অবহেলিত ‘সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি’
মো. ফিরোজ মিয়া
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকারি পরিষেবার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে সিটিজেন চার্টার বা নাগরিক সনদের ধারণাটি ১৯৯১ সালে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন মেজর জাতীয় কর্মসূচি হিসাবে শুরু করেছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৯৮ সালে টনি ব্লেয়ার ধারণাটিকে আরও সমৃদ্ধরূপে গ্রহণ করেন এবং এর পুনঃনামকরণ করেন ‘সার্ভিসেস ফাস্ট’ হিসাবে। সরকারি পরিষেবার মানোন্নয়নের জন্য ধারণাটি খুবই কার্যকর হওয়ায় সারা বিশ্বে তা খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বিশ্বের অনেক দেশ ধারণাটি ভিন্ন ভিন্ন নামে ও ভিন্ন ভিন্ন ফর্মে গ্রহণ করে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ২০০৭ সালে ধারণাটি গ্রহণ করে একটি পরিপত্র জারি করে। পরবর্তী পর্যায়ে সচিবালয় নির্দেশমালায়ও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করা হয় ২০১৭ সালে। পরিপত্র জারি থেকে নির্দেশনা জারিতে সময় লাগে প্রায় ৯ বছর। বাংলাদেশে ‘সিটিজেন চার্টারে’র নামকরণ করা হয় ‘সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি’।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এটি স্বীকৃত যে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয় ধরনের টেকসই উন্নয়নের জন্য সুশাসন অপরিহার্য। সুশাসনের জন্য জনপ্রশাসনে থাকতে হয় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দায় স্বীকারের মানসিকতা এবং দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের সক্ষমতা। আর এসব নিশ্চিতকরণের জন্য সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি অত্যন্ত কার্যকর একটি ব্যবস্থা। তাছাড়া এ ব্যবস্থা সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকারি পরিষেবার মান উন্নীতকরণ ছাড়াও জনপ্রশাসনকে জনবান্ধব প্রশাসনে পরিণত করাও সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতির অন্যতম উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়।
সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি শুরুর সময় খুবই তোড়জোড় করা হয়েছিল, পেটানো হয়েছিল ঢাকঢোলও। কিন্তু সময় যত গড়াতে থাকে, সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের তোড়জোড় ততই কমতে থাকে। যুগান্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতির বিষয়টি জনগণ ভুলতে বসেছে, জনপ্রশাসন তো বলতে গেলে ভুলেই গেছে। এ কারণে বলা যায়, সরকারের সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি বর্তমানে অনেকটা অবহেলিত।
জনপ্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, সহজভাবে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণ, জনপ্রশাসনের দক্ষতার উন্নয়ন এবং অংশীজনবান্ধব পন্থা গ্রহণের মাধ্যমে জনপ্রশাসনে জবাবদিহিতা আনয়ন ও সরকারি পরিষেবা প্রদানে অধিক গুরুত্বারোপের উদ্দেশ্যেই মূলত ‘সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি’ ধারণার সৃষ্টি। এটি নাগরিকদের ক্ষমতায়নে সহায়তা করে, পরিষেবা প্রদানে জনপ্রশাসনের জবাবদিহিতা বাড়ায়, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়কের ভূমিকা পালন করে। এছাড়া সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতির পরিমাপযোগ্য মান থাকায় সহজেই সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা ধরা যায় এবং ওই দুর্বলতা দূরীকরণের চেষ্টা করা যায়। সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতির উন্নতির বদলে এটি অবহেলিত হওয়া মোটেই কাম্য নয়।
বর্তমানে সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি নিছক একটি আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নিয়েছে। এতে নাগরিকদের তেমন সম্পৃক্ততা নেই। জনপ্রশাসনের কর্মচারীরাও একে সরকারি অন্যান্য আদেশের মতো নিছক একটি সরকারি আদেশ হিসাবে গণ্য করে থাকে। সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তেমন কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকায় এবং ব্যর্থতার জন্য বা যথাযথভাবে প্রতিপালন না করার জন্য শাস্তির বিধান ও দৃষ্টান্ত না থাকায় এর বাস্তবায়নে জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের তেমন আগ্রহ নেই, এমনকি তেমন কোনো চাপও নেই। এছাড়া সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের মনমানসিকতার পরিবর্তনের উদ্যোগও তেমন দৃশ্যমান না হওয়ায় এর প্রতি জনগণের আস্থা থাকছে না।
সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি সরকারি পরিষেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রণীত এমন একটি দলিল বা ঘোষণাপত্র, যেখানে ওই সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কাদের কী ধরনের সেবা প্রদান করবে, কত সময়ের মধ্যে তা প্রদান করবে এবং সেবা প্রদান না করার ক্ষেত্রে প্রতিকারব্যবস্থা কী-এসব বিষয়ের উল্লেখ থাকে। এজন্য সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি হতে হয় মানসম্পন্ন। কারণ, সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতির মানের ওপরও এর সাফল্য অনেকাংশে নির্ভরশীল। সেবাপ্রত্যাশীদের প্রত্যাশার প্রতিচ্ছবি থাকতে হয় সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতিতে। এ কারণে সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি প্রণয়নে সেবাপ্রত্যাশীদের মতামত ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন হয়। কিন্তু অধিকাংশ সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতিই সেবাপ্রত্যাশীদের মতামত গ্রহণ না করে এবং তাদের প্রতিক্রিয়া কীরূপ হবে, তা বিবেচনা না করে একতরফাভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে; যে কারণে সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি সেবাপ্রত্যাশী তথা জনগণের আস্থা অর্জনে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতির অধিকাংশই কাঙ্ক্ষিত মানেরও নয়। এমনকি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই এর গুণগত মান উন্নীতকরণের আগ্রহও তেমন দেখা যায় না। অধিকাংশ সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি অনেকটা তথ্য কণিকার মতো, যেখানে কেবল কতিপয় তথ্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতির ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি জবাবদিহিতামূলক জনবান্ধব জনপ্রশাসন গড়ার একটি উৎকৃষ্ট হাতিয়ার হওয়া সত্ত্বেও এ প্রতিশ্রুতিতে যেসব বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি আবশ্যক, তার অনুপস্থিতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লক্ষ করা যায়। সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতিতে পরিষেবার সুস্পষ্ট মান নির্ধারিত থাকতে হয় এবং ওই মানগুলো পরিমাপযোগ্যও হতে হয়, থাকতে হয় সময়-সীমাবদ্ধতা। একে হতে হয় প্রাসঙ্গিক, নির্দিষ্ট ও নির্ভুল। এছাড়া এতে সহজ ও উন্মুক্তভাবে সব তথ্যের প্রকাশ করতে হবে। সেবাপ্রত্যাশীদের অংশগ্রহণ ও পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে এবং সেবাপ্রত্যাশীদের চাহিদা অনুযায়ী সেবা প্রদানের সুযোগও থাকতে হবে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভুল সংঘটিত হলে তা সংশোধনের সুযোগও থাকতে হবে। কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়ার কারণে প্রতিকারের ব্যবস্থাসংক্রান্ত বিষয়গুলোর সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতিতেই এর অনুপস্থিতি লক্ষণীয়।
সেবাপ্রত্যাশীদের প্রত্যাশার প্রতিফলন থাকে, এরূপ সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি প্রণয়ন ও এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনপ্রশাসন জনবান্ধব প্রশাসনে পরিণত হবে-এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইনসংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক