শুধু প্রবৃদ্ধি নয়, জনমনে স্বস্তি ফেরানোই হোক প্রধান বিবেচ্য
মামুন রশীদ
প্রকাশ: ১০ জুন ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মাননীয় অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে গেল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পরবর্তী জুলাই-জুন অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন। বাজেট প্রস্তাবনা পেশের আগেই বাজেটের লক্ষ্য হিসাবে করোনা-পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতি থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি প্রদান প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত বলে বলা হয়ে আসছিল।
অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার বরাত দিয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় আগামী অর্থবছরের জন্য ছয়টি বিষয়কে প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে চিহ্নিত করেছেন। সংসদে বাজেট বক্তৃতায় তিনি যথার্থই বলেছেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অত্যন্ত কৌশলী হতে হবে। কোনো একটি সমস্যা সঠিকভাবে সমাধান করা না গেলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারে।
যদিও কেউ কেউ বেশ আগে থেকেই প্রাধিকার বিবেচনায় এ বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আলোচনা করে আসছিলেন, অর্থমন্ত্রীর তুলে ধরা চ্যালেঞ্জগুলোও হচ্ছে-মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা; গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান; বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন; অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ এবং ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা।
অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, মূল কৌশল হবে বিদ্যমান চাহিদা কমিয়ে সরবরাহ বৃদ্ধি করা। বলেছেন-আমদানিনির্ভর ও কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ রাখা অথবা কমানো হবে। নিু অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের গতি হ্রাস করা হবে। উচ্চ ও মধ্যম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা হবে।
তিনি আরও বলেন, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের বিক্রয়মূল্য পর্যায়ক্রমে ও স্বল্প আকারে সমন্বয় করা হবে। রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে কর সংগ্রহে অটোমেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। মূল্য সংযোজন কর ও আয়করের আওতা বাড়ানো হবে। বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা হবে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার প্রতিযোগিতামূলক রাখা হবে।
আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি, তিনি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন। এবারের বাজেটের আকার জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর সংগৃহীত কর থেকে পাওয়া যাবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৮ হাজার কোটি টাকা আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা; যা জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। গত বাজেটে এ হার ছিল ৬ দশমিক ২। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে এ ঘাটতি মেটানো হবে বলে জানা গেছে।
অভিজ্ঞতায় আমরা জেনেছি, সংসদে এমনকি সংসদের বাইরেও বাজেট নিয়ে বিশেষ করে অর্থবিল নিয়ে খুব কম আলোচনাই হয়। মারাত্মক কোনো ত্রুটি বা অসংগতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা না হলে বাজেট মোটামুটি সহজেই পাশ হয়ে যায়।
একটি বিকাশমান অর্থনীতিতে সত্যিকারের উৎপাদক শ্রেণি, তরুণ উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার বিষয়টি যেমন সব সময় বিবেচ্য হবে, তেমনি সাধারণ মানুষের অস্বস্তির ব্যাপারটিও প্রাধান্য পাওয়া উচিত। বাজেটে তাদের জন্য গুণগত ব্যয়ের কথাও উচ্চকিত থাকবে। থাকবে জনস্বার্থ প্রকল্পের যথাসময়ে বাস্তবায়ন। থাকবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রণোদনার বিষয়ও। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ন্যূনতম গুণগত মান বজায় রাখার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। থাকবে দুর্নীতি কমিয়ে, নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার বিষয়টিও।
সব ছাপিয়ে উন্নয়ন কিংবা প্রবৃদ্ধির চাইতেও সাধারণ মানুষ সেই প্রবৃদ্ধি থেকে কতটা লাভবান হলেন, জনমনে কতটা স্বস্তি মিলল, তা-ই বিবেচ্য হওয়া উচিত।
মামুন রশীদ : অর্থনীতি বিশ্লেষক