স্বদেশ ভাবনা
সংঘাত কি অনিবার্য?
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ৩০ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বাংলার মাটিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ছাড়া কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না।
আওয়ামী লীগ পরপর তিনবার জনগণের ভোট চুরি করে, দিনের ভোট রাতে করে ক্ষমতায় এসেছে। জনগণের দাবি ও আন্দোলনের মুখে সংসদ ভেঙে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে এবং সেই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের জবাবে তাকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১ অক্টোবর দলের এক কর্মসূচি পালনকালে বলেছেন, ‘নির্বাচন যদি প্রতিহত করতে আসেন, সারা দেশের জনগণ প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে দেবে। ছাড়া হবে না। নির্বাচন হবে, সংবিধানে যেমন আছে, তেমনই হবে।’
সংবিধান অনুযায়ী ২০২৩ সালের শেষ সপ্তাহে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে, বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে এখন মুখোমুখি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। বিএনপির দাবি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন। এ দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলন করতে বিএনপি সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে। আর সরকারি দল আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। এ অবস্থায় যে প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবে উঠতে পারে তা হলো, দেশ কি ১৯৯০, ১৯৯৪-১৯৯৫, ২০০৬, ২০১৩ বা ২০১৫ সালের মতো রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে?
অতীতের দিকে তাকালে দেখতে পাই, দেশে নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এবং নির্বাচনের ওপর মানুষের অবিশ্বাস চরমে পৌঁছায় ‘স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সব বিরোধী রাজনৈতিক দল একযোগে একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি নিয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়’। আন্দোলনের ফলে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সরকারের পতন ঘটে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে। এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া হাত মেলালেও ওই সরকারের পতনের পর তাদের মধ্যকার পুরোনো শত্রুতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে এবং ১৯৯৪ সালে মাগুরার একটি উপনির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ সংসদ বর্জন ও সংসদ থেকে পদত্যাগ ছাড়াও ১৭৩ দিন হরতাল পালন করে।
আওয়ামী লীগের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে সংবিধান সংশোধনের (ত্রয়োদশ সংশোধন) মাধ্যমে বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালের মার্চে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ১৯৯৬ সালের জুন, ২০০১ সালের অক্টোবর এবং ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনগুলো অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হওয়ায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়।
পরবর্তী সময়ে সংবিধানের তৎকালীন বিধান অনুযায়ী, অষ্টম জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে মেনে নিতে আওয়ামী লীগের আপত্তির কারণে বিএনপি সরকার এ পদে নিয়োগে অন্য ‘অপশনগুলো’ বাদ দিয়ে তাদের মনোনয়নে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে নিজ দায়িত্বসহ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য চাপ দেয়। ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজ দায়িত্বসহ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল প্রথমে তাকে মেনে নিলেও একপর্যায়ে তার বিরুদ্ধে বিএনপির প্রতি আনুগত্যের অভিযোগ এনে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে তাকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদত্যাগ করে এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকেন। এ সরকার দুবছর ক্ষমতায় থাকে।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ায় পর দুবছর যেতে না যেতেই আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধনের (পঞ্চদশ সংশোধন) মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের বিরোধিতা করে এবং তা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি দশম সংসদ নির্বাচন (জানুয়ারি ২০১৪) বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়।
৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল ৮টি দল নির্বাচন বর্জন করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং গুটিকয়েক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে সংসদের মোট আসনের ৫০ শতাংশের বেশি আসনে অর্থাৎ ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য নির্বাচিত হন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় এ নির্বাচন দেশে-বিদেশে সমালোচিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটা উপলব্ধি করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরদিন অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিলেও পরবর্তী সময়ে তিনি তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে বিএনপি ২০১৫ সালের জানুয়ারি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। টানা দুই মাসের আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিলে শতাধিক তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব ক্ষেত্রে। শুরুর দুই মাস পর স্থগিত করা হয় এ আন্দোলন।
নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন আগে বিএনপি প্রভাবিত নবগঠিত জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ক্ষমতসীন দল আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানে সমঝোতা হয়। নির্বাচনের দুমাস আগে ১ নভেম্বর ২০১৮ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত এ সংলাপে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। বৈঠকে ঐক্যফ্রন্ট উত্থাপিত দাবিগুলোর সমাধান না পাওয়া গেলেও সরকারি দল থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়-সভা, সমাবেশ অনুষ্ঠান ও মতপ্রকাশে কোনো বাধা দেওয়া হবে না এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা হবে। তবে এ আশ্বাস শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ঐক্যফ্রন্টের, বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক, হয়রানি অব্যাহত থাকে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতে নেওয়া হয় না কোনো পদক্ষেপ। নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগটি হলো-নির্বাচনের নির্ধারিত দিনের আগের রাতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ব্যালট বাক্সে ভোট প্রদান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও ভোটগ্রহণে দায়িত্বপ্রাপ্ত মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এটি সংঘটিত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপির মনে দৃঢ়বিশ্বাস জন্মেছে যে, কেবল নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। গত দুই বছর ধরে দলটি কোনো উপনির্বাচন বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ে দলটি যুগপৎ আন্দোলন করতে সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, কয়েকটি দল ইতোমধ্যে বিএনপির প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছে।
উপরের বর্ণনার মধ্য দিয়ে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, আগেকার রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো চলমান অস্থিরতাও দেশকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যাবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ সংঘাত কি অনিবার্য? আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো কি সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে পারে না? এজন্য যা দরকার তা হলো সমঝোতার মনোভাব। আলোচনার টেবিলেই এ সমঝোতা আসতে পারে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেই এ সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com