ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কি এতই কঠিন?
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
অনেক হয়েছে, এবার দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে সিদ্ধান্তমূলক জবাব প্রত্যাশা করে। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য সহ্যসীমা অতিক্রম করছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে তারা পছন্দ করে। নিজেদের অবৈধ স্বার্থ অর্জনে বাধা হলে শিক্ষকদের অপমান করতেও দ্বিধা করে না। দেশজুড়ে সন্ত্রাস, অনৈতিক কার্যক্রম, হলে সিট বাণিজ্য, দখলদারিত্ব ইত্যাদি সব মন্দ কাজে ছাত্রলীগের নাম চলে আসছে সামনে।
অতিষ্ঠ হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমনা শিক্ষকরা ব্যানার নিয়ে পথে নামতে বাধ্য হয়েছেন। দেশজুড়ে নানা সময়ে ছাত্রলীগ নেতারা অপকর্ম করার পর মিডিয়াতে স্বরূপ প্রকাশিত হলে আইওয়াশ হিসাবে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের আদেশের কথা শোনা যায়। এসব সন্ত্রাসী তরুণ এতে কোনো চাপ অনুভব করে না। জানে এগুলো সাময়িক উত্তেজনা প্রশমনের কৌশল মাত্র! তাই পৌনঃপুনিকভাবে অঘটন ঘটেই যাচ্ছে।
আমাদের রাজনীতিকরা নানা অঙ্ক কষেই অগ্রসর হন। তারা নিশ্চয়ই জানেন, ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য জারি করা আচরণে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। ক্ষুব্ধ শিক্ষাঙ্গনের সাধারণ শিক্ষার্থী, রাজনীতি-অন্ধ বা সুবিধাভোগী শিক্ষক ছাড়া গোটা শিক্ষক সমাজ। ক্ষুব্ধ কর্মচারী-কর্মকর্তারা। অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ, বিরক্ত ও আতঙ্কিত। কিন্তু কোনো কেয়ার করছেন না ছাত্রলীগের অভিভাবক রাজনৈতিক নেতারা। একবার বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন ছাত্রলীগের অভিভাবক আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা। সুপথে আসছে না বলে ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে সংশ্রব ত্যাগ করার কথা বলেছিলেন।
কিন্তু এরপরও ছাত্রলীগ সুপথে আসেনি। অথবা এমনও হতে পারে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা গুরুত্ব অনুভব করেছিলেন, কিন্তু বোধকরি ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিট থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলার ছাত্রলীগের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনও হতে পারে, আওয়ামী লীগপ্রধান ছাত্রলীগকে পরিচ্ছন্ন পথে আনতে চাইলেও চারপাশের সহযোগী নেতাদের কাছ থেকে তেমন সহযোগিতা পাননি। একথা তো মানতে হবে, আওয়ামী লীগপ্রধান সরকারপ্রধানও বটে; সরকারের এতসব দায়িত্ব পালন ও উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কঠিন পথের কাণ্ডারি হয়েও তাকে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করতে হবে, এটা কিন্তু অনেক বেশি চাওয়া হয়ে যাবে। তাহলে ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করা ও দেখভালের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কী করছেন?
এমন কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মানুষ ভাবতেই পারে, ছাত্রলীগের আচরণে জনগণ ক্ষুব্ধ হোক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলুষিত হোক তাতে কিছু যায়-আসে না দলীয় রাজনীতি-অন্ধ নেতাদের। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে টেকার জন্য আমাদের নেতাদের বোধহয় পা শক্ত হয়নি। এজন্য ছাত্রলীগের মতো পেশিশক্তি প্রয়োজন। ছাত্রলীগের টিকিট আঁটা তরুণদের সাতখুন মাফ করে দিতে পারছেন সহজেই। এ সত্যটি অস্বীকার করা যাবে না, ছাত্রলীগে নাম লেখানো সবাই যে উচ্ছন্নে যাওয়া তরুণ, তেমন নয়। অনেকের মধ্যেই সুস্থ ধারায় ছাত্ররাজনীতি করার প্রত্যয় থাকে। কিন্তু দুর্বিনীত সহযোদ্ধাদের দাপটের কারণে তাদের অবস্থান অনেকটা নিষ্প্রভ হয়ে যায়।
সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের দশা মোটামুটি একই। সব সরকারের সময়েই সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের অনেক তরুণ নেতাকর্মী সতীর্থ ছাত্রদের বন্ধু না হয়ে প্রভু হতে পছন্দ করে। হল দখল ও নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বিরোধী পক্ষ না থাকায় নিজেরা নিজেরাই মারামারি করেছে। নির্মাণকাজে এদের বখরা দেওয়ার হার নাকি এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাই অলিখিতভাবে ঠিক করে দেন। ফলে প্রাধ্যক্ষ থেকে শুরু করে হাউজ টিউটর পর্যন্ত সব শিক্ষক-কর্মকর্তার কাজ নাকি অনেক কমে গেছে। হলবাসী সাধারণ শিক্ষার্থীদের এখন নাকি টিকে থাকার জন্য প্রভু ছাত্রলীগ নেতাদের দ্বারস্থ হতে হয়, প্রাধ্যক্ষ বা হাউজ টিউটরদের কাছে নয়। কিছুদিন আগে নিয়মিত হলবাসী এক ছাত্রের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম তার হলের প্রাধ্যক্ষ ও হাউজ টিউটরদের নাম। প্রাধ্যক্ষ মহোদয়ের নাম বলতে পারলেও তিনি কোন বিভাগের শিক্ষক বলতে পারেনি। হাউজ টিউটরদের অনেকের নাম ও কে কোন দায়িত্ব পালন করছেন তা পারেনি বলতে। হতে পারে ছেলেটি তেমন স্মার্ট নয়, অত কিছুর খোঁজ রাখে না। অথবা হয়তো রাজনীতির ভাইদের ডিঙ্গিয়ে হল প্রশাসনের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না এসব নিরীহের।
এখন বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট সবাই এসব সত্য জানেন। শুধু একটু বেশি বাড়াবাড়ি হওয়ায় ছাত্রলীগের অনাচারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষককে পথে নেমে প্রতিবাদ করতে হয়েছে। ফলে ছাত্রলীগকৃত নৈরাজ্যের বিষয়টি প্রকাশ্য হয়েছে। ছাত্রলীগ নামধারী এ তরুণরা কিন্তু সবাই কোনো না কোনো ভদ্র পরিবারের সন্তান। নিজেদের মেধার গুণে ভর্তি পরীক্ষার নানা প্রক্রিয়ার পথ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিল তারা। সুস্থ ধারায় চলতে পারলে এরাও দেশের সম্পদ হতে পারত। সম্মানিতও হতো। কিন্তু অপরাজনীতির নেশায় ফেলে এসব সম্ভাবনাময় তরুণকে অন্ধকার পথ দেখাচ্ছেন জাতীয় রাজনীতির নেতারা। অস্ত্র আর অর্থশক্তির সহজ অধিকারী হতে পারছে অনেকেই। জাতীয় নেতাদের রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণের হাতিয়ার হিসাবে এরা ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো আদর্শ সামনে রেখে কি এখন ছাত্ররাজনীতি চলছে? ছাত্রলীগের রাজনীতির গৌরবের ইতিহাস কি এখনকার ছাত্রলীগ সদস্যদের জানা আছে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ, ছাত্রদলের নেতাকর্মী আর বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের স্লোগান ধরা শিক্ষকরা নিজ নিজ দলের জাতীয় নেতাদের কাছে নতজানু। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট বাণিজ্য করা ছাত্রলীগের নেতারা প্রাধ্যক্ষ ও হাউজ টিউটরদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করার পরও তারা প্রতিবাদে মাঠে নামেননি। রাস্তায় ব্যানার হাতে প্রতিবাদ করেছেন অন্য ধারার শিক্ষকরা। এমনটিই হওয়ার কথা। কারণ এখন উপাচার্য থেকে হাউজ টিউটর, সব প্রশাসনিক পদ সাধারণত বণ্টন করা হয় শিক্ষক রাজনীতিতে যুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে। তাই একই ঘরানার ছাত্রদের অপমান হজম করতেই হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের লেখা কলাম পড়ছিলাম এক জাতীয় দৈনিকে। তিনি তার এক ছাত্রের উদ্ধৃতি দিলেন। ছাত্রটি হল প্রশাসনের কাছ থেকে হলে সিট বরাদ্দ পেলেও ছাত্রলীগ নেতারা তাকে রুমে উঠতে দেয়নি। অভিযোগ নিয়ে প্রভোস্টকে বলতে গেলে তার সাফ উত্তর, আমাদের দায়িত্ব সিট বরাদ্দ দেওয়া, দিয়েছি। সিটে ওঠার দায়িত্ব তোমার। এতে বোঝা যায় কতটা অসহায় হল প্রশাসন।
পত্রিকার পাতা খুললেই এখন খুন, হেলমেট বাহিনীর সন্ত্রাস, দখল বাণিজ্য, ধর্ষণ সবকিছুতেই ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে। এ বাস্তবতা কি আওয়ামী লীগের জন্য স্বস্তির? আসলে আওয়ামী লীগ নেতাদের আগে স্থির করতে হবে তারা ছাত্রলীগকে কীভাবে দেখতে চান। তারা কি রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকতে লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে ছাত্রলীগকে সামনে রাখতে চান? নাকি ছাত্রলীগকে আদর্শিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে চান? বিস্ময়ের ব্যাপার, ছাত্রলীগের নামে এতসব দুর্নাম জনমনে বিতৃষ্ণা তৈরি করছে কেবল। এর প্রতিক্রিয়ায় দল হিসাবে আওয়ামী লীগও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমি অবাক হই, দেশ ও জনগণের জন্য এককালের রাজপথ কাঁপানো ছাত্রলীগ নেতারা এখন ছাত্রলীগের এতসব স্খলনেও মুখ খুলছেন না। সুপথে ফিরে আসার আহ্বানও জানাচ্ছেন না।
অনেক আওয়ামী লীগ নেতা এবং প্রভাবশালী মন্ত্রী ছাত্রলীগকে শাসন করে সুপথে আনার বদলে সাফাই বক্তব্য দিতেই ব্যস্ত থাকেন। এতে তাদের লাভ কতটা হচ্ছে আর ক্ষতির পরিমাণ কী তা কিন্তু হিসাবে আনছেন না। তারা কি সবকিছুর মতো সমাধান দেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন?
এ বিষয়টি ভাবতে ইচ্ছা হয়, ছাত্রলীগের ব্যানারে এই যে হাজার হাজার তরুণ রয়েছে, ওদের চাঁদাবাজ আর সন্ত্রাসী না বানিয়ে যদি সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনা যেত, তাহলে এ তরুণ সমাজকে দেশোন্নয়নে যুক্ত করা সম্ভব হতো। এমনটি সম্ভব হবে, যদি আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা নিজেদের সাবালক ভাবতে পারতেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হাঁটতে গিয়ে নিজেদের পায়ের প্রতি ভরসা রাখতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই যদি বলি, এখানে সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার কত সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের ছেলেমেয়ে পকেটের পয়সা বাঁচিয়ে চা-সিঙ্গাড়া খেয়ে রিহার্সেল করে সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীদেরই আরেকটি অংশ এসব নন্দনচর্চার ধারে কাছে নেই। এরা উন্মাদনা ছড়াচ্ছে। হলে সিট বাণিজ্য করছে। ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে। মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে কোন্দল তৈরি করে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
এ অবস্থা থেকে তো মুক্তি প্রয়োজন। কিন্তু সাপুড়ে ছাড়া সাপ নিয়ন্ত্রণ করবে কে? সব পক্ষের ভাবা উচিত, জনগণকে অবজ্ঞা করার ফল শেষ পর্যন্ত ভালো হয় না। সন্ত্রাসী তরুণরা শুধু যে ক্যাম্পাসকে অশান্ত করে তোলে তা নয়। তারা সতীর্থ বন্ধুদের মনে আতঙ্ক তৈরি করে। যার যার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তৈরি করে হতাশা। কিন্তু যাদের ছত্রছায়ায় এরা ক্যাম্পাস বিষিয়ে তোলে, তারা যদি সুস্থতা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারটিকে গুরুত্ব না দিয়ে লাঠিয়াল পোষণকে দরকারি মনে করেন, তবে বলার কিছু নেই। এসব কারণে আমরা বলি, আওয়ামী লীগের নেতাদেরই আগে ঠিক করতে হবে, ছাত্রলীগকে তারা কীভাবে দেখতে চান।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com