মিঠে কড়া সংলাপ
বেপরোয়া ড্রাইভিং, ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং আমাদের সড়কযাত্রা
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের দেশে যারা সড়কপথে চলাচল করেন, বলা চলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা তা করে থাকেন। ইদানীং এ ঝুঁকির পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে। দিন দিন সারা দেশে যেভাবে, যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে তাতে ঘর থেকে বের হয়ে এক স্থান হতে অন্য স্থানে বা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত করতে হলে বিপদ যে নিত্যসঙ্গী তা বলাই বাহুল্য।
কারণ প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় দশ-বিশজন করে হতাহত হচ্ছেন। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসব হতাহতের জন্য বেপরোয়া ড্রাইভিং, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সহীন ড্রাইভার, ত্রুটিপূর্ণ রাস্তা, সড়কপথে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ইত্যাদি দায়ী। বিশেষ করে বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের কারণে দেশে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটাসহ হাজার হাজার মানুষ আহত হয়ে থাকেন। আমার নিজ জেলার এমপি রফিকুল ইসলাম বকুল যমুনা সেতুর পশ্চিম পারে বাস দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন, অপর আরেকজন এমপি ওয়াজিউদ্দিন খানের মাইক্রোবাসের সঙ্গে একটি বাস এসে সংঘর্ষ ঘটালে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনিও একটি পা হারিয়ে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকার পর ইন্তেকাল করেন।
শেষোক্ত ব্যক্তি বাংলাদেশ পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তাই বলছিলাম, চলাচলের ক্ষেত্রে দেশের জনপথকে জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করেই আমাদের সবাইকে চলাফেরা করতে হয়। তবে আমাদের সবাইকে বলতে দেশের সব মানুষকেও আবার এভাবে চলাফেরা করতে হয় না। বর্তমান অবস্থায় হাতেগোনা কিছু মানুষ এদেশে হেলিকপ্টারও ব্যবহার করেন; আবার কিছু মানুষ যিনি বা যারা মন্ত্রী-মিনিস্টার এবং ভিআইপি তাদের সামনে-পেছনে পাইলট কার ছোটাছুটি করে বিধায় সেসব ভাগ্যবানদেরও আমাদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় সড়কপথে চলাচল করতে হয় না।
তবে এসব ব্যতিক্রম বাদ দিলে দেশের সব মানুষকেই সড়কপথে ভয়ে ভয়ে পথ চলতে হয়। কারণ কখন কোথা থেকে দৈত্যাকার আকৃতির বাস-ট্রাকের ধাক্কায় কার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে আমরা কেউ তা জানি না। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত ছোটখাটো যানবাহনকে যেভাবে দৈত্যাকার বাস-ট্রাকগুলো তেড়ে ধরে পিষে মারে, সে দৃশ্য অত্যন্ত ভয়ংকর। যিনি বা যারা সেসব দৃশ্য দেখেছেন বা দেখার পর যারা বেঁচে আছেন, শুধু তারাই তার ভয়াবহতা জানেন; অন্য কেউ নন। আর এসব ভয়াবহ ঘটনা ঘটানোর ক্ষেত্রে বাসচালকরাই যে চ্যাম্পিয়ন, সে কথাটিও সত্য।
আমাদের দেশের বাসচালকরা জোর যার মুল্লুক তার নীতি প্রয়োগ করে সড়কপথে বাস চালিয়ে থাকেন। এ বিষয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল রোডে সংঘটিত আমার দেখা একটি ঘটনার বর্ণনা দিলে অত্যন্ত ভয়ংকর একটি দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে। বুঝতে পারা যাবে একশ্রেণির বাসচালক কতটা বেপরোয়া, কতটা ভয়ংকর; কতটা মারাত্মক! টাঙ্গাইলের বাইপাস রোডে ঘটে যাওয়া সেদিনের সে দৃশ্য মনে পড়লে ভয়ে আজও আমার গা শিউরে ওঠে! ঘটনাটি হলো-একটি বাস রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করানোর ফলে তার পেছনে কালো রঙের একটি প্রাইভেটকারও দাঁড়ানো ছিল।
এ অবস্থায় বিপরীত দিক থেকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আসা হানিফ পরিবহণের একটি বাস নিজ লাইন ছেড়ে উলটো পথে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াতে ডানদিকের রাস্তার শোলডারে (রাস্তাসংলগ্ন পতিত ভূমি) গিয়েও গতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে আবার রাস্তায় উঠতে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটির পেছনে দাঁড়ানো প্রাইভেটকারটির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটানোর পর বাসটি থামলে প্রাইভেটকারটির সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। সে অবস্থায় প্রাইভেটকারের চালকসহ যাত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও ভয়ে তারা থরথর করে কাঁপতে থাকলে আশপাশের লোকজন তাদের বের করে আনেন।
অতঃপর জড়ো হওয়া লোকজন দুর্ঘটনা ঘটানো বাসটি আটক করলে বাসের ড্রাইভার এসে প্রাইভেটকারের চালকের উদ্দেশে ‘ঠিকমতো গাড়ি না চালানোর’ উলটো অপবাদ দিলে, সেদিনের সেই বাসচালককে আমার কাছে পৃথিবীর জঘন্যতম মানুষ, ঘৃণ্যতম অপরাধী বলে মনে হয়েছিল। যা হোক, প্রাইভেটকারের যাত্রী এবং চালক চোখে-মুখে পানি নিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে পুলিশের খোঁজ করলে উপস্থিত লোকজন জানালেন, এখানে পুলিশ পাওয়া যাবে না। তবে তাদের মধ্যে একজন নিজেকে পরিবহণ শ্রমিক নেতা পরিচয় দিয়ে বাসের ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে বললেন, তিনি সবকিছু দেখেছেন। অতঃপর তিনি প্রাইভেটকারের মালিককে ক্ষতিপূরণ দিতে বলায়, তিনি তা গ্রহণে অস্বীকার করে আবারও পুলিশের খোঁজ করলে, এ পর্যায়ে শ্রমিক নেতা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘যান তাহলে পুলিশের কাছেই যান!’
হাইওয়েতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার একটি নিখুঁত চিত্র তুলে ধরতেই এখানে আমি সেদিনের ঘটনাটির অবতারণা করলাম। আর ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমাদের দেশের হাইওয়েতে দুরবিন দিয়ে খুঁজে পুলিশ না পাওয়া গেলেও পরিবহণ শ্রমিক নেতাদের ঠিকই পাওয়া যায়। কারণ পুলিশের চেয়ে পরিবহণ শ্রমিক নেতাদের সিন্ডিকেট অনেক বেশি শক্তিশালী। ফলে পুলিশকে তারা ভয় তো পায়ই না বরং একশ্রেণির পুলিশ তাদের কাছ থেকে মাসোয়ারা আদায় করেন বলেও শুনতে পাওয়া যায়।
তা ছাড়া রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যেও বাস-ট্রাক চালকদের কাছ থেকে পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ টাকা আদায় করে থাকেন। আর টাকা গ্রহণের সেসব দৃশ্যও বিভিন্ন মাধ্যমে দেখতে পাওয়া যায়। এ কথাটিও এখানে বলার কারণ হলো, এক শ্রেণির পুলিশের দুর্বলতাও রাস্তাঘাটে বাস-ট্রাক চালকদের দৌরাত্ম্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া বিআরটিএ কর্তৃক ফিটনেসবিহীন গাড়িকে ফিটনেস দেওয়া, গাড়ি চালানোর জন্য অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে লাইসেন্স দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ও রাস্তাঘাটে নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য দায়ী।
মোটকথা, ড্রাইভার নামধারী একশ্রেণির ব্যক্তি দিনের পর দিন যেভাবে সড়ক-মহাসড়কে মানুষের প্রাণ সংহার করে চলেছে, সেজন্য পুলিশ, বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ এবং পরিবহণ শ্রমিক নেতারাও দায়ী। আর এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। একের দোষ অন্যের কাঁধে চাপানোর নীতি পরিহার করে আন্তরিকতার সঙ্গে সবাই মিলে কাজ করলে ড্রাইভার নামধারী এসব ব্যক্তির হাত থেকে দেশের মানুষের প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে করি। অযোগ্য ব্যক্তিকে লাইসেন্স না দিলে, রাস্তাঘাটে ঘুস আদায় না করলে, অপরাধী ড্রাইভারকে ছাড়িয়ে নিতে পরিবহণ শ্রমিক নেতারা তৎপরতা বন্ধ করলেই দেখা যাবে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার হার বহুলাংশে কমে এসেছে।
পরিশেষে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কিছু পরামর্শ উপস্থাপন করেই আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই। ১. অবিলম্বে সারা দেশের হাইওয়ের সম্পূর্ণ অংশে ডিভাইডার দেওয়া প্রয়োজন। কারণ ডিভাইডার থাকলে বাস-ট্রাকসহ যে কোনো যানবাহন নিজ লাইন ছেড়ে বিপরীত লাইনে ঢুকে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটাতে পারবে না। ২. রাস্তার যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানো-নামানো বন্ধ করতে হবে। এজন্য রাস্তার সাইড লাইনে স্পেস তৈরি করে একমাত্র সেখানেই বাস থামানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর হাইওয়ে পুলিশকে বিষয়টি তদারকির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। যত্রতত্র বাস-ট্রাক থামালে যেমন তাদের মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা করতে হবে, তেমনি পুলিশ প্রশাসনকেও এ বিষয়ে তৎপর হতে হবে। কারণ ঘুস গ্রহণের মাধ্যমে কাউকে ছেড়ে দিলে বাস-ট্রাক থামানোর জন্য নির্দিষ্ট স্থান করে দিলেও কোনো লাভ হবে না। নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে জরিমানার অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিলে হাইওয়েতে বাস-ট্রাক চলাচলের অনিয়মের একটি চিত্রও ফুটে উঠবে!
৩. হাইওয়েতে যত বেশি সম্ভব সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে স্পিড মিটার লাগিয়ে গাড়ি চলাচলের অনিয়ম চিহ্নিত করে দোষী ড্রাইভারদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ৪. হাইওয়ে পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়ে ঘুস আদায় নয়, জরিমানা আদায় করতে হবে। রাস্তায় একেকটি হাইওয়েতে বিট বসিয়ে কয়েকটি মোটরসাইকেলের মাধ্যমে টহল জোরদার করতে হবে। ৫. রাস্তার একটি নির্দিষ্ট দূরবর্তী স্থানে হাইওয়ে পুলিশের মোবাইল ফোন নাম্বার সংবলিত সাইনবোর্ড লাগাতে হবে। ৬. রাস্তার মোড়ে মোড়ে পরিবহণ শ্রমিকদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। ৭. বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ যাতে ফিটনেসবিহীন গাড়িকে ফিটনেস না দেয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি পাওয়া গেলে পুলিশ প্রশাসন যেন সঙ্গে সঙ্গে তা জব্দ করে সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের গাড়ি ঘুস গ্রহণের মাধ্যমে কেউ ছেড়ে দিলে তাকেও কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
৮. রাস্তার ধারে বা রাস্তাসংলগ্ন বাজারঘাট উচ্ছেদ করতে হবে। সড়ক বিভাগের রাস্তাসংলগ্ন জমিতে কেউ যাতে দোকানপাট বসাতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভাগীয়-উপবিভাগীয় প্রকৌশলীকে শুধু টেন্ডারের দিকে চোখ না রেখে এ বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। আর যদি কেউ তার এলাকার রাস্তার পাশের জমি দখলমুক্ত করতে ব্যর্থ হন, সেক্ষেত্রে তাকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
জানি না আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ রাস্তাঘাটে বেপরোয়া ড্রাইভিং, ফিটনেসবিহীন গাড়ির হাত থেকে কবে রক্ষা পাবেন, রাস্তাঘাটে চলাচলে কবে নিরাপদ সড়ক পাবেন, আর আমাদের সড়কযাত্রাই বা কবে দুশ্চিন্তামুক্ত হবে, পরিবারের একজন সদস্য কোথাও যাত্রা করলে গন্তব্যে না পৌঁছা পর্যন্ত অন্য সদস্যরা কবে কিভাবে অশান্তি কাটিয়ে উঠবেন। তবে বিআরটিএ, পুলিশ প্রশাসন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, পরিবহণ শ্রমিক নেতা সবাই মিলে সে বিষয়টি ভেবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলেই এ প্রশ্নের জবাব মিলবে।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট