Logo
Logo
×

বাতায়ন

নতুন শিক্ষাক্রম কি শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল করবে?

Icon

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন শিক্ষাক্রম কি শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল করবে?

স্কুলে সৃষ্টিশীলতা শেখানো যায় কিনা, তা নিয়ে সারা পৃথিবীতেই বিতর্ক আছে। আমাদের এখানেও এ বিতর্ক শুরু হবে, যখন ২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাক্রম আসবে।

কারণ নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল করে তোলা। যারা স্কুলে সৃষ্টিশীলতা শেখানো যাবে না বলে মনে করেন, তারা ধরেই নেন যে সৃষ্টিশীল হওয়া মানে রবীন্দ্রনাথ বা আইনস্টাইনের মতো না হলেও কোনো না কোনো মানের শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী হওয়া। এ কারণেই তাদের মনে হয়, বিশেষ কিছু ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো মানুষই কেবল সৃষ্টিশীল হতে পারে।

এগুলো সবই মিথ। প্রথমত, সব মানুষই সৃষ্টিশীল হতে পারে এবং মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই-রান্নাবান্না, শিক্ষকতা, রাজনীতি, ব্যবসা-সৃষ্টিশীলতার প্রয়োজন হয়। দ্বিতীয়ত, সৃষ্টিশীলতা হঠাৎ করে পাওয়া কোনো অহি নয়; আকাশ থেকে আপেল হয়ে মাথায় পড়লে মাথা ফাটতে পারে, কিন্তু তাতে একজন নিউটন তৈরি হবে না।

পানি হয়ে বাথটাব উপচে পড়লে মেঝে ভিজতে পারে, কিন্তু তাতেই যে একজন আর্কিমেডিসের জন্ম হবে তার নিশ্চয়তা নেই। অন্যান্য দক্ষতা যেমন কষ্ট করে আয়ত্ত করতে হয়, সৃষ্টিশীলতাও তা-ই। তা অনেক পরিশ্রম করে, সময় নিয়ে অর্জন করতে হয়। এ জন্যই সৃষ্টিশীলতা-বিশেষজ্ঞ মনস্তাত্ত্বিক লিএইন গাবোরা সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে তার গবেষণাপত্রের নাম দিয়েছেন ‘হোনিং থিওরি’।

গাবোরার মতে, কোনো কিছু সৃষ্টি করা মানেই সেই বিষয়ের চূড়ান্ত রূপ প্রদান করা নয়। এর মানে সৃষ্টিশীল হতে হলে আপনাকে যে একটা কবিতা লিখে ফেলতে হবে কিংবা কিছু একটা আবিষ্কার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে হবে তা নয়। এটা শুধু একটা প্রক্রিয়াও হতে পারে, যা দিয়ে মানুষ পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে বা তাকে বোঝার চেষ্টা করে। গাবোরা বলেন, যে কোনো কিছু বোঝার প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সৃষ্টিশীলতা। এটা দিয়েই আমরা অতীতের পুনর্গঠন বা ভবিষ্যতের কল্পনা করি। আমরা কে কতটা সৃষ্টিশীল তা অন্তত সাতটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে : ১. কৌতূহল, ২. অস্পষ্টতাকে সহ্য করতে পারার ক্ষমতা, ৩. মুক্ত মন, ৪. মস্তিষ্কের কিছু বিশেষ নেটওয়ার্কের সক্রিয় থাকা, ৫. সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, ৬. ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বর্তমানকে শোষণ করে আত্মস্থ করতে পারা এবং ৭. বাবা-মার কততম সন্তান সেটা।

খেয়াল করলে দেখা যাবে উপরে যেসব বিষয় সৃষ্টিশীলতাকে প্রভাবিত করে বলে উল্লেখ করা হলো, শেষেরটা বাদ দিলে বাকি প্রায় সবই স্কুল কর্তৃপক্ষ চাইলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিংবা স্কুল প্রাঙ্গণে তৈরি করে দিতে পারে।

তাহলে শিক্ষার্থীদের যে শারীরিক ও মানসিক স্তরের জটিল, অভিযোজনযোগ্য, স্ব-সাংগঠনিক, ও বিবর্তনরত কাঠামো আছে, তা দিয়ে তারা তাদের চারদিকের বিষয়াদির মধ্যে অনেক সাইকোলোজিক্যাল এনট্রপি বা ফাঁক খুঁজে পাবে এবং এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। শিক্ষকরা যদি তাদের মনকে এ অনিশ্চয়তা সহ্য করার জন্য তৈরি করে দেন, তাহলে তারা সেই ফাঁকগুলোকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এমনভাবে ভরাট করবে, যাতে জগৎকে নিয়ে তৈরি করা তাদের ধারণার সঙ্গে সেগুলোকে যুক্ত করা যায়। এ প্রক্রিয়ায় কেবল যে কোনো সমস্যার সমাধান হবে তা নয়, এতে তাদের মানসিক কাঠামোতে এমন পরিবর্তন আসবে, যাতে তাদের নিজেদের এবং জগৎ সম্পর্কে ধারণা পালটে যাবে। তারা অন্তত তিন ক্ষেত্রে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবে : ১. বহির্জগতে, ২. অন্তর্জগতে ও ৩. বহির্জগৎ ও অন্তর্জগতে একসঙ্গে। তাদের বহির্জগতের পরিবর্তনটা সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ার ফল হিসাবে দৃশ্যমান হবে। অন্তর্জগতের পরিবর্তনটা যদিও দৃশ্যমান হবে না, কিন্তু তার গুরুত্ব কম নয়। এ পরিবর্তনটাই যে কোনো দেশের সাংস্কৃতিক বিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

স্কুলের সীমিত সামর্থ্যরে কথা চিন্তা করে এর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীরা যেন অন্ততপক্ষে তাদের অন্তর্জগতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে, সে ব্যবস্থা করা। বহির্জগতে যারা পরিবর্তন আনেন তারা, যেমন শেকসপিয়র, নজরুল, বা বিল গেটসরা ঠিক স্কুলের ওপর নির্ভর করেন না। স্কুলগুলোকে অন্তর্জগৎ পরিবর্তনের দায়িত্বটা নিতে হবে, কারণ সাধারণ মানুষরা এটা নিজে নিজে করতে পারে না। একটা প্রমাণ দেওয়া যাক। একদিন প্রাতঃভ্রমণকালে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আমার কাছে এসে বললেন, একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি? অনুমতি দিলাম। তিনি বললেন, ধরুন, আপনি কোনো এক গোধূলিলগ্নে একটা পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। হঠাৎ উপরে তাকিয়ে দেখেন কোনো এক দোতলায় জানালার শিক ধরে এক সুন্দরী দাঁড়িয়ে আছে। এত সুন্দর যে কনে-দেখা আলোর প্রয়োজন ছিল না। আপনি খেয়াল করলেন, মেয়েটা খুব বিষণ্ন ভঙ্গিতে শাড়ির আঁচলটা দাঁত দিয়ে চেপে উদাস দৃষ্টিতে দূরের রঙিন দিগন্তে তাকিয়ে আছে। দুচোখের কোণে দুফোঁটা পানি। আপনাকে বলতে হবে, মেয়েটার কী হয়েছে।

আমার কাছে উত্তরটা এত সহজ মনে হলো যে চিন্তা করার জন্য কোনো সময়ই নিলাম না। যেসব রোমান্টিক কবিতা, গল্প, নাটক বা সিনেমা আমার পড়া বা দেখা ছিল, তার আলোকেই চট করে বলে দিলাম, মেয়েটা বিরহ কাতর; তার প্রেমিক হয়তো দূর দেশে আছে; এ রকমই কোনো এক সোনাঝরা যুগল সন্ধ্যার কথা ভেবে কাঁদছে সে। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু? আমার মাথায় আর কিছু এলো না। ভদ্রলোক হেসে বললেন, আপনি হয়তো শোনেননি, মেয়েটি দাঁত দিয়ে শাড়ির আঁচল চেপে ধরেছিল, ওর আসলে দাঁতে ব্যথা। সেদিন ওই ভদ্রলোক আমার চোখ খুলে দিলেন। আমার মতো সাধারণ শিক্ষিত মানুষ যদি চোখের সামনে থাকা সবচেয়ে স্বাভাবিক ও সবচেয়ে যৌক্তিক বিষয়টা দেখতে না পায়, তাহলে বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই যে এ অবস্থা হবে, তা বলাই বাহুল্য।

সাধারণ মানুষের এই সৃষ্টিশীলতাটুকু না থাকলে বড় বড় সৃষ্টিশীল মানুষ তৈরি হতেন না, আর হলেও বিপদে পড়তেন। যেমন প্লেটোর গুহারূপকের সত্যসন্ধানী মানুষটি নিগ্রহের শিকার হন। এদের কারণেই সক্রেটিসকে হেমলক পান করতে হয়। এদের কারণেই সূর্যকেন্দ্রিক পৃথিবী আবিষ্কারের পরও কোপার্নিকাস মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন; গ্যালিলিও গৃহে অন্তরীণ হন, ভানিনিকে পুড়ে মরতে হয়। এদের কারণেই আব্রাহাম লিংকন আচমকা গুলিবিদ্ধ হন। এদের কারণেই মার্টিন লুথার কিংয়ের স্বপ্ন পূরণ হয় না, তার হত্যাকাণ্ডের অনেক পরও জর্জ পেরি ফ্লয়েডকে সাদা পুলিশের হাঁটুতে পিষ্ট হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে হয়। এদের কারণেই নাথুরাম গডসে মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করার সাহস পায়; নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ চব্বিশ বছর কারান্তরালে থাকেন; বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে তারই তিল তিল করে গড়ে তোলা দেশে, তারই বাড়িতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

এ জন্যই বলছিলাম শিক্ষার্থীদের অন্তর্জগতে পরিবর্তন নিয়ে আসার যে সৃষ্টিশীলতা, তা শেখানো জরুরি এবং সম্ভবও বটে। সেভাবেই এখন নতুন শিক্ষাক্রমের পাইলটিং চলছে; শিক্ষার্থীরা প্রবল উৎসাহে নানা রকম সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে যে সত্যি সত্যি আমাদের শিক্ষার্থীদের চোখ, মুখ ও রক্ত টগবগিয়ে হাসতে পারে, সেটা ওই ক্লাসগুলোতে পা দিলেই বোঝা যায়। তবে তাদের এ চিত্ত-চাঞ্চল্যকে সত্যিকারের সৃষ্টিশীলতায় রূপান্তরের জন্য আমাদের আরও বস্তুনিষ্ঠ পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক : মাউশির সাবেক মহাপরিচালক

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম