বিপর্যয়ের মুখে প্রকাশনা শিল্প

এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের দেশে নিত্যপণ্যের বাজার এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রকৃত অর্থে এ গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কখনই কার্যকর ছিল না। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি ব্যবসায়ীদের দুর্বিনীত হতে সাহস জুগিয়েছে। বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য দৃশ্যমানভাবেই অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নতি করতে পেরেছে। বৈশ্বিকভাবে করোনা মহামারি না হলে এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও এই সূত্রে বৃহৎ শক্তির অনেকের পক্ষ থেকে নানা ধরনের অবরোধ না থাকলে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা আরও অনেকটা এগিয়ে যেতে পারত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের জন্য একে দুর্ভাগ্যই বলব। ঠিক এ সময়েই নির্বাচনি বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়েছে। বিএনপি নেতাদের সৌভাগ্য বৈশ্বিক সংকটের সূত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানা কথা বলার সুযোগ তারা পেয়ে গেছেন। এ দেশে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষ সাধারণত বিবেক, যুক্তি আর তথ্যসূত্র দিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য বিচার করেন না। একে রাজনীতিতে দেশপ্রেমহীনতার অভাব হিসাবেই মনে করা যেতে পারে। সাধারণ মানুষ অনেকেই রাজনৈতিক নেতাদের মেঠো বক্তৃতায় বিভ্রান্ত হন।
সরকারের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে অনেক সময় একদেশদর্শী বলে মনে হতে পারে। এসব দেখে সেই হঠাৎ ধনী পরিবারের কথা মনে হয়। অর্থবিত্তে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। কিন্তু কোনো সংস্কৃতিচর্চা তেমন নেই। এক পরিচিতজন গৃহকর্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন, তোমার এত সুসজ্জিত ড্রইংরুম রুম, কিন্তু একখানা বইয়ের আলমারি দেখলাম না। প্রত্যুত্তরে গৃহকর্ত্রী বললেন, একখানা বইও আছে-শোকেসের নিচের তাকে দেখতে পাবেন। আমাদের দশাও হয়েছে এমনই। আওয়ামী লীগ সরকার যতটা অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ঝুঁকেছে, শিক্ষা-সংস্কৃতির দিকে ততটা নজর দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। মানুষ খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, বিদ্যুৎ প্রভৃতির প্রত্যক্ষ ভোক্তা বলে এসবের সংকটে যতটা সরব, শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যাপারে ততটা নয়। সরকারপক্ষও তাই মানুষের প্রত্যক্ষ সংকটের প্রতিই নজর দিচ্ছে বেশি। কিন্তু জ্ঞানের পরিচর্যা ছাড়া যে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না, সে ব্যাপারে কোনো মনোযোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এতে একটি শঙ্কা থাকে। বাইরের চাকচিক্যে বোঝা যায় না কাঠামোটির ভেতরের দিক ঘুণে ফাঁপা করে ফেলেছে। হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়লে তখন হায় হায় করে লাভ হবে না। এ কারণে সভ্য দেশগুলো শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চা, গবেষণা ও প্রকাশনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি।
দেশে নিত্যপণ্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটে নাভিশ্বাস ওঠা সাধারণ মানুষকে নিয়েই হয়তো সরকার ব্যস্ত বলে দেশের প্রকাশনা শিল্প যে ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে, সেদিকে দায়িত্বশীলদের দৃষ্টি নেই। সামনে একুশের বইমেলা। এখই পুস্তক মুদ্রণের ব্যস্ত সময়। ঠিক এ সময়ে প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রকাশক, লেখক ও অন্যরা দারুণ হতাশায় নিমজ্জিত; যা কখনো ঘটেনি, এবার তাই ঘটেছে। কাগজ থেকে শুরু করে পুস্তক প্রকাশের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সবকিছুর দাম হঠাৎ বেড়ে মগডালে উঠে গেছে। শুধু দাম বৃদ্ধিই নয়-চাল, ডাল, তেলের অসাধু ব্যবসায়ীদের মতো প্রকাশনা শিল্পসংশ্লিষ্ট অনেক পণ্য বাজার থেকে হাওয়া করে দেওয়া হয়েছে। বই প্রকাশের প্রধান উপাদান কাগজের শুধু লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি ঘটেনি, ঢাকার প্রধান কাগজের বাজার নয়াবাজার থেকে ভালোমানের কাগজ সব উধাও হয়ে গেছে। এমন কৃত্রিম সংকটের ঘটনা আগে কখনো ঘটেছে বলে শুনিনি। তাহলে এখানেও কি সিন্ডিকেট কাজ করছে? এদেরই বা দোষ দিই কেমন করে। ব্যবসার ধর্মই হচ্ছে লাভের দিকে ছুটে চলা। এখানে জনস্বার্থ আর বিবেকের প্রশ্ন তোলা অবান্তর। কাগজ ব্যবসায়ীরা দেখছে বাজারের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই অদৃশ্য, সবকিছু ম্যানেজ করা যায় এদেশে। বাজার যখন অস্থির, তখন মানুষকে যুদ্ধ করে বাঁচতে হচ্ছে; তাদের অসহায় অবস্থায় সরকার পাশে দাঁড়িয়ে খুব সাফল্য দেখাতে পারছে না। ক্ষুধার্ত মানুষ এখন আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কাহিনি শুনতে চায় না। একই সময়ে তারা চারদিকে কোনো কোনো গোষ্ঠীর মানুষের বিত্তবৈভবের কমতি দেখছে না। এতে যে সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের বিরক্তি বাড়ছে, তা সংশ্লিষ্টদের বিবেচনায় আনা উচিত ছিল।
এ অবস্থায় শঙ্কার কারণ হচ্ছে বইমেলার মৌসুমে প্রকাশনা শিল্পের ওপর আঘাত। কাগজের দুষ্প্রাপ্যতা, কালি ও প্লেটের মূল্যবৃদ্ধি, সমানতালে মূল্যবৃদ্ধিতে পিছিয়ে নেই বাঁধাইয়ের কাগজ, বোর্ড প্রভৃতিও। পাশাপাশি বেড়ে যাচ্ছে বাঁধাই খরচও। তাহলে প্রকাশনা শিল্প টিকবে কেমন করে? এমনিতেই আমাদের দেশে বইয়ের বাজার ছোট। মানুষের বই কেনার প্রবণতা বাড়েনি। শিক্ষার্থীরা একটি বই কিনে ২০ জন ফটোকপি করে পড়ে। এর মধ্যে লেখক-প্রকাশকের মাথার ওপর রয়েছে পাইরেসির খড়্গ। রাজধানীর নীলক্ষেতসহ নানা জায়গায় কিছুসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে বই ফটোকপি করে মূল বইয়ের আদলে বিক্রি করে। একাডেমিক বইয়ের ক্ষেত্রে এ ঘটনা বেশি ঘটছে। আগে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটত। এখন বাজারে মূল বই থাকার পরও পাইরেসি হচ্ছে। আইন অনুযায়ী, এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু শাস্তি কার্যকর করতে ভূমিকা রাখবে কে? শক্তিশালী বইদস্যুরা ক্ষমতাবান। প্রকাশকদের অভিজ্ঞতা, পুলিশ তাদের ম্যানেজ করা। তাই অভিযোগ দায়ের করেও লাভ হয় না। ফলে হতাশ হয়ে অনেকেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আর ক্রেতাও তেমন! ২০-৩০ টাকা কম পেয়ে একটি মূল বই না কিনে ফটোকপি বই কিনে নিচ্ছে।
বই কেনার ব্যাপারে কিছুসংখ্যক ক্রেতার মনোভাব লক্ষ করে অবাক হতে হয়। হয়তো ফ্যামিলির তিনজন এই মাত্র পিৎজা ও কফি খেয়ে নামলেন ২০০০ টাকা বিল পরিশোধ করে। বইয়ের দোকানে এসে বা বইমেলায় গিয়ে নেড়েচেড়ে একটি বই পছন্দ করলেন-গায়ের দাম পাঁচশ টাকা; কমিশনের পর দিতে হবে চারশ বা সাড়ে তিনশ টাকা। তারা বইটি কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে বলবেন, বইয়ের এত দাম! এ কথা বলে বই রেখে চলে যাবেন। এমন বাস্তবতায় বই বিক্রির যুদ্ধে যখন প্রকাশকরা, তখন প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে মূল্যবৃদ্ধির কারণে ৫০০ টাকার বই যখন ৭০০ টাকা হয়ে যাবে, তখন ভয়ানক ক্রেতাসংকটে পড়বেন প্রকাশকরা। এভাবে অনেকেরই প্রকাশনা শিল্পে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
আমাদের প্রকাশনা ক্ষেত্রে সংকটের বিষয়টি পুরোনো। তাই অনেক বছর আগে থেকেই সরকার প্রকাশকদের কিছুটা প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজেক্ট, বিভিন্ন লাইব্রেরি-এসব প্রতিষ্ঠানে অর্থ বরাদ্দ থাকে। প্রকাশকরা শর্ত অনুযায়ী বই জমা দেন। এভাবে নির্বাচিত বইয়ের বেশ কিছুসংখ্যক কপি সরকারি প্রতিষ্ঠান কিনে নেয়। কিন্তু প্রকল্প চালু হওয়ার কয়েক বছর পর দেখা গেল বেশ প্রভাবশালী কোনো কোনো লেখক প্রভাব খাটিয়ে বাজেটের বড় অংশের টাকায় নিজেদের বই ঢুকিয়ে দিতে থাকেন। কোনো কোনো বুদ্ধিমান প্রকাশক সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে অর্থ ছড়িয়ে নিজেদের বইয়ের অনুমোদন করিয়ে নেন। এর মধ্যে নতুন উপদ্রব শুরু হয়। রাজনৈতিক সখ্যের সুবাদে প্রভাবশালী প্রকাশকদের একটি গ্রুপ নিজেদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বই দিয়ে বরাদ্দ অর্থের বেশির ভাগ নিজেরাই হজম করতে শুরু করেন। আর এসব পন্থা যারা অবলম্বন করতে পারেন না, সেসব প্রকাশকের কাছে নিবেদিত ও খ্যাতিমান লেখকদের মানসম্মত বই থাকলেও তারা বঞ্চিত হন। এমন এক বাস্তবতায় কোনো কোনো বুদ্ধিমান প্রকাশক আরেকটি অভিনব উপায় বের করেন; প্রভাবশালীদের লেখক বানাতে থাকেন। প্রতি বইমেলায় সাড়ম্বরে এমন লেখকের বই প্রকাশিত হতে দেখি। প্রভাবশালীদের প্রভাবে তাদের বই সরকারি ক্রয়ের তালিকায় ঢুকিয়ে অধিকাংশ বাজেটই গ্রাস করে ফেলা হয়। এভাবে শুভ ইচ্ছা নিয়ে সরকারি প্রণোদনা খুব একটা সাফল্য লাভ করতে পারছে না। একজন আমাকে বলেছিলেন, সরকারসংশ্লিষ্ট কারও বই প্রণোদনার টাকায় কেনা যাবে না-এমন সিদ্ধান্ত এলে এসব লেখকের লেখা সম্ভবত বন্ধ হয়ে যাবে। আমি একমত হতে পারিনি। বলেছি, অমন নিষেধাজ্ঞা এলে প্রভাবশালীদের বই প্রকাশ পেতে থাকবে তাদের স্বজনের নামে।
ছোট প্রকাশকদের দুর্দশার কথা না হয় বাদ দিলাম। এমন বাস্তবতায় সুস্থ প্রকাশনায় যুক্ত বনেদি বড় প্রকাশকরাও মহাদুশ্চিন্তায় পড়েছেন। দুশ্চিন্তা হবে না কেন। আমি এ সময়ে কাগজের বাজারের একটি মূল্যতালিকা জোগাড় করতে পেরেছি। যেখানে অফসেট মাল্টি কালার ৫৫ গ্রাম ডি/ডি ২৩ দ্ধ ৩৬ ইঞ্চি কাগজের প্রতি রিম কিছুদিন আগেও ছিল ১,৭০০ টাকা আর এখন ১,৮২০ টাকা, ৭০ গ্রাম ডি/ডি ২৩ দ্ধ ৩৬ ইঞ্চি অফসেট কাগজের প্রতি রিম কিছুদিন আগেও ছিল ১,০০০ টাকা আর এখন ২,৮৫০ টাকা, ৮০ গ্রাম ডি/ডি ২৩ দ্ধ ৩৬ ইঞ্চি অফসেট কাগজের প্রতি রিম কিছুদিন আগেও ছিল ১,৯০০ টাকা আর এখন ৩,৪০০ টাকা। এভাবে সব ধরনের অফসেট ও আর্ট পেপারের মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। শুধু বৃদ্ধি নয়, বাজারে পাওয়াই যাচ্ছে না। মুদ্রণের এক অপরিহার্য উপকরণ প্লেট। বাজারে এরও কৃত্রিম সংকট শুরু হয়েছে। ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে এই উপকরণটিরও।
এমন বাস্তবতায় সরকারকে আগে সিদ্ধান্তে আসতে হবে এ দেশে মানসম্মত পুস্তক প্রকাশের প্রয়োজন আছে কি না। শুভ ইচ্ছা থাকলে বইমেলার প্রস্তুতির এ কঠিন সময়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে রাখা প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপকরণ বের করে আনতে হবে। সুষ্ঠু মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এবং প্রয়োজনে আমদানির দরজা খুলে বাজারকে স্বাভাবিক রাখার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com