Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের অবনমন

Icon

আবদুল লতিফ মণ্ডল

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২২, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের অবনমন

গত ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত হয়েছে ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই)-২০২২’, যা আমাদের কাছে বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক নামেও পরিচিত। আয়ারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও জার্মানির ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে যৌথভাবে জিএইচআই-২০২২ প্রকাশ করেছে।

বিশ্বের ১২১টি দেশের তথ্য এতে স্থান পেয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘The Global Hunger Index (GHI) is a tool designed to comprehensively measure and track hunger at global, regional, and national levels’, যার অর্থ দাঁড়ায়, জিএইচআই’র মাধ্যমে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে ক্ষুধা পরিমাপ করা হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা পরিস্থিতি নিয়ে জিএইচআই ২০২২-এ যেসব তথ্য ও ফাইন্ডিংস এসেছে, তা পর্যালোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক নির্ধারণে চারটি মাপকাঠি ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো হলো-এক. অপুষ্টির হার, দুই. পাঁচ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে উচ্চতার তুলনায় কম ওজনের শিশুর হার, তিন. পাঁচ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে কম উচ্চতার শিশুর হার, এবং চার. পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর হার। ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের স্কোর নির্ধারণ করা হয়। ক্ষুধার তীব্রতা নির্ধারণে পাঁচটি লেভেল বা স্তর রয়েছে। স্তরগুলো হচ্ছে-নিম্ন (low), মাঝারি (moderate), গুরুতর (serious), ভয়ঙ্কর (alarming) এবং অতি ভয়ঙ্কর (extremely alarming)। ৯.৯ বা তার নিচের স্কোর অর্থ ক্ষুধার তীব্রতা নিম্ন পর্যায়ে। আর ১০-১৯.৯, ২০-৩৪.৯, ৩৫-৪৯.৯, ৫০ বা তার বেশি স্কোর বলতে যথাক্রমে মাঝারি, গুরুতর, ভয়ঙ্কর ও অতি ভয়ঙ্কর ক্ষুধার তীব্রতাকে বোঝায়। সূচকে সবচেয়ে ভালো স্কোর হলো শূন্য। স্কোর বাড়ার অর্থ হলো, সেই দেশের ক্ষুধা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর স্কোর কমে যাওয়ার অর্থ হলো, সেই দেশের খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এবারের সূচকে ৫-এর নিচে স্কোর পেয়ে সবচেয়ে ভালো অর্থাৎ শীর্ষ অবস্থানে থাকা ১৭ দেশ হলো-বেলারুশ, হার্জেগোভিনা, চিলি, চীন, ক্রোয়েশিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, কুয়েত, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মন্টিনিগ্রো, নর্থ মেসিডোনিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়া, স্লোভাকিয়া, তুরস্ক ও উরুগুয়ে। আর সূচকের তালিকায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে অর্থাৎ সবচেয়ে নিচে থাকা দেশগুলো হচ্ছে-সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া, বুরুন্ডি, ইয়েমেন, সেন্ট্রাল আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, মাদাগাস্কার, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো ও চাদ।

জিএইচআই-২০২২ যেসব গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-ক. সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই অনেকটা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এর পেছনে সম্ভাব্য কারণগুলো হচ্ছে-বিভিন্ন দেশের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনীতিতে কোভিড-১৯-এর ক্ষতিকর প্রভাব এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি ও সারের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে এবং ২০২৩ সালে ক্ষুধা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। খ. সূচক অনুযায়ী বর্তমানে ৪৪টি দেশে ক্ষুধার মাত্রা ‘গুরুতর’ বা ‘ভয়ঙ্কর’ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং বিশেষ ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এসব দেশে ক্ষুধা হ্রাস করে ২০৩০ সালের মধ্যে তা নিম্নস্তরে আনা সম্ভব হবে না। গ. ন্যায়সংগত, অংশগ্রহণমূলক এবং টেকসই খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে এখনই পুনর্নির্মাণ করতে হবে। ঘ. দেশে দেশে, অঞ্চলে অঞ্চলে এবং সম্প্রদায়ে সম্প্র্রদায়ে বিরাজমান বৈষম্য ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’-এসডিজির এ লক্ষ্য অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাঁচটি আন্তর্জাতিক সংস্থা-জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রধানরা সম্প্রতি এক যৌথ সতর্কবার্তায় বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা, খাদ্যের উৎপাদন হ্রাস, পরিবহণ ব্যবস্থায় বিঘ্নসহ নানা কারণে আগামীতে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট আরও তীব্র হবে। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকবে। এতে মানুষের মধ্যে পুষ্টির সংকট আরও প্রকট হবে, যা বিশ্বের একটি অংশকে মহামারির দিকে নিয়ে যাবে। এমন সম্ভাব্য দুর্যোগময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তারা চার দফা সুপারিশ করেছেন। এগুলো হলো-উৎপাদন ও বাণিজ্য বাড়াতে সহায়তা করা, স্বচ্ছতার উন্নয়ন, উদ্ভাবন এবং যৌথ পরিকল্পনা নিশ্চিত করা এবং খাদ্যব্যবস্থার রূপান্তরে বিনিয়োগ বাড়ানো। এর আগে গত জুলাইয়ের শেষদিকে ডব্লিউএফপি জানিয়েছিল, করোনা মহামারি, সংঘর্ষ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০১৯ সালের পর বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে সাড়ে ৩৪ কোটি ছাড়িয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, করোনা মহামারি শুরুর আগে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ছিল সাড়ে ১৩ কোটি। এরপর এ সংখ্যা বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও সংঘর্ষের ফলে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। পরিবেশগত সমস্যার প্রভাবে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা খাদ্য ঘাটতি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী পুষ্টিহীনতা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২২-এ ১২১টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। ২০২১, ২০২০, ২০১৯ ও ২০১৮ সালের সূচকে অবস্থান ছিল যথাক্রমে ৭৬, ৭৫, ৮৮ ও ৮৬তম। এর অর্থ দাঁড়ায়, গতবারের তুলনায় এবার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান আট ধাপ পিছিয়েছে। ১৯.৬ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ কোনোরকমে ‘মাঝারি ক্ষুধার’ স্তরে অবস্থান ধরে রেখেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান (৯৯), ভারত (১০৭) ও আফগানিস্তানের (১০৯) চেয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। তালিকায় পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ৯৯, ১০৭ ও ১০৯তম। তবে শ্রীলংকা (৬৪) ও নেপালের (৮১) অবস্থান বাংলাদেশের উপরে। তাছাড়া তালিকায় আফ্রিকার কয়েকটি দেশ-তিউনিসিয়া, মরক্কো, ঘানা, সেনেগাল, গ্যাবন, মিশর, নামিবিয়া, ক্যামেরুনের অবস্থান বাংলাদেশের উপরে।

আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) আর্থিক সহায়তায় এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) যৌথ উদ্যোগে তৈরি ও প্রকাশিত বাংলাদেশ আন্ডারনিউট্রিশন ম্যাপ বা অপুষ্টি মানচিত্র ২০১৪-এর ফাইন্ডিংসের মধ্যে রয়েছে-ক. গত দুই দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় উন্নতি সাধন হলেও, দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে এলেও প্রধান খাদ্য চালে স্বনির্ভরতা অর্জনে প্রায় সক্ষম হলেও, জন্ম হার ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেলেও, শিক্ষার হার বেড়ে গেলেও পুষ্টির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। আর ‘দ্য স্টেট অব ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০১৯’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ছয়জনের একজন অপুষ্টিতে ভুগছেন।

২০১৪ সালে প্রকাশিত দারিদ্র্য মানচিত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট ৬৪টি জেলার ৩৯টিতে পাঁচ বছর বয়সের নিচে খর্বাকৃতি শিশুর এবং ৫৫টি জেলায় পাঁচ বছর বয়সের নিচে কম ওজনের শিশুর হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ছিল। ইউনিসেফের সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, খর্বাকৃতি শিশুর হার ২০১৩ সালের ৪২ শতাংশ থেকে ২০১৯-এ ২৮ শতাংশে নেমে আসে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম ওজনের শিশু বলতে জন্মের সময় আড়াই কেজির কম ওজনকে বোঝায়। আর এ কম ওজন হওয়ার পেছনে রয়েছে গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের অভাব, অল্প বয়সে সন্তান ধারণ, একাধিক গর্ভধারণ, বিভিন্ন রোগব্যাধি, যেমন-ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ম্যালেরিয়া, আয়োডিনের অভাব ইত্যাদি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০০০ সালে এটা ছিল ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০১৯ সালের মধ্যে ২২ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসে। তবে কোভিডকালে স্বল্প ওজনের শিশুর হার ৬ দশমিক ৪ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশে। পাঁচ বছর বয়সের কম শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৩৮ জনে দাঁড়িয়েছে। আর ২০২০ সালে প্রতি হাজার জীবিত জন্মে শিশু মৃত্যুর হার দাঁড়ায় ২১ জনে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২২)।

বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক ২০২১-এর তুলনায় ২০২২-এর সূচকে বাংলাদেশের আট ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার কারণগুলো সরকারকে অনুসন্ধান করতে হবে এবং সেগুলো নিরসনে পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক নির্ধারণে ব্যবহৃত মাপকাঠিগুলোর কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা অগ্রগতি সাধিত হলেও এগুলোর আন্তর্জাতিক মান থেকে আমরা অনেক দূরে আছি। আমাদের লক্ষ্য হবে ক্ষুধার মাঝারি স্তর থেকে ক্ষুধার নিম্নস্তরে শামিল হওয়া।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম