Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

বোরোতে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া জরুরি

Icon

আবদুল লতিফ মণ্ডল

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বোরোতে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া জরুরি

কৃষি খাতে (শস্য উপখাত, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য উপখাত এবং বন উপখাত নিয়ে গঠিত) প্রবৃদ্ধি হার ক্রমাগত নিম্নমুখী হওয়ার প্রভাব পড়েছে শস্য উপখাতের, বিশেষ করে উপখাতটির প্রধান ফসল এবং আমাদের প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদনের ওপর।

এবার বোরো ও আউশ ফসলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বোরো মৌসুমে হাওড়াঞ্চলে তিন দফা বন্যার কারণে বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয়। জুনে উপকূল ও উত্তরাঞ্চলে হঠাৎ অতিবৃষ্টির কারণেও মাঠে পাকা ফসল নষ্ট হয়। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, বোরোতে লক্ষ্যমাত্রার (২.৯ কোটি টন) চেয়ে ১৩ লাখ টম ফলন কম হয়েছে। বন্যার কারণে আউশ উৎপাদন কম হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২৭ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আউশের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৫০ হাজার টনে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সাড়ে ছয় লাখ টন কম উৎপাদন হয়েছে। বোরো ও আউশের উৎপাদন কম হওয়ায় এবং যথাসময়ে প্রয়োজনীয় চাল আমদানি না হওয়ায় দেশে দেখা দিয়েছে চাল সংকট। দেশের বাজারে সব শ্রেণির চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে।

দীর্ঘ খরা ও অপ্রতুল বৃষ্টিপাতের কারণে চলতি মৌসুমে আমনের ফলন লক্ষ্যমাত্রা চেয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে আগামী দিনে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ সংকট যথাসম্ভব এড়াতে আমাদের সব দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে আসন্ন বোরোতে, যা দেশে চাল উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে। আগামী মৌসুমে বোরোর এযাবৎকালের সর্বোচ্চ উৎপাদনকে পেছনে ফেলতে আমাদের কী করা দরকার, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

সরকারি তথ্য মোতাবেক, ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫৫ শতাংশ। এরপর প্রবৃদ্ধি হারে নিম্নমুখিতা দেখা দেয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বিগত ১০ বছরে কৃষি খাতে ৩.৭ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।’ ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা বিবিএসের সাময়িক প্রাক্কলন অনুযায়ী হ্রাস পেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২.২০ শতাংশে দাঁড়াবে। এটি সম্ভবত গত কয়েক বছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হারের সর্বনিম্ন রেকর্ড। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে শস্য উপখাতের প্রধান ফসল চাল উৎপাদনের ওপর। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও অন্যান্য রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছর বাদ দিলে ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হার নেতিবাচক থেকে ১.৩০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের (২০২০ সালে ১.৩৭ শতাংশ) চেয়ে কম হারে বেড়েছে চালের উৎপাদন। ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত পাঁচ বছরে দেশে যখন জনসংখ্যা বেড়েছে ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ, তখন খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ।

এর ফলে বেড়েছে চাল আমদানির পরিমাণ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২০২১ বাণিজ্য বছরে (মে-এপ্রিল) বাংলাদেশ ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে। চলতি অর্থবছরে সরকার ১৯ লাখ টন চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে সরকারি খাতে ৯ লাখ টন এবং বেসরকারি খাতে ১০ লাখ টন। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গমের কমবেশি ৭০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে দেশে গম উৎপাদনের পরিমাণ ১১-১২ লাখ টন। অর্থাৎ গমের ক্ষেত্রে আমরা প্রায় পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছি। এত বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য (চাল, গম) আমদানি দেশের দুষ্প্রাপ্য বৈদেশিক মুদ্রার ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে।

এই যখন অবস্থা, তখন ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দা ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২০২৩ সালে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। আগামী বছর বিশ্বে ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা (এফএও) বলেছে, খাবারের অভাব এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শুধু যে দুর্ভিক্ষই হবে তা নয়, বরং এর জেরে বিভিন্ন দেশে বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, করোনা মহামারি, সংঘর্ষ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০১৯ সালের পর বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে সাড়ে ৩৪ কোটি ছাড়িয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, করোনা মহামারি শুরুর আগে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ছিল সাড়ে ১৩ কোটি। এরপর এ সংখ্যা বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও সংঘর্ষের ফলে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। পরিবেশগত সমস্যার প্রভাবে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা খাদ্য ঘাটতি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এমন সম্ভাব্য দুর্যোগময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চার দফা সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো-উৎপাদন ও বাণিজ্য বাড়াতে সহায়তা করা, স্বচ্ছতার উন্নয়ন, উদ্ভাবন ও যৌথ পরিকল্পনা নিশ্চিত করা এবং খাদ্যব্যবস্থার রূপান্তরে বিনিয়োগ বাড়ানো।

সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কালো থাবা থেকে যথাসম্ভব রেহাই পেতে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে। দেশের কমবেশি ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য হলো চাল থেকে তৈরি ভাত। মাথাপিছু মোট ক্যালরির প্রায় ৭০ শতাংশ আসে ভাত থেকে। অতিদরিদ্র্য, দরিদ্র্য ও নিম্নবিত্তের মানুষ কচুঘেঁচু দিয়ে দুই বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারলে তাদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা ও পুষ্টিহীনতার সমস্যা অনেকটা কমে যাবে।

সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ যথাসম্ভব এড়াতে আমাদের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমের অংশ হিসাবে আমাদের প্রথমে আসন্ন বোরো মৌসুমে সর্বোচ্চ পরিমাণ ফলন নিশ্চিত করার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। কারণ দেশের প্রধান খাদ্য চালের সর্বোচ্চ জোগান দেয় বোরো। তাই দৃষ্টি রাখতে হবে যেন মনুষ্যসৃষ্ট কোনো সংকট বোরো আবাদে সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে। ধান উৎপাদনে রাসায়নিক সার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশে সারের কোনো অভাব নেই বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও চলতি আমন মৌসুমে সার সংকটের খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা বার্ষিক ৬০ লাখ টনেরও বেশি। এর প্রায় ৮০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। আমদানিকৃত রাসায়নিক সারের অন্যতম হিসাবে বিবেচিত হয় চারটি-ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি), ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ও মিউরেট অব পটাশ (এমওপি)।

বোরো মৌসুম শুরুর আগেই রসায়নিক সারের প্রয়োজনীয় মজুত গড়ে তুলতে হবে। শুধু সারের মজুত গড়ে তুললে হবে না, নির্ধারিত দামে কৃষক পর্যায়ে রাসায়নিক সারের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক ডিলারের সার কারসাজির খবর পত্রপত্রিকায় অহরহ প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয়ত, বোরো সেচনির্ভর ফসল হওয়ায় সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। চলমান বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে দেখা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীর মতে, বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সমাধানে ধৈর্য ধরা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বোরো চাষে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রগুলোয় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে আবাসিক বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিতে হবে। তৃতীয়ত, চালসহ কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য চলতি বাজেটে যেসব ভর্তুকি, প্রণোদনা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর পরিমাণ বৃদ্ধি বিবেচনা করতে হবে।

চতুর্থত, কৃষক যেন বোরো ধান বিক্রি করার সময় ন্যায্যমূল্য পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাদির মধ্যে রয়েছে-ক. চালের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। ভারত ও চীনের তুলনায় আমাদের হেক্টরপ্রতি চালের উৎপাদন কম। জমি স্বল্পতার কারণে আমাদের চালসহ খাদ্যশস্যের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। খ. চালসহ কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যাওয়া যথাসম্ভব বন্ধ করতে হবে। গ. চালসহ কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে, কৃষি খাতে বিনিয়োগ শিল্প-বাণিজ্য খাতে বিনিয়োগের চেয়ে কম লাভবান নয়।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু দীর্ঘস্থায়ী হবে না, বরং তা ভয়াবহ রূপ নেবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্তমানে বৈরী আবহাওয়ার কারণে চাল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) এক সাম্প্রতিক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারতের চাল রপ্তানি এ বছর কমে অর্ধেকে নেমে আসতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য চাল রপ্তানিকারক দেশও চাল রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলতে পারে।

সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের মতো চাল আমদানিকারক দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে শুধু আকাশছোঁয়া দামে চাল কিনতে হবে না, বরং আমদানির জন্য চাল পাওয়া নিয়ে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার বছরে চাল আমদানিতে বাংলাদেশকে এ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তাই আগামী বছরের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কবল থেকে যথাসম্ভব রক্ষা পেতে চাল উৎপাদনে শীর্ষে থাকা বোরো ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের রেকর্ড ফলন পেতে আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম