আশেপাশে চারপাশে
স্থায়ীভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পিত ড্রেজিং জরুরি
চপল বাশার
প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সিলেট-সুনামগঞ্জ তথা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে বন্যার পানি প্রায় পুরোটাই নেমে গেছে। কোথাও কোথাও অবশ্য নিুাঞ্চল এখনো পানির তলে। মে মাসের মাঝামাঝি যে বন্যার শুরু, তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে এবার স্মরণকালের সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেই বৃষ্টির পানি সরাসরি নেমে এসেছে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, ভাসিয়ে দিয়েছে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা।
একই সঙ্গে দেশের ভেতরেও, বিশেষ করে সিলেট বিভাগে এবার রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। ভারত থেকে নেমে আসা পানি, সেই সঙ্গে দেশের ভেতরে প্রবল বৃষ্টিপাত বন্যা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছিল। বন্যায় প্রায় এক কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, প্রাণহানিও অনেক। সঠিক তথ্য কোনো সূত্র থেকেই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ধারণা করা হচ্ছে, শতাধিক মানুষ মারা গেছেন বন্যায়। বাড়িঘর, ফসল, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগিসহ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিপুল।
আগেই বলেছি, বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য বা হিসাব এখনো জানা যায়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন সঠিক তথ্য নিরূপণের জন্য। তবে একটি প্রাথমিক হিসাবে দেখা যায়, বন্যায় ৮৫ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি অথবা আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বহু পরিবার নিজেদের ভাঙা ঘরে ফিরে গেছেন, ঘর মেরামত করে বাসোপযোগী করার চেষ্টা করছেন। গত ১২ জুলাই পর্যন্ত সিলেটের ২২১ আশ্রয়কেন্দ্রে ১৪ হাজার বন্যাদুর্গত মানুষ অবস্থান করছিল।
সরকার বন্যায় বিধ্বস্ত ঘর মেরামতের জন্য নগদ অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। যাদের ঘর পুরোপুরি ভেঙে গেছে বা বিধ্বস্ত হয়েছে, তাদের জন্য পরিবারপিছু ১০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের জন্য দেওয়া হচ্ছে ৫ হাজার টাকা। একটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত ঘর পুনর্নির্মাণ ১০ হাজার টাকায় সম্ভব হবে না, এটি সরকারপক্ষও জানে, তাই আশ্বাস দেওয়া হয়েছে পরে আরও দেওয়া হবে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর এখন জরুরি হলো বন্যার্তদের পুনর্বাসন। একে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে জরুরি কার্যক্রম শুরু করতে হবে, যাতে বানভাসি মানুষ আবার উঠে দাঁড়াতে পারে।
আবারও বন্যার আশঙ্কা?
মে মাসে শুরু হওয়া দীর্ঘস্থায়ী ভয়াবহ বন্যার পানি নেমে গেছে সত্যি, কিন্তু আবার যে বন্যা হবে না, এ কথা বলা যাবে না। কারণ, বন্যার মৌসুম মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কাজেই সামনের আড়াই মাসের মধ্যে যে কোনো সময় বন্যা আবারও আঘাত হানতে পারে। এবারের বৃষ্টিপাতও অস্বাভাবিক হারে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন তো আছেই, তদুপরি উত্তরের আসাম-মেঘালয়ের পাহাড়ে অসংখ্য গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সে অঞ্চলে, বিশেষ করে চেরাপুঞ্জিতে যখন অবিরাম বৃষ্টি হয়, সেই বিপুল পরিমাণ পানি পাহাড় ধরে রাখতে পারে না, কারণ গাছপালা নেই। একই সময়ে জলবায়ুর কারণে সিলেট অঞ্চলেও বৃষ্টি হয়। দুই অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের বিপুল জলরাশি নেমে আসে সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে। উজান থেকে নেমে আসা পানি নদী দিয়ে দক্ষিণে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা যাচ্ছে না। সুরমা, কুশিয়ারাসহ প্রধান নদীগুলো পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। পলি, মাটি, বর্জ্যতে নদীর তলদেশ এতটাই উঁচু হয়ে গেছে যে, পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি নদী ধারণ করতে পারছে না। ফলে দুই কূল প্লাবিত হয়ে বড় ধরনের বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
বর্ষার সময় বৃষ্টিপাত হয় প্রতিবছরই, ছোট আকারের বন্যাও হয়। সে বন্যা মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি করে না। বরং বন্যার ফলে ফসলের জমি উর্বর হয়, ফলন ভালো হয়। কিন্তু এ বছরের ভয়াবহ বন্যা প্রায় এক কোটি মানুষের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ বছর বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বৃষ্টিপাতকে আটকে রাখা যাবে না। কিন্তু বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আগেই বলা হয়েছে, সুরমা, কুশিয়ারাসহ সিলেট বিভাগের নদীগুলো দীর্ঘকাল পলি পড়তে পড়তে ভরাট হয়ে গেছে। এসব নদীতে কবে ড্রেজিং করা হয়েছিল, তা কেউ মনে করতে পারেন না। নদীতে স্বাভাবিকভাবে যে জলস্রোত নেমে আসে, তা সঙ্গে নিয়ে আসে বিপুল পরিমাণ পলি, বালি, মাটি। এ পলির ৮০ শতাংশ নদীর স্রোতের সঙ্গে ভেসে চলে যায়, নদীতলে রেখে যায় ২০ শতাংশ। এভাবে পলি জমতেই থাকে, নদীতল উঁচু হয়ে ওঠে। একসময় নদী অতিরিক্ত পানি ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ থেকেই বন্যার সৃষ্টি।
বন্যার সমাধান ড্রেজিং
নদীগুলোয় যদি নিয়মিত ড্রেজিং করা যায়, তাহলে বন্যার আশঙ্কা পুরোপুরি দূর করা সম্ভব। তবে সিলেট বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারাসহ প্রধান নদীগুলো আর নিয়মিত ড্রেজিংয়ের পর্যায়ে নেই। নদী প্রায় পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে, তাই দরকার ক্যাপিটাল ড্রেজিং। অর্থাৎ ব্যাপক আকারের ড্রেজিং, যা নদীর বুকে জমে থাকা বিপুল পরিমাণ পলি সরিয়ে ফেলবে। নদীর নাব্য ফিরে আসবে। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পর চালিয়ে যেতে হবে নিয়মিত ড্রেজিং। এর ফলে নতুন করে আর পলি জমতে পারবে না। নদীর নাব্য বজায় থাকবে, ধারণক্ষমতা বাড়বে। অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে নদীতে অতিরিক্ত পানি এলে নদী তা ধারণ করতে পারবে, বন্যার আশঙ্কা অনেক কমে যাবে। হালকা ধরনের বন্যা হলেও তা ভয়াবহ রূপ নেবে না।
সুরমা, কুশিয়ারাসহ সিলেটের প্রধান নদীগুলোয় অবিলম্বে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে পরিকল্পিতভাবে নিয়মিত ড্রেজিং চালিয়ে যাওয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। এটি করা গেলে নদীগুলো নাব্য ফিরে পাবে। সিলেট বিভাগের জনগণ বন্যার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। সিলেট ও সুনামগঞ্জ শহর এবার যেভাবে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে, তা অভূতপূর্ব। স্থানীয়রা চান শহর দুটি ঘিরে বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ দেওয়া হোক। শুধু এ দুটি শহর নয়, বিভাগের অন্যান্য শহরকেও বাঁধ দিয়ে সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।
বলা হয়, ক্যাপিটাল ড্রেজিং ব্যয়বহুল। হতে পারে ব্যয়বহুল, কিন্তু মানুষকে বাঁচাতে, দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে এ খরচ করতেই হবে। ক্যাপিটাল ড্রেজিংকে উন্নয়ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হিসাবেও বিবেচনা করা যায়। বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা করা হলে বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল থাকবে। হঠাৎ করে বন্যা এসে খেতের ফসল, মানুষের বাড়িঘর, পশুসম্পদ, মৎসসম্পদ ধ্বংস করতে পারবে না। কোনো জেলা বা অঞ্চল বন্যাকবলিত হলে সেখানে ত্রাণ ও উদ্ধারকাজ, আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা এবং বন্যার পর পুনর্বাসন কাজে সরকারের কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, সেটাও বিবেচনা করতে হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হলে সরকারকে এসব খরচ করতে হবে না, বরং কৃষি খাত, শিল্প খাত সচল থাকবে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু অবকাঠামোর উন্নয়নই শেষ কথা নয়। দেশের মানুষকে আগে বাঁচাতে হবে, পরিবেশ বাঁচাতে হবে, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থার জন্য যা ব্যয় হবে সেটা অপচয় নয়, এ ব্যয় জাতীয় উন্নয়নকে দৃঢ় ভিত্তি দেবে।
সিলেট বিভাগ যখন বন্যার আগ্রাসনে বিপর্যস্ত, সে সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলেও বন্যা হয়েছে। বেশ কয়েকটি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বন্যার পানিতে। বাংলাদেশের যেখানেই বন্যা হোক, মূল কারণ একটাই-সেটা হলো উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি অথবা অতিবৃষ্টি। এ পানির ঢল যখন নদীর ধারণক্ষমতার বাইরে যায়, তখনই নদীর দুই তীর প্লাবিত হয়, বন্যা হয়। দেশের প্রায় সব নদীর তলদেশ পলিতে ভরাট হয়ে উঁচু হয়ে গেছে। সে তুলনায় ড্রেজিং কার্যক্রম খুবই কম।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের সব নদী এখনই ড্রেজিং করতে হবে, সে কথা বলা হচ্ছে না। যেসব নদীর কারণে বন্যা হয়, সেগুলো চিহ্নিত করে ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও পরে পরিকল্পিত নিয়মিত ড্রেজিং জরুরি। এজন্য প্রয়োজনে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং চিহ্নিত নদীগুলোয় ড্রেজিংয়ের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। সফলভাবে ড্রেজিং করা হলে স্থায়ীভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com