অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আজ সংসদে জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করবেন। এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, দীর্ঘদিন ধরে যে ধারায় বাজেট তৈরি হয়ে আসছে, তাতে শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতের বরাদ্দ ইতোমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে আছে। শেষ সময়ের কিছু সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ থাকলেও আগে থেকে গৃহীত সিদ্ধান্তের খুব একটা হেরফের হওয়ার কথা নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে বরাদ্দ ছিল প্রায় ৩২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে (২০২২-২৩) এ বিভাগে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে প্রায় ৩৯ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। একই মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে চলতি অর্থবছর বরাদ্দ ছিল প্রায় ৯ হাজার ১০ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে প্রস্তাব করা হচ্ছে প্রায় ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ ছিল প্রায় ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছর এ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হচ্ছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। শিক্ষাবিদদের অভিমত, করোনার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাহিদার আলোকে বাজেটকে সাজাতে হবে। অনেক দেশই করোনার ক্ষতি পোষাতে শিক্ষার্থীদের পেছনে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করছে, আমরাও সেদিকে যেতে পারি। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। কর্মবাজারের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় করতে প্রয়োজনে বিশেষ তহবিলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বাজেটে শিক্ষা বরাদ্দ নিয়ে, শিক্ষা নিয়ে কিছু বলার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অর্জনের জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানানো দরকার। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় শতভাগ শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিতকরণ, ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনা, প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ভর্তির ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের সমতা অর্জন, উপবৃত্তি, বছরের শুরুতেই অদিবাসীসহ সব শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, বিপুলসংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্তসংখ্যক নারী শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষা ও সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি। করোনাকালে বর্তমান সরকারের বহুমুখী প্রয়াসের মাধ্যমে উল্লিখিত অর্জনগুলো ধরে রাখার জন্য তারা প্রশংসার দাবি করতে পারেন।
ইউনেস্কো ও শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা, করোনার ফলে পারিবারিক অর্থ সংকট, শিশুশ্রম, বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি, ঝরে পড়া, অপুষ্টিজনিত প্রতিবন্ধকতা ও বাল্যবিবাহের ঝুঁকির কারণে শিক্ষা খাতের বিগত ২০ বছরের অগ্রগতি হুমকির সম্মুখীন হবে। করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার ক্ষতির গভীরতা, ব্যাপকতা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এর অভিঘাত নিরসন ও শিক্ষাব্যবস্থাকে কাঙ্ক্ষিত ধারায় ফেরানোর জন্য সমন্বিত শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া এবং এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রত্যাশিত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভৌত অবকাঠামোর জরুরি সংস্কার, শিক্ষণ-শিখন সামগ্রীর নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ, বিদ্যালয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, নিরাপদ খাবার পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত বিধিব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি তহবিল গঠনও একই সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত।
প্রসঙ্গক্রমে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বিশেষ করে ৪ নম্বর লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি-৪) কার্যকর বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য করব্যবস্থার যুগোপযোগী সংস্কার তথা প্রগতিশীল করার উদ্যোগ নেওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সব অভিভাবক, শিক্ষক প্রতিনিধি ও শিক্ষক সংগঠনগুলোকে যুক্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্য কোনো খাতের সঙ্গে যুক্ত না করে শিক্ষা বাজেট স্বতন্ত্র রেখে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ সুনির্দিষ্ট করে শিক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত দুই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে শিক্ষা কর্মসূচি পালনকারী, তথ্যপ্রযুক্তি, সমাজকল্যাণসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করে একটি সমন্বিত জাতীয় শিক্ষা অর্থায়ন বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব এসেছে শিক্ষা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে। শিক্ষায় অর্থায়নে সরকারের কাম্য ভূমিকার সঙ্গে জনগণের সম্ভাব্য উদ্যোগকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকার, মোবাইল ফোন ব্যবহারকে উৎস হিসাবে বিবেচনা করার পক্ষেও তারা মত দিয়েছেন।
আবার আলোচনায় এসেছে-শিক্ষার পেছনে অভিভাবকের ব্যয় কমেছে, নাকি বেড়েছে? কয়েক বছর আগে ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি হওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে, অভিভাবকদের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এটি চিন্তার বিষয়। অন্যদিকে শিক্ষায় গবেষণার কথা বলতে গেলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে প্রতিটি বাজেটের ১.৫৮ শতাংশ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে প্রতিটি মাত্র ১.১৫ শতাংশ গবেষণায় ব্যয় করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পরিবেশিত এ তথ্য ২০২০ সালের।
লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে। তারপরও বরাদ্দ প্রসঙ্গে, এর সদ্ব্যবহার নিয়ে নীতিমূলক আলোচনার অবকাশ রয়েছে। বাজেটে বরাদ্দ কম হোক, বেশি হোক, তার উপযোগিতা ও ফল নিয়ে মূল্যায়ন হওয়া দরকার। ব্যয়িত অর্থে শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে কতটুকু অর্জন হয়, কী অনার্জিত থাকে, কী পাওয়া যায়, আরও কী পাওয়া সম্ভব ছিল-এসবের পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণ খুব একটা দৃষ্টিগোচর হয় না।
শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, শিক্ষা খাতে ক্রমান্বয়ে বৈষম্য দূর করা হবে-শহর ও গ্রামের, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য, নারী-পুরুষ, সাধারণ ও কারিগরি-বৃত্তিমূলক শিক্ষার মধ্যে বৈষম্যের অবসান ঘটানো হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে অগ্রগতি যে ধীর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অঞ্চল ও জনসংখ্যা অনুপাতে শিক্ষার্থীর মাথাপিছু বরাদ্দ যৌক্তিক না অযৌক্তিক, তা বলাও কঠিন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুদশকেরও বেশ আগে আমাদের এক শিক্ষক সম্মেলনে বলেছিলেন, শিক্ষকদের জন্য পৃথক পে-স্কেল করা হবে। কারণ শিক্ষকতায় দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্নদের আনতে না পারলে শিক্ষার মান বাড়বে না। কিন্তু এর কয়েক বছর পর দেখা গেল শিক্ষকরা বলছেন, আলাদা বেতন স্কেলে দরকার নেই। কারণ যাদের হাতে দণ্ডমুণ্ড, তারা তো শেখ হাসিনা নন। নতুন জাতীয় বেতন স্কেল পেতেই কত কাঠখড় পোড়াতে হয়। কর্তাদের হাতে আমাদের জন্য আলাদা বেতন স্কেলের অর্থ দাঁড়াবে-কী করে জাতীয় বেতন স্কেলের চেয়ে শিক্ষকদের আরও কম দেওয়া যায়!
ইউনেস্কো থেকে বলা হয়েছে, করোনায় মানুষ কেবল খোয়ায়নি, অনেক কিছু অর্জনও করেছে। এবং তার অর্জনের দিকগুলোকে, উদ্ভাবনের দিকগুলোকে অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য দেওয়া উচিত। লেখাটা শেষ করতে চাই একটি পত্রিকার প্রতিবেদনের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে-শহরাঞ্চলে আলোকবৃত্তের মধ্যে বসে আমাদের নজর বেশি দূর যায় না। বেশির ভাগ সামাজিক ক্ষতিকে চিনতে পারি অনেক দেরিতে।
কিন্তু অতিমারি যেমন আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, তেমনি দিয়েছে অনেক কিছু। আমরা দেখেছি মানুষ কীভাবে সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা মানুষের জন্য লড়ে যাচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছুটে যাচ্ছে, হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে অসুস্থ ব্যক্তিকে। এত সাহস, এত প্রাণশক্তিও যে আমাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে, ছিল-তা কি আমরা জানতাম এ বিপদে না পড়লে? এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ও এর যথোপযুক্ত সদ্ব্যবহার মহাবিপদ থেকে উদ্ধারে, অভাবনীয় ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে নতুন নতুন অর্জন ও উদ্ভাবনে সহায়ক হবে-কায়মনোবাক্যে এই সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর অন্যতম প্রণেতা
principalqfahmed@yahoo.com