স্বদেশ ভাবনা
আইনের শাসনের বৈশ্বিক সূচকে আমাদের অবনমন কেন
আবদুল লতিফ মণ্ডল
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ২৬ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি) ‘Rule of Law Index 2022’ বা আইনের শাসন সূচক-২০২২ প্রকাশ করেছে। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনের শাসন কীভাবে কাজ করে এবং এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা কী, তা বুঝতে ১৪০টি দেশের এক লাখ ৫০ হাজার খানা (household) এবং তিন হাজার ৬০০ আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে আইনের সূচক ২০২২ তৈরি করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
উল্লেখ্য, সংস্থাটি ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আইনের শাসনের এ সূচক প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী আইনের শাসন সূচক-২০২২-এর প্রতিবেদনে যেসব তথ্য ও ফাইন্ডিংস এসেছে, তা পর্যালোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
আইনের শাসনকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘আইনের শাসন রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিবিশেষ, যেখানে সরকারের সব ক্রিয়াকর্ম আইনের অধীনে পরিচালিত হয় এবং যেখানে আইনের স্থান সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ব্যবহারিক ভাষায় আইনের শাসনের অর্থ হলো, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার সর্বদা আইন অনুযায়ী কাজ করবে, যার ফলে রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিকের কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সে তার প্রতিকার পাবে। মোট কথা, আইনের শাসন তখনই বিদ্যমান থাকে, যখন সরকারি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অনুশীলন সাধারণ আদালতের পর্যালোচনাধীন থাকে, যে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার সব নাগরিকের সমান।’ আইনের শাসনের চারটি মূলনীতি হলো-ক. দায়বদ্ধতা : সরকারি, বেসরকারি উভয় খাতের আইনের নিকট দায়বদ্ধ থাকা; খ. ন্যায়ভিত্তিক আইন : প্রণীত আইন হবে স্বচ্ছ, গণমাধ্যমে প্রকাশের মাধ্যমে যা জনগণের গোচরে আনতে হবে। আইন মানুষের জীবন ও ধনসম্পদ ও মৌলিক অধিকার রক্ষা করবে; গ. উন্মুক্ত সরকার ব্যবস্থা : যে পদ্ধতিতে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হবে, তা হবে সহজগম্য, সুষ্ঠু ও দক্ষ; ঘ. নিরপেক্ষভাবে বিরোধ মেটানো : দক্ষ, নীতিবান ও স্বাধীন প্রতিনিধির মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি।
আটটি ফ্যাক্টর বা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আইনের শাসন সূচক-২০২২ তৈরি করা হয়েছে। এগুলো হলো-সরকারি ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা (constraints on government powers), দুর্নীতির অনুপস্থিতি (absence of corruption), উন্মুক্ত সরকারব্যবস্থা (open government), মৌলিক অধিকার (fundamental rights), শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা (order and security), আইন প্রয়োগ (regulatory enforcement), দেওয়ানি বিচার (civil justice) এবং ফৌজদারি বিচার (criminal justice)।
সূচকে সর্বোচ্চ স্কোর ১ এবং সর্বোচ্চ স্কোরকারী দেশ আইনের প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রদর্শনকারী হিসাবে বিবেচিত। কোনো দেশের স্কোর কমে যাওয়ার অর্থ হলো সে দেশের আইনের শাসনের অবনতি। এবারের সূচকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে (সবার উপরে) থাকা পাঁচটি দেশের মধ্যে ডেনমার্ক ০.৯০ স্কোর করে সূচকের শীর্ষে রয়েছে। এরপর নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও নেদারল্যান্ডস যথাক্রমে ০.৮৯, ০.৮৭, ০.৮৬, ০.৮৩ স্কোর করে সূচকে যথাক্রমে ২, ৩, ৪ ও ৫ অবস্থানে রয়েছে। সূচকে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে (সবার নিচে) থাকা পাঁচটি দেশ হলো-ভেনিজুয়েলা, কম্বোডিয়া, আফগানিস্তান, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো ও হাইতি। এদের স্কোর হলো যথাক্রমে ০.২৬, ০.৩১, ০.৩৩, ০.৩৪ ও ০.৩৫।
আইনের শাসন সূচক-২০২২ যেসব গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-এক. একাধিক্রমে পাঁচ বছর ধরে বিশ্বে আইনের শাসনের অবনতি ঘটেছে। জরিপে অন্তর্ভুক্ত ৬১ শতাংশ দেশে আইনের শাসন হ্রাস পেয়েছে। দুই. কোভিড-১৯-এর আগে পরিলক্ষিত কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা আইনের শাসনের ধীরে ধীরে অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। তিন. নির্বাহী ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাচ্ছে। চার. দুই-তৃতীয়াংশ দেশে মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন বৃদ্ধি পেয়েছে। পাঁচ. সূচকভুক্ত ৫৮ শতাংশ দেশে কর্তৃত্ববাদবিরোধী শক্তির অবনতি ঘটেছে। ছয়. দীর্ঘসূত্রতা, আইন প্রয়োগে দুর্বলতা ও বৈষম্যের কারণে ৬১ শতাংশ দেশে দেওয়ানি বিচারের অবনমন হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। বাংলাদেশ ১-এর মধ্যে ০.৩৯ স্কোর করে বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচকে ১৪০টি দেশের মধ্যে ১২৭তম স্থানে রয়েছে। গত বছরের সূচকে ০.৪০ স্কোর নিয়ে ১৩৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৪তম। এর অর্থ দাঁড়ায়-এ বছর আইনের শাসনে বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ছয় দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থানে রয়েছে নেপাল; দেশটির বৈশ্বিক সূচকে অবস্থান ৬৯তম। দ্বিতীয় অবস্থানে শ্রীলংকা। সূচকে দেশটির অবস্থান ৭৪তম। সূচকে ভারতের অবস্থান ৭৭তম। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১২৯ ও ১৩৮তম।
সূচক তৈরিতে ব্যবহৃত ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে ‘সরকারি ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা’য় বাংলাদেশের স্কোর ০.৩৮, যা গতবার ছিল ০.৩৭। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা ভালো করেছে। ‘দুর্নীতির অনুপস্থিতি’তে স্কোর ০.৩৪, যা গতবার ছিল ০.৩৫। এক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। চারটি সাব-ফ্যাক্টর-সরকারি তথ্য, তথ্য অধিকার, নাগরিক অংশগ্রহণ এবং অভিযোগ দায়ের প্রক্রিয়া নিয়ে গঠিত ‘উন্মুক্ত সরকার’ ফ্যাক্টরে এবারের স্কোর ০.৪১, যা গতবারের চেয়ে ০.১ কম। এক্ষেত্রেও অবনতি ঘটেছে। ‘মৌলিক অধিকারে’ স্কোর ০.৩০, যা গতবার ছিল ০.৩১। অবনতি হয়েছে এক্ষেত্রে। কার্যকরভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, নাগরিক সংঘাত নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তিতে মানুষের সহিংসতার আশ্রয় না নেওয়া সাব-সেক্টরগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ‘শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা’য় বাংলাদেশ সর্বোচ্চ স্কোর করেছে। এ ফ্যাক্টরটিতে স্কোর ০.৬৩, যা গতবারের সমান। ‘আইনের প্রয়োগ’ ফ্যাক্টরে গতবারের মতো এবারও স্কোর ০.৪০। ‘দেওয়ানি বিচার’ ফ্যাক্টরে স্কোর ০.৩৭, যা গতবার ছিল ০.৩৮। অবনতি হয়েছে এক্ষেত্রে। ‘ফৌজদারি বিচারে’ স্কোর ০.৩১, যা গতবারের চেয়ে ০.১ কম। এক্ষেত্রেও অবনতি হয়েছে। অর্থাৎ আটটি ফ্যাক্টরের মধ্যে পাঁচটিতে অবনতি হয়েছে, দুটিতে অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে এবং একটিতে উন্নতি হয়েছে।
যেসব ফ্যাক্টরে অবনতি হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। ‘দুর্নীতির অনুপস্থিতি’ ফ্যাক্টরে বাংলাদেশ গতবারের তুলনায় এক ধাপ পিছিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর সারিতে রয়েছে। দুর্নীতির জন্য চিহ্নিত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-ক. সরকারি প্রভাবের কারণে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের বিচারকাজ বিলম্বিত হওয়া; খ. রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দুর্নীতির চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করা; গ. নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ না হওয়া; ঘ. দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় ইতস্ততা। আর দুর্নীতির নাটকে যারা কুশীলব তারা হলেন-ক. রাজনীতিক, খ. সরকারি কর্মচারী, গ. বেসরকারি খাত, বিশেষ করে ব্যবসায়ী। উচ্চমাত্রার দুর্নীতি হ্রাসে ব্যর্থতা দেশকে বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচকে তলানিতে নিয়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ।
উন্মুক্ত বা স্বচ্ছ সরকার ধারণাটি বিস্তৃত হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। এ ব্যবস্থায় জনসাধারণের তদারকি করার জন্য নাগরিকদের সরকারের নথি ও কার্যবিধিতে প্রবেশ করার অধিকার রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দেশে তথ্য অধিকার আইন প্রণীত হলেও সরকারি গোপন আইন ১৯২৩, সাক্ষ্য আইন ১৮৭২, সচিবালয় নির্দেশমালা ২০১৪ ইত্যাদি সরকারি অফিসের তথ্য প্রকাশে বাধা হয়েই রয়েছে। উল্লেখ্য, সরকারি অফিসে গোপনীয়তা ও অস্বচ্ছতা দুর্নীতির প্রসার ঘটায়।
মৌলিক অধিকারের স্কোরে গতবারের তুলনায় বাংলাদেশের এক ধাপ অবনতি হয়েছে। দেশে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। সংবিধান মানুষের জানমাল রক্ষার নিশ্চয়তা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা ও সংগঠনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিলেও বিভিন্নভাবে এগুলোর কার্যকারিতা বহুলাংশে খর্ব করা হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে গণমাধ্যম কর্মী ও মুক্তচিন্তার মানুষ হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের পক্ষে জয় ছিনিয়ে আনা হচ্ছে। জনগণ ভোট প্রদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচার উভয় ক্ষেত্রে স্কোরে এক ধাপ করে অবনতি হয়েছে। বিচারব্যবস্থায় মামলাজট ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা জনগণের বিচার লাভের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা ‘Justice delayed is justice denied’ প্রবচনের বাস্তব প্রকাশ। তাছাড়া বিচারপ্রার্থীরা আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিচারব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতা বৈশ্বিক আইনের শাসনের সূচকে দেশের পেছনে পড়ার অন্যতম একটি কারণ।
সবশেষে বলতে চাই, বৈশ্বিক আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশের অনেকটা তলানিতে অবস্থানের জন্য যেসব কারণ দায়ী, সেগুলোর দূরীকরণে ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে সূচকে আমাদের অবস্থান সম্মানজনক পর্যায়ে পৌঁছে। আমরা যেন আইনের শাসনে বৈশ্বিক সূচকে প্রথম সারির দেশগুলোর কাতারে শামিল হতে পারি-এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com