ডলারের দামবৃদ্ধি ও রিজার্ভ হ্রাস একটি বৈশ্বিক প্রবণতা
মো. সাইফুল ইসলাম
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির সূচকগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া একটি সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। কেবল ডলারের বিপরীতে টাকার মান যে কমেছে এমন নয়-পাউন্ড, ইউরো, ইয়েন, ইউয়ান ও সুইস ফ্রাঁর মতো বহুলপ্রচলিত ও শক্তিশালী মুদ্র্রার মানও কমে গেছে। গত ২০ বছরের মধ্যে ডলারের মান এখনই সবচেয়ে বেশি। দি ইউএস ডলার ইনডেক্স অনুযায়ী, ডলারের বিপরীতে জাপানি ইয়েনের মান কমেছে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, ব্রিটিশ পাউন্ড ও ইউরোর দাম কমেছে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে, সুইস ফ্রাঁর মান কমেছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ আর চীনের মুদ্রা ইউয়ানের অবমূল্যায়ন ঘটেছে সাড়ে ৩ শতাংশ। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রেও একই চিত্র লক্ষণীয়। জুলাইয়ে ভারতের বৈদেশিক মুদ্র্রার রিজার্ভ ৫৯৬ থেকে কমে ৫৭২ বিলিয়নে নেমে এসেছে, যা গত বিশ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। জুনে তুরস্কের রিজার্ভ কমে গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে আসে। জুনে ডলারের বিপরীতে পেসোর (ফিলিপাইনের মুদ্রা) দাম কমে যাওয়ায় ফিলিপাইনের রিজার্ভ কমে ১০১ বিলিয়িনে নেমে আসে, যা গত ২১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। চীন ও জাপানের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশেরও রিজার্ভ কমেছে।
এ অবস্থায় খুঁজে বের করার দরকার কেন ডলারের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। বৈশ্বিক অতিমারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি, বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা, মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন এবং ডলারের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম থাকায় বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং ডলারের দামে পরিবর্তন এসেছে। এর কয়েকটি কারণ দেখানো যায়। প্রথমত, আপাতদৃষ্টিতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসাবে মূল্যস্ফীতি ও চাহিদা-জোগানের পরিবর্তনকে বিবেচনা করলেও এর শুরুটা বৈশ্বিক অতিমারি থেকে। বৈশ্বিক অতিমারির ফলে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটা, পণ্য পরিবহণে অতিরিক্ত জাহাজ ভাড়ার কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়া এবং সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। দ্বিতীয়ত, পরবর্তী সময়ে জ্বালানি সংকট ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এ সমস্যাকে আরও জটিল করে দেয়। তৃতীয় কারণ হলো, উচ্চ মূল্যস্ফীতি। অতিমারির সমস্যা থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে যে বিপুল আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছিল উন্নত দেশগুলো, তার জেরে চাহিদার সূচক অনেকটাই উপরে উঠে যায়। চলমান মূল্যস্ফীতির প্রাথমিক কারণ এটাই। সঙ্গে যোগ হয় ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সরবরাহ সংকট। এবারের মূল্যস্ফীতি ঠিক চাহিদাজনিত নয়, বরং সরবরাহব্যবস্থার সংকটজনিত। সেজন্য মূল্যস্ফীতির হার কমছে না। অধিকন্তু বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়া, পরিবহণ ব্যয়বৃদ্ধি এবং মুদ্রার বিনিময়মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয়বহুল হচ্ছে; যার ফলাফল উচ্চ মূল্যস্ফীতি। আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ চিত্রটি বৈশ্বিক। শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয়ও মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। ২০২২ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, তুরস্ক, চীন ও ভারতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৮.৬, ৯.১০, ৮.১০, ৭.৭০, ৭৮.৬, ৫.৮ ও ৭.০১ শতাংশ। একই সময়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৫৬ শতাংশ। অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার কম ছিল। চতুর্থ কারণটি হলো, বৈশ্বিক নীতি সুদহার বৃদ্ধি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলো নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। প্রায় সব বড় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত কয়েক মাসে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। কিন্তু উন্নত দেশে নীতি সুদহার বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। জুনে যুক্তরাজ্য নীতি সুদহার বাড়িয়েছে ১.২৫ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ১.৫০-১.৭৫ শতাংশ, কানাডা ১.৫০ শতাংশ। কিন্তু এ নীতি সুদহার বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। যেহেতু উন্নত দেশগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে নীতি সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে দিচ্ছে, তাই আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে এর প্রভাব পড়ছে এবং ডলারের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময়ে ‘ফ্লোয়েটিং এক্সচেঞ্জ রেটে’র প্রচলন থাকায় এর নেতিবাচক প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতি। এছাড়া নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে ট্রেজারি বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বড় বিনিয়োগকারীরা উন্নয়নশীল দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মুদ্রা হিসাবে ডলারের সংকট তৈরি হচ্ছে, ডলারের বিনিময়মূল্য বাড়ছে এবং দেশে দেশে স্থানীয় মুদ্রার দরপতন হচ্ছে।
অনেকে রিজার্ভ হ্রাস এবং ডলারের দামবৃদ্ধির এ প্রবণতাকে শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বলে বিবেচনা করছে; অথচ এর কারণটি স্থানীয় নয়, বৈশ্বিক। এটি কেন শুধু বাংলাদেশের একপাক্ষিক নীতির ফলাফল নয় এবং কেন এটি বৈশ্বিক-সেটির কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত, বৈশ্বিক মুদ্রাব্যবস্থায় ‘ফ্লোয়েটিং এক্সচেঞ্জ রেটের’ প্রচলন থাকায় বহুলপ্রচলিত মুদ্রার বাজারে বিনিময়ের হেরফের হলে এর প্রভাব এসে পড়ে তুলনামূলকভাবে কম শক্তিশালী মুদ্রার ওপর। আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে ডলারের দামবৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারির প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং এর ঠিক পরেই ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়া, দ্রব্যমূল্যের দামবৃদ্ধিসহ জ্বালানি তেলের সংকটে ‘ব্যালেন্স অব ট্রেড’ এবং ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টে’র ভারসাম্যহীনতা আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে। এ কারণে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় মেটাতে অধিক ডলার খরচের ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। অধিকন্তু, আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রার দামবৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারেও এর দাম বেড়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, বৈশ্বিক অর্থনীতির এহেন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক উন্নত ও দাতা দেশ তাদের আমদানির হার কমিয়েছে। একই সঙ্গে তারা বিনিয়োগে নিরুৎসাহ দেখাচ্ছে এবং অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সহায়তার হার কমিয়েছে। এর প্রভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর রপ্তানি কমছে এবং গচ্ছিত রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। চতুর্থত, বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত স্বার্থ বিবেচনায় ‘মুদ্রা কূটনীতি’ এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রসঙ্গটিকেও বিবেচনা করা যেতে পারে। ১৯৭০-এর দশকে বৈশ্বিক মুদ্রাব্যবস্থায় সংস্কার আনার পর থেকে জাতীয় স্বার্থে মুদ্রা কূটনীতির ব্যবহার দেখা যায়। আশির দশকে চিলির অর্থনৈতিক সংকট, ১৯৯৭ সালে এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকট এবং ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার ক্ষেত্রে মুদ্রা কূটনীতি এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রভাব লক্ষণীয়।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ওপর পড়ছে। এর ফলে ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। তবে সরকার, বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির জন্য ডলার বিক্রি কমিয়ে দেওয়া, দৈনিক ডলার বিক্রির হার অর্ধেকে আনা, আমদানি ৬ শতাংশ কমানো এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ১.৪ বিলিয়ন ঋণপ্রাপ্তির ফলে এ মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে স্থিতিশীল হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ থাকলে অর্থনীতিতে সেটা কোনো বিপৎসংকেত দেয় না। প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন, বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে বাংলাদেশ ছয় থেকে নয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম হবে। তিনি বলেছেন, ‘যে কোনো সংকটের সময় অন্তত তিন মাসের জন্য খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য (প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র) আমদানি করার জন্য আমাদের হাতে টাকা আছে। আমাদের এখন যে রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে কেবল তিন মাস নয়; আমরা ছয় থেকে নয় মাসের জন্য খাদ্য আমদানি করতে সক্ষম হব।’ অধিকন্তু, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং পূর্বপ্রস্তুতির জন্য বাংলাদেশ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিদ্যুতের সময়সূচি ধরে লোডশেডিং করাসহ সাশ্রয়ী বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যাতে জ্বালানি আমদানির খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। উন্নয়নমূলক ব্যয় সংকোচন ও কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে সরকারি ব্যয় কমাতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
দুঃখের বিষয় হলো, বৈশ্বিক এ সংকটকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার একটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অর্থাৎ এ সংকটটিকে শুধু বাংলাদেশের সংকট হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থনীতির এ সাময়িক সংকটকে ঘিরে সমস্যার অতিরঞ্জন আর অপপ্রচার কাম্য নয়। যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস ও ডলারের দামবৃদ্ধি একটি বৈশ্বিক প্রবণতা এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা, তাই বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। বরং আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এবং অর্থনীতির প্রচলিত মানদণ্ডে বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত শক্ত অবস্থানে আছে। এ অবস্থায় সমস্যার অতিরঞ্জন ও অপপ্রচার থেকে দূরে থেকে আগামীর চালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন এবং অর্থনৈতিক সংকটকে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক কিংবা ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে রাখা উচিত। ভবিষ্যতের কথা ভেবে কৃচ্ছ্রসাধন এবং জাতীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে মনোযোগী হওয়া দরকার। একই সঙ্গে অতিরঞ্জন ও অপপ্রচারের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকা উচিত।
মো. সাইফুল ইসলাম : গবেষক, দ্য কেআরএফ সেন্টার ফর বাংলাদেশ অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স (সিবিজিএ)