপটি সম্পন্ন হওয়ার কথা ২০৩১ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে। এ পর্বে ৯৬ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হবে ২৩টি উন্নয়ন প্রকল্প। পঞ্চম ধাপের মেয়াদকাল ২০৩৬ থেকে ২০৪০ সাল। এ মেয়াদে শেষ করতে হবে ১৪টি প্রকল্প, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৮২ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। ২০৪১ থেকে ২০৪৫ সালে শেষ হবে এ মহাপরিকল্পনার কাজ। শেষ পর্বের ছয়টি প্রকল্প সম্পন্ন করতে ব্যয় হবে ১২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা।

মহাপরিকল্পনার অবয়ব দেখে আশা করা যেতেই পারে, আগামী দিনগুলোতে পরিবহণ খাতের প্রধান মাধ্যম হবে রেলপথ। আর তা সম্পন্ন হলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি সহনীয় মাত্রায় নেমে আসতে পারে। আমরা আশাবাদী মানুষ। বাস্তবে প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন না দেখলেও আশা করার মধ্যে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তাই রেলের সার্বিক উন্নয়নে গৃহীত ও প্রণয়নকৃত মহাপরিকল্পনায় অনেকটা সংশয় থাকা সত্ত্বেও আমরা সত্যিকার অর্থেই আশাবাদী ছিলাম। তাই মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপের দিকে আমাদের নজর ছিল। প্রথম ধাপের মেয়াদ পেরিয়ে গেছে ২ বছর আগে। ফলাফল আমাদের হতাশ করেছে। প্রথম ধাপে নেওয়া ৮৩টি প্রকল্পের একটিও বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। ২০১৬-২০ মেয়াদের প্রথম ধাপে ৮৩টি প্রকল্পের মধ্যে ১৫টিকে রাখা হয়েছিল ‘উচ্চ প্রাধিকার প্রকল্প’ হিসাবে। এর মধ্যে যমুনা নদীতে স্বতন্ত্র রেলসেতু, আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েল গেজ রেলপথ, বগুড়া-মনসুর আলী ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ এবং কিছু ইঞ্জিন বা লোকোমোটিভ ও কোচ-ওয়াগন সংগ্রহ বাদে ‘উচ্চ প্রাধিকার’ পাওয়া কোনো প্রকল্পই শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ রেলওয়ে। শেষ করা দূরে থাক, ‘উচ্চ প্রাধিকার’ পাওয়া মোট প্রকল্পের মাত্র ৩৩ শতাংশ কেবল শুরু করা গেছে। বাদবাকি যেসব প্রকল্প এখনো শুরু করাই যায়নি, সেগুলোর মধ্যে আছে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে পায়রাবন্দর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ, আখাউড়া-সিলেটের বিদ্যমান মিটারগেজ রেলপথকে ব্রডগেজে রূপান্তর, ঈশ্বরদী-জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুরের মধ্যে দ্বিতীয় রেলপথ নির্মাণ, পার্বতীপুর লোকোমোটিভ কারখানার আধুনিকীকরণ, নারায়ণগঞ্জে একটি লোকোমোটিভ ও একটি ডেমু কারখানা নির্মাণ, নয়টি ডিজেল লোকোশেড পুনর্নির্মাণ, গাজীপুরের ধীরাশ্রমে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো নির্মাণ এবং যশোর-বেনাপোল রেলপথ পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন।

সুতরাং মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপেই আমরা হোঁচট খেয়েছি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রেলের মহাপরিকল্পনা এগোচ্ছে মহা অপরিকল্পিতভাবে। এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হকের ভাষ্য হলো, রেলের মহাপরিকল্পনাটি আর লাইনে নেই। এ পরিকল্পনা লাইনচ্যুত হয়ে গেছে। এর পেছনে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটতির দায় রয়েছে। সবচেয়ে জরুরি ছিল দেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোর সমন্বয় করে এগুলোর বাস্তবায়ন। এ কাজটিই হচ্ছে না। মহাপরিকল্পনার কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে বিক্ষিপ্তভাবে। যে প্রকল্পে অর্থায়ন হচ্ছে, সেটাই করা হচ্ছে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্রমও ঠিক থাকছে না। যে প্রকল্পটি পরে করা দরকার, সেটি আগেই হয়ে যাচ্ছে। আবার আগের প্রকল্পগুলো হচ্ছে না। এ ধরনের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা বেশ সহজ, কিন্তু বাস্তবায়ন অনেক কঠিন। মহাপরিকল্পনা পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন না হলে তার সুফল কিন্তু সাধারণ মানুষ পাবে না।

মহাপরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপের মেয়াদকাল ধরা হয়েছিল ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। সে হিসাবে বাস্তবায়নহীন প্রথম ধাপের সময় শেষ করে দ্বিতীয় ধাপও প্রায় দুবছর শেষ হতে চলল। এটিরও খুব পরিকল্পিত সমাপ্তি ঘটবে বলে মনে হচ্ছে না। এ ধাপের অন্যতম প্রকল্প হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথ। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাইস্পিড ট্রেনের রেলপথ নির্মাণের জন্য ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম ভায়া কুমিল্লা/লাকসাম দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইন’ নামে একটি প্রকল্প এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। অবশ্য সমীক্ষার কাজটি করেছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি চায়না রেলওয়ে ডিজাইন করপোরেশন (সিআরডিসি)। সমীক্ষাটি করতে ব্যয় করা হয়েছে ১১৩ কোটি টাকা। আর রেলপথ নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় এক হাজার ১১০ কোটি ডলার। রেলপথটির নির্মাণকাজ শেষ হলে ঢাকা-চট্টগ্রামের দীর্ঘ ২২৪ কিলোমিটার পথ বিরতিহীনভাবে পাড়ি দেওয়া যাবে মাত্র ৫৫ মিনিটে। আর বিরতি দিয়ে চললে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়া যাবে ৭৩ মিনিটে। এ রেলপথ দিয়ে দৈনিক ৫০ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করতে পারবে।

প্রাথমিক মহাপরিকল্পনার অংশ হিসাবে হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণের কথা ভাবা হলেও এ মুহূর্তে এত ব্যয়বহুল প্রকল্পে হাত দিতে চাইছে না সরকার। তার পরও রেলপথটি নির্মাণ করে দিতে চাইছে সিআরডিসি। তবে শর্ত হিসাবে চাচ্ছে রেলপথটির ৮০ শতাংশ মালিকানা। এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবও পাঠিয়েছে চীনা কোম্পানিটি। রেলপথ মন্ত্রণালয় রেলওয়েকে ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তাবের বিষয়ে মতামত জানাতে বলেছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়কে দেওয়া সিআরডিসির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথের পুরো মালিকানা কখনই পাবে না বাংলাদেশ। রেলপথটি তৈরি করা হবে ‘বিল্ড ওন অপারেট’ বা ‘বিওও’ মডেলে। মডেল অনুযায়ী রেলপথটি নির্মাণের জন্য ‘বাংলাদেশ হাইস্পিড রেলওয়ে লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হবে। রেলপথ নির্মাণ ও পরিচালনার ভার থাকবে এ কোম্পানির হাতেই। কোম্পানিতে ২০ শতাংশ শেয়ার থাকবে বাংলাদেশের। ৮০ শতাংশের মালিক হবে চীন সরকারের অধীন সিআরডিসি। প্রস্তাব অনুযায়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোর নির্মাণের পরবর্তী পাঁচ বছর শতভাগ চীনা কর্মী দিয়ে রেলপথটি পরিচালিত হবে। একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে একদল কর্মীকে চীনে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। রেলপথের ৬ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত নিয়োজিত কর্মীর সংখ্যা বাংলাদেশ-চীন সমান হবে। ১১ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত পরিচালনার কাজে কমপক্ষে ১০ শতাংশ চীনা কর্মী থাকবে এবং ১৬তম বর্ষে গিয়ে শতভাগ বাংলাদেশি কর্মী দিয়ে পরিচালনার কাজ সম্পন্ন করা হবে। প্রকল্পকাজ বাস্তবায়নে কোম্পানিকে কর ছাড় দেওয়ার প্রস্তাবও করা হয়েছে।

সুতরাং কঠিন শর্তের মধ্যে পড়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। যদি শর্ত মেনে প্রকল্পের কাজে হাত দেয় বাংলাদেশ, তাহলেও প্রয়োজন হবে ন্যূনতম ২০ শতাংশ বিনিয়োগের, যার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। আমাদের বর্তমান সংকটকালে এ ধরনের প্রকল্প এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন করা কতটা সমীচীন হবে তা-ও ভাবার বিষয়। তাই রেল নিয়ে মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপের মতো দ্বিতীয় ধাপও অনিশ্চয়তার মধ্যেই কেটে যাবে মনে হয়। আরও রয়েছে চারটি ধাপ। সেগুলোর প্রবাহও যদি একই ধারায় বইতে শুরু করে, তাহলে এ দেশের মানুষ পরিবহণের প্রধান মাধ্যম হিসাবে রেলওয়েকে দেখার স্বাদ ভুলে যেতে হবে।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম