Logo
Logo
×

বাতায়ন

উৎসব হোক নির্বিঘ্ন ও অর্থপূর্ণ

Icon

ড. হারুন রশীদ

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উৎসব হোক নির্বিঘ্ন ও অর্থপূর্ণ

প্রতিবছর ঈদযাত্রায় একই চিত্র দেখা যায়। টিকিটের জন্য হাহাকার। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ক্লান্তিহীন অপেক্ষা। ঠাঁই নেই, তবুও যেতে হবে। বাসে, ট্রেনের কামরার ভেতরে দাঁড়িয়ে, সেখানে ঠাঁই না হলে ছাদে।

লঞ্চেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্লোরে বসে, ডেকে দাঁড়িয়ে, এমনকি ছাদের উপর বিছানা পেতে সেখানেই বসে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করতে হয়। ঈদ সামনে রেখে প্রতিবছর এই একই অবস্থা তৈরি হয়। যেভাবেই হোক বাড়িতে পৌঁছাতেই হবে। এ টান যে বড় বেশি প্রাণের। এ টান নাড়ির। দুনিয়ার কোথাও কি মানুষ এভাবে ছুটে প্রাণের টানে, শেকড়ের সন্ধানে? কীসের এত মায়া?

কীসের জন্য মানুষের এই ঘরে ফেরার আকুতি? এ কি কেবলই প্রিয়জনের সান্নিধ্য? নাকি এরও অতিরিক্ত কিছু? ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রাম দেখার জন্য আকুতি? ইট-কাঠ-পাথরের এ শহর ছেড়ে মুক্তভাবে শ্বাস নেওয়ার জন্য? নাকি জীবনানন্দের বনলতা সেনের মুখোমুখি বসার মতো ‘দুদণ্ড শান্তির’ জন্য এ যাত্রা?

যারা গ্রাম থেকে শহরে আসে, তাদের প্রাণটা আসলে পড়ে থাকে গ্রামেই। বিশেষ করে যারা গ্রামে বড় হয়েছেন। এ নাগরিক জীবন হয়তো অনেক কিছু দেয়। শিক্ষা-দীক্ষা, ভাত-কাপড়, রুটি রোজগারের নিশ্চয়তা। অনেক উত্তেজনা। ভোগ, বিলাস, আনন্দ। কিন্তু জীবনের সব পাওয়া, সব তৃষ্ণা কি মেটে তাতে? কিছুই কি বাকি থাকে না?

এ শহরে তো দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ নেই, জোয়ার-ভাটায় দুলে ওঠা নদী নেই, বৃক্ষের শ্যামল ছায়া নেই, ধানের খেতে রোদ ও ছায়ার লুকোচুরি খেলা নেই, ঘাসের ডগায় শিশির নেই, রাখালের বাশের বাঁশি নেই, গোধূলির আলো নেই, বাউকুড়ানির ডগায় ঝরাপাতার নৃত্য নেই, পাখির কলকাকলি নেই, পিঠাপুলি-পাটিসাপটার আয়োজন নেই, আউল-বাউল জারি, সারি, ভাটিয়ালির হৃদয় উদাস করা সুর নেই, বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ নেই, নেই এক চিলতে উঠান। এসব ‘নেই’-এর পাল্লা এতটাই ভারী যে তা বলে শেষ করার নয়।

সেজন্যই কি আমাদের ছুটে চলা? গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথে পায়ে ধুলো মাখিয়ে হাঁটার জন্য? নাকি আদিখ্যেতা হয়ে যাচ্ছে এসব কথা? মানুষ কি আর এত হিসাব নিকাশ করে চলে? কয়েকটা দিন ছুটি পেলাম আর কোথাও ঘুরে এলাম-এটাই হয়তো বড় কারণ। আটপৌরে বাঙালি।

কোথায় আর যাবে। বেড়ানোর কি ফুরসত আছে? যে মাইনে আর রোজগার, তাতে সংসারের হাঁড়ি টানতেই সব যায়। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে সামাল দিতেই হিমশিম খেতে হয়। সেজন্য বিদেশ-বিভুঁই নয়, ‘ঘর হতেই আঙিনা বিদেশের মতো’ দেশের বাড়িতেই (নিজগ্রাম) ঈদ করা। কিন্তু সেই গ্রামও কি আর আগের মতো আছে?

নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অনেকখানিই পাওয়া যায় এখন গ্রামে বসেই। বিদ্যুৎ পৌঁছেছে বেশির ভাগ গ্রামেই। সেজন্য বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন, এমনকি ডিশ লাইন থাকায় মুম্বাই-কলকাতা ঢাকার চেয়েও কাছের। সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। কম্পিউটার, সঙ্গে ওয়ারলেস ইন্টারনেট সংযোগ। মফস্বলে দৈনিক পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিরা এখন হাতে লিখে, ফ্যাক্স করে সংবাদ পাঠান না। কম্পিউটারে কম্পোজ করে ইন্টারনেটে ই-মেইলের মাধ্যমে অতিদ্রুত তারা পাঠিয়ে দেন খবরাখবর। ব্যবসা-বাণিজ্যের খবরও চলে মোবাইলে। মৎস্য চাষি, পোলট্রি ফার্মের মালিক, কিংবা সবজি চাষি মোবাইলে জেনে নেন কেমন বাজার যাচ্ছে ঢাকায়।

এভাবে ভার্চুয়াল একটা যোগাযোগ তো আছেই গ্রামের সঙ্গে শহরের। শহরের সঙ্গে গ্রামের। কিন্তু তাতেও তো সব হয় না। দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? এর জন্য আসল দুধই চাই। আর তা পেতে হলে ‘গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু’র দেশে যেতে হবেই। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রামের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাটা এখনো আশানুরূপ নয়। এ জন্য ঘরমুখো মানুষকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। কিন্তু তাতে কী? যেতে তো হবেই।

শিশির ভেজা সবুজ ঘাস, ছোট্টবেলার স্কুলে যাওয়ার মেঠো পথের স্মৃতি, হাডুডু আর ফুটবল খেলার মাঠ, কিংবা টাকার অভাবে পড়তে না পারা স্কুলজীবনের সেই সহপাঠীর প্রিয়মুখ দেখার আনন্দ কোথায় পাওয়া যাবে এ শহরে? পাশের বাড়ির সাপের ফণার মতো বেণি দুলানো দুরন্ত সেই কিশোরীর হাসি কোথায় মিলবে? এ শহরে নির্ভেজাল জীবনানন্দ কোথায়? এখানে তো মানুষ নয়, শোষক আর শোষিত, আমলা আর কামলা (মজুর), মালিক-শ্রমিক, পুঁজিপতি আর নিঃস্ব, হাইরাইজ বিল্ডিং আর রেললাইনের পাশের বস্তির বিস্তর ব্যবধানের মধ্যে বসবাস।

জীবন কোথায় এখানে-চার দিকে ঠগ, প্রবঞ্চক, প্রতারক, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি। কী নির্মম, কী পাশবিক এ জীবনধারা। যানজট আর জনজটে রাস্তায় চলাই দায়। ঘুসখোর কর্মকর্তা ইলিশ কেনে ১৪ হাজার টাকা হালি, আর সাধারণের পুঁটি কিনতেই নাভিশ্বাস।

তারপরও খেটে মানুষের জীবনেও ঈদ আসে। তারাও ঘরে ফেরে। শরীরের প্রায় শেষ শ্রমটুকু নিংড়ে দিয়ে তাদের যখন ছুটি মেলে, তখন ফেরার নিশ্চয়তাটুকুও নেই। মধ্যরাত পর্যন্ত বাক্স-পেটরা হাতে রাস্তার পাশে অপেক্ষা আর অপেক্ষা। অথচ এদের ঘাম-শ্রমের বিনিময়েই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। রেমিট্যান্স প্রবাহ জিডিপির হার বাড়ায়, যা এ দেশকে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করেছেন, আর এখন এসব জীবনযোদ্ধা দেশ গড়ছেন।

আসলে এই যে এতসব ঝক্কি-ঝামেলা সহ্য করে ঘরে ফেরা, এটাও তো দেশপ্রেমেরই অংশ। আমরা তো আমাদের মায়ের কাছেই ফিরি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-‘ফিরে চল মাটির টানে, যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।’ দেশও তো মায়ের সমতুল্যই। মা ছাড়া আর কারও জন্য কি এভাবে জীবন বাজি রাখা যায়, একাত্তরে যা করেছে বীর বাঙালি? মনে রাখা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ উন্নত একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সবার সমঅধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। তবেই এ ঈদ হবে সবার, যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। সেজন্যই আমাদের মাটির টানে ফিরে যেতে হবে মূলে, দেশের জন্মসূত্র একাত্তরে।

চার দিকে এখন মূল্যবোধের অবক্ষয়। এ জন্য মনুষ্যত্ববোধের উন্মেষ ঘটাতে হবে। এটা করতে হলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আর জ্ঞানের আধার হচ্ছে পাঠাগার। গ্রন্থাগার হচ্ছে লেখক, পুস্তক ও পাঠকের সম্মিলনস্থল। সভ্যতার দর্পণ। একটি দেশ তথা সমাজের সার্বিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্রও এ পাঠাগার। সমাজে বিত্তবান অনেকেই আছেন, যারা তাদের অর্জিত অর্থের একটা অংশ বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করেন। সেক্ষেত্রে পাঠাগার হতে পারে উত্তম জায়গা। সমাজকে এগিয়ে নিতে, অন্ধকার দূর করতে পাঠাগার হতে পারে অন্যতম আলোকবর্তিকা।

এ জন্য ঈদে যারা গ্রামে ফিরবেন, বিশেষ করে বিত্তবান মানুষরা প্রচেষ্টা চালাতে পারেন নিজ নিজ এলাকায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আজকের একজন তরুণ-তরুণী যেন বইয়ের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠতে পারে, সেজন্য পাড়া-মহল্লায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। সমাজে সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সেতু হিসাবে কাজ করতে পারে পাঠাগার। আমরা আমাদের সমাজটাকে যতই জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধাররূপে গড়ে তুলতে পারব, ততই সমাজ এগিয়ে যাবে। আর, একটি উন্নত সমাজব্যবস্থায় উৎসব হবে আরও আনন্দময় ও অর্থপূর্ণ। শেকড়ের টানে ঘরে ফেরাও তখন সার্থক হবে। আমাদের লক্ষ্য হোক সেই দিকে।

ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক

drharun_press@gmail.com

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম