বন্যায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা

ডা. মনজুর হোসেন
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
সম্প্রতি বাংলাদেশের সিলেটসহ কিছু এলাকা মারাত্মক বন্যার কবলে পড়ায় জনজীবন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। বিস্তীর্ণ এলাকা আজ বন্যাকবলিত, ব্যাপক বন্যায় বহু গ্রাম, শহর, ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি অসংখ্য মানুষ। বানভাসি জনগণের দুঃখ-দুর্দশা অসহনীয় এবং লাখ লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং টয়লেট সুবিধার মারাত্মক ঘাটতির কারণে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। মারা যাছে শিশুসহ অনেকে, ক্ষতি হচ্ছে ফসলের, বহু মাছচাষের পুকুর নষ্ট হয়ে বহু ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
বাঁধের মতো সুরক্ষা অবকাঠামোগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনা মহামারি মোকাবিলায় এমনিতেই গত দুবছরে বাংলাদেশের নাভিশ্বাস অবস্থা, এর মাঝে এ ধরনের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা সত্যই বাস্তবতার নিরিখে খুবই কষ্টসাধ্য। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনাতেও একটি বিপর্যয়ের ঝুঁকি থেকে যায়। করোনারও এখন ঊর্র্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে, বিশেষত জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য শারীরিক দূরত্বের মতো পদক্ষেপগুলো পালন করা প্রয়োজনীয় হলেও তা বাস্তবসম্মতভাবে করা সম্ভব নয়। বন্যার জলাবদ্ধতা, টিউবওয়েলের পানি দূষিত পানির সঙ্গে মিশে যাওয়ায় এবং কোভিড-১৯ মহামারি একই সঙ্গে থাকায় বন্যাকবলিত মানুষের ওপর এক মারাত্মক দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সুতরাং এবারের বন্যাকে আগের তুলনায় নিঃসন্দেহে জটিল করে তুলছে। স্বাস্থ্যবিধি অর্থাৎ শারীরিক দূরত্ব এবং হাত ধোয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন আক্রান্ত মানুষ বা বাস্তুচ্যুত ও আশ্রয়কেন্দ্রে থাকাদের মধ্যে পালন করা সম্ভব হচ্ছে না।
হাজার হাজার ল্যাট্রিন এবং নলকূপের পাশাপাশি ধানের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়ক যোগাযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বেশ কয়েকটি জেলা বিচ্ছিন্ন রয়েছে। স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শিশুদের লেখাপড়া ব্যাহত হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকে প্রাণ হারিয়েছে, বেশির ভাগ মৃত্যুর প্রধান কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া এবং এর মধ্যে শিশুরাও ডুবে মারা যাচ্ছে।
বন্যাকবলিত এলাকায় যাতায়াতের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রান্তিক জনগণের মাঝে টিকাদানসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হয়েছে। এতে মৃত্যুর ঝুঁকি, পানিবাহিত ও অন্যান্য রোগব্যাধি, পুষ্টির অভাব এবং বন্যার্তদের মধ্যে করোনা মহামারি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
বন্যার দুর্বল রোগাক্রান্ত জনগোষ্ঠী, শিশু, গর্ভবতী মহিলা, কিশোরী কন্যা, বয়স্ক ব্যক্তিরা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং প্রান্তিক হতদরিদ্র জনগণকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে এবং তাদের সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত সংকট সৃষ্টি করেছে। বাসস্থানের ক্ষতি, পরিবহণ, যাতায়াতের এবং যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাসহ প্রসবকালীন এবং নবজাতক যত্ন পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে এবং শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
জীবিকা নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত আয় ও উপার্জন কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে, স্থানীয় বাজার, ফসল, হাঁস-মুরগি, প্রাণী ও মৎস্যের আবাদ বেশির ভাগ অঞ্চলে তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে ত্রাণের ওপর নির্ভরতা সৃষ্টি হয়েছে, যা কি না খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে। ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক ভোগান্তি বাড়িয়ে তুলেছে।
একটি বন্যা ঘরবাড়ি, বাণিজ্যিক ভবন, কৃষি ও জায়গাজমি, পণ্যাদিসহ অন্যান্য সব সম্পত্তি ধ্বংস ও প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শিক্ষাকার্যক্রমে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। বন্যার ফলে পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিও হুমকি হয়ে ওঠে। ডায়রিয়া খুবই মারাত্মক অসুস্থতা হিসাবে দেখা দেবে এবং বন্যায় আক্রান্ত জনগণের মধ্যে মৃত্যুর একটি বড় কারণও হয় ডায়রিয়া। এছাড়া বন্যার কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণ অর্থাৎ নিউমোনিয়া উচ্চমাত্রায় দেখা দেওয়ায় নিউমোনিয়ায় মৃত্যু দেখা দেবে। পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যার তীব্রতার জন্য বিভিন্ন জলবাহিত রোগ যেমন: ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরা, টাইফয়েড এবং জন্ডিস দেখা দেয়। আর এ বন্যার কারণে নিরাপদ পানীয় জলের এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের স্বল্পতা ও অভাবে বানভাসি জনগোষ্ঠীর, বিশেষত দরিদ্র ও দুর্বলদের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে।
নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ:
১. অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ খাবার
বন্যার পানিতে ব্যাকটিরিয়া, ময়লা, তেল, মানব ও প্রাণিজ বর্জ্য এবং খামার ও শিল্প রাসায়নিকগুলো মিশে যায়; যা কৃষি জমিগুলোয় খাদ্যশস্যসহ খাদ্যজাতীয় সামগ্রীর সঙ্গে সংক্রমণ ঘটায়, তাতে খাদ্য অনিরাপদ এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। বন্যার ফলে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন বা ব্যাহত হওয়ার জন্য হিমায়িত এ সঞ্চিত খাদ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২. পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ
বন্যা দূষিত পদার্থের সঙ্গে পরিষ্কার পানির উৎসকে দূষিত, সংক্রমিত করে এবং একই সঙ্গে স্যানিটারি টয়লেটগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। এ কারণে দ্রুত পানিবাহিত জীবাণুগুলো ছড়িয়ে পড়ে। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার গ্রহণের জন্য মাছি, অপরিষ্কার হাত বা নোংরা প্লেট, বাসন, জীবাণুবাহক পোকামাকড়ের ও মশা-মাছির জন্য পানিবাহিত রোগব্যাধি এবং প্রাণঘাতী রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। প্রাণঘাতী কলেরা, টাইফয়েড, কিছু ধরনের হেপাটাইটিস ছড়িয়ে পড়বে।
৩. দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি
নিরাপদ পানীয় জলের এবং স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর সুষম খাবারের স্বল্পতা ও অভাব বানভাসি জনগণের, বিশেষত দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মারাত্মক দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলে দেবে।
৪. মশা ও প্রাণী
দীর্ঘায়িত বৃষ্টিপাত এবং বন্যা মশার জন্য নতুন প্রজনন ক্ষেত্র- আর্দ্র অঞ্চল এবং আবদ্ধ জলাশয় সৃষ্টি করে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি এবং চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে। বন্যপ্রাণী, ইঁদুর ইত্যাদির জন্য লেপটোস্পিরোসিস ও অন্যান্য রোগের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
৫. আর্দ্রতা ও ফাংগাস
বানভাসি জনগণের মাঝে ফাংগাস এবং অন্যান্য জীবাণুগুলোর অত্যধিক সংমিশ্রণের ফলে বিশেষত যারা অ্যালার্জি এবং হাঁপানিতে আক্রান্ত, তাদের শ্বাসযন্ত্রের রোগ সংকোচনের এবং শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগের মাত্রা বেড়ে যায়। অ্যালার্জি, হাঁপানিসহ শ্বাস-প্রশ্বাসের অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এ কারণে শিশু, প্রবীণ এবং গর্ভবতী মহিলারা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ত্বকের সংক্রমণ যেমন দাদ, খোস-পাঁচড়া, স্ক্যাবিস, ইম্পিডিগো ইত্যাদি হয়।
৬. সাপের কামড়
বন্যার জলের সময় সাপ বাসা থেকে খোলাখুলি বাইরে আসতে বাধ্য হয়। সাপগুলো তখন শুকনো জায়গার সন্ধান করতে শুরু করে এবং দুর্ভাগ্যক্রমে, বাড়ির অভ্যন্তরে মানুষের কাছাকাছি চলে আসতে পারে, তাই বন্যার পরে সাপে কামড়ানোর ঘটনা বেড়ে যায়।
৭. পানিতে ডুবে মৃত্যু
বন্যার সময়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে খুব বৃদ্ধি পায়।
৮. মানসিক চাপ ও ক্লান্তি
ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগও রয়েছে। পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর এবং সম্পত্তিগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মেরামতে সাধারণত বেশি মনোযোগী ও ব্যস্ত হতে হয়।
তবে আশার কথা ক্ষতিগ্রস্তদের ইতোমধ্যে সরকার, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, ত্রাণ সংস্থা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘর, ভবন এবং সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা ও কাজ শুরু করেছেন। সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং ধ্বংসাত্মক বন্যার ঝুঁকি এড়ানোর জন্য স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী ও সাহায্য সংস্থাগুলো ত্রাণ ও সহায়তায় পুনরুদ্ধারের জন্য এগিয়ে এসেছে।
নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পানি ক্লোরিনেশনসহ বিশুদ্ধকরণ নিশ্চিত করতে হবে। পরিশেষে সংক্রামক রোগগুলোর ব্যাপারে প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করাসহ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের ওপর জোর দিতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন : সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি