Logo
Logo
×

বাতায়ন

মিয়ানমারের চালাকিটা বুঝতে হবে

Icon

ড. মো. ফখরুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মিয়ানমারের চালাকিটা বুঝতে হবে

পাঁচ বছরেরও বেশি সময় আগে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। শুরুতে তারা সংখ্যায় ছিল নগণ্য। কিন্তু কিছু দিন পর থেকেই রাখাইন রাজ্যে (আরাকান) তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হতে থাকে।

নির্যাতন ও নৃশংসভাবে মৃত্যুর ভয়ে ভিটামাটি ছেড়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে বাঁচার আশায় বাংলাদেশ সীমান্তে জড়ো হয় তারা। একপর্যায়ে সব বাধা অতিক্রম করে নাফ নদী ও সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে আমাদের ভূমিতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। তখন অনেকে তাদের ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বা জনমিতিক সুবিধা মনে করে স্বাগত জানালেও পরে তাদের ভুল ভাঙতে থাকে।

দেখতে দেখতে বাংলাদেশে আগমনের পাঁচ বছর অতিক্রম করে ফেলেছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। এখনো কোনো না কোনোভাবে সুযোগ পেলে সীমান্ত অতিক্রম করে আমাদের ভূখণ্ডে চলে আসছে তারা। তার ওপর যারা ক্যাম্পে বসতি গড়ে অবস্থান করছেন, তাদের পরিবার থেকে প্রতিবছর নতুন মুখ জন্ম নিয়ে দিন দিন বেড়ে চলেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা।

পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর ২০ থেকে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে ক্যাম্পগুলোতে। গত পাঁচ বছরে আড়াই লাখ নতুন রোহিঙ্গা শিশু যুক্ত হয়েছে আগের ঢুকে পড়া দশ লাখ শরণার্থীর সঙ্গে। এখনো দিনে-রাতে নদী ও সমুদ্রপথে চোরাচালানিদের সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এর ওপর রাখাইন রাজ্যে শুরু হয়েছে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি নামক বিদ্রোহীরা বেশ কিছু দিন ধরে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় অনবরত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

এ যুদ্ধের প্রভাব এসে পড়ছে বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে। এ কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজ করছে এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ।

ঘুমধুম উপজেলার সীমান্তবর্তী মানুষ ভীষণভাবে আতঙ্কগ্রস্ত। তাদের চোখে ঘুম নেই। তারা মর্টার শেলের শব্দে রাতে ঘুমাতে পারছেন না। মৃত্যুভয়ে অনেকে কলেমা পড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। দিনের বেলায় মর্টার শেল এসে আছড়ে পড়ছে কোনো কোনো জায়গায়। কক্সবাজারের সীমান্তে নতুন করে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সেখানেও মানুষ ঘরের বাইরে যেতে চাচ্ছেন না। গরু চরাতে বা ধানক্ষেতে যেতে পারছেন না।

এমন ভীতিকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি মোতায়েন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে যুদ্ধ লাগার উসকানিতে বাংলাদেশ পা দেবে না বলে সরকারি ভাষ্যে বলা হয়েছে। কারণ, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়ার পাঁয়তারায় এ আচরণ করছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলে বহু দিন ধরে লবিং করে আসছে, যাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। এ সময় যুদ্ধ শুরু করা এ প্রক্রিয়া বন্ধ করার শামিল। তবে মিয়ানমার আসলে রোহিঙ্গাদের আরাকানে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কতটুকু আগ্রহী, তা অনুধাবন করা বেশ জটিল। কারণ চীনের সঙ্গে তাদের গাঁটছড়া রয়েছে।

মিয়ানমার পশ্চিমে তাদের সীমান্ত খুলে রেখেছে-যেটা বাংলাদেশের দিকে। গুলি, মর্টার, হেলিকপ্টারের চক্কর-সবকিছুই বাংলাদেশের দিকে হচ্ছে। এটাও একটা চক্রান্ত। কারণ, উত্তরে মিয়ানমার আর্মি, দক্ষিণে আরাকান আর্মির অবস্থান। বাংলাদেশে মর্টারের আঘাত আরাকান আর্মির কাজ বলে মিয়ানমার যে দাবি করে দূতাবাসের মাধ্যমে জানাচ্ছে, তা সঠিক নয়। আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ হলে গুলি বা মর্টার পশ্চিমে বাংলাদেশের দিকে আসার কথা নয়। বরং মিয়ানমারের এ তৎপরতা আরও বেশি করে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে বাংলাদেশের দিকে ধাবমান করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য যেসব বিদেশি জ্যাক ব্যবহার করা হচ্ছে, তারা খুবই দুর্বল অথবা আমাদের জন্য ততটা ফলদায়ক ভূমিকা পালনে তৎপর নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সেসব প্রচেষ্টার কর্ণধারদের এক কথায় বলা যায় ‘জ্যাক অফ অল ট্রেড, মাস্টার অফ নান’।

এসব জ্যাক দিয়ে আমাদের দেশের মর্যাদা বাড়ছে না। নিজেদের মৌলিকত্ব দিয়ে প্রতিবাদ করতে না পারলে সেটা কার্যকর ও টেকসই করা দুষ্কর। গোটা পৃথিবী এখন জোটের নামে কথা বিক্রির রাজনীতিতে নেমে পড়েছে এবং তাই সেগুলোর অসারতা প্রমাণিত হচ্ছে। এ সবকিছু দীর্ঘদিন ধরে ঢিলেঢালাভাবে চলতে থাকায় সারা বিশ্বের বড় সমস্যাগুলো দিন দিন আরও জটিল রূপ পরিগ্রহ করে চলেছে। আন্তর্জাতিকভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দীর্ঘসূত্রতা এমন একটি উদাহরণ।

২.

যুদ্ধ কখনোই ভালো নয়। কিন্তু যুদ্ধাবস্থা তৈরি হতে দেওয়াটা আরও খারাপ। আমরা আমাদের অভ্যন্তরে ও বাইরে ক্রমাগত যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে অশান্তির দিকে ধাবিত হচ্ছি। যুদ্ধ লাগাতে হয় না, হঠাৎ করেই লেগে যায়। তাই এ নিয়ে দ্রুত ভাববার অবকাশ রয়েছে। হাতিকে হাতি দিয়ে ধরতে হয়। গলায় বুনো ওল কচুর চুলকানি থামাতে বাঘা তেঁতুলের বিকল্প নেই। দুষ্টের প্রতি শিষ্টাচার দেখালে সে প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভেবে আরও বেপরোয়াভাবে দুষ্টুমি করতে শুরু করে।

রোহিঙ্গারা আমাদের ‘কোর ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট’ বা মূল জনমিতিক লভ্যাংশ হতে পারেনি, হয়তো পারবেও না। কারণ তারা উদ্বাস্তু, ভিনদেশি নাগরিক এবং বিচ্ছিন্নতা পছন্দ করে। আমরা মানবিক কারণে তাদের একসময় বরণ করে বাহবা নিলেও এখন এ ঢিলে বোঝা পাহাড়সম ভারী হয়ে বিপদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের জন্য আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে। আর এখন প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রকৃত যুদ্ধাবস্থার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অথচ শুরুতেই এটা এড়ানো যেত।

এ সমস্যা বুঝিয়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের বোঝাটা আসলে খুব বেশি ভারী। মিয়ানমারে পরাশক্তি সমর্থিত সামরিক জান্তা ক্ষমতায় থাকায় শুধু দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সুদূরপরাহত। যতদিন এ সমস্যাকে ভিন্ন পরাশক্তির সমর্থন নিয়ে শক্ত হাতে মোকাবিলা করা না হবে, ততদিন সমস্যাটি কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকবে বলেই মনে হয়।

ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

fakrul@ru.ac.bd

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম