স্বদেশ ভাবনা
চালের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতেই হবে

আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ফটো
দেশে সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদনকারী (৫৫ শতাংশ) বোরো ফসলের ভরা মৌসুমে হু হু করে চালের দাম বাড়ার কারণ নির্ণয় করেছে খাদ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা খাদ্য মন্ত্রণালয়। গত ২৯ মে ‘বোরো ২০২২ মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও বাজার মনিটরিং সংক্রান্ত অনলাইন মতবিনিময় সভায়’ ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, মিল মালিকগণ ও করপোরেট হাউজগুলোর মধ্যে ধান কিনে মজুত করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
অধিকাংশ মিল মালিক বাজার থেকে ধান কিনলেও তারা চাল উৎপাদনে যাচ্ছেন না। বাজারে নতুন চাল এখনো আসছে না। এখন বাজারে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে, তা গত বছরের পুরোনো চাল। তাছাড়া বিভিন্ন করপোরেট হাউজ ধান-চালের ব্যবসা শুরু করেছে। তারা বাজার থেকে ধান কিনে মজুত করছেন এবং প্যাকেটজাত করছেন। প্যাকেটজাত চাল বেশি দামে বাজারে বিক্রিও হচ্ছে (যুগান্তর, ৩০ মে)। বলার অপেক্ষা রাখে না, বোরো ফসল কাটা-মাড়ার ভরা মৌসুমে বাজারে নতুন চাল না আসার কারণে পণ্যটির দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে, যা গরিব, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ভোক্তাদের দিশেহারা করে তুলেছে। খাদ্যমন্ত্রী মিল মালিকদের কাছ থেকে ধান কেনা ও চাল ক্রাশিংয়ের তথ্য সংগ্রহ এবং করপোরেট হাউজগুলোর সঙ্গে বৈঠক করার কথা বলেছেন। এসব পদক্ষেপের ফলে চালের বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কতটা স্বাভাবিক হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ফলাফল নেতিবাচক হলে চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে এবং চালের অস্থিতিশীল বাজারকে স্থিতিশীল করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে।
এক গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুন মাসে ধানের মজুতে বড় ও মাঝারি কৃষকের অংশ ছিল ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গাচাষিদের ঘরে মৌসুম শেষে বিক্রির জন্য কোনো ধান থাকে না বিধায় তাদের এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বাকি ৮০ শতাংশের মধ্যে ৬০ শতাংশের কিছুটা বেশি মজুত ছিল চালকল মালিকদের কাছে। অবশিষ্ট কম-বেশি ২০ শতাংশ মজুত ছিল ধান ব্যবসায়ীদের কাছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে চাল রপ্তানিকারক দেশগুলো আগামীতে চাল রপ্তানি বন্ধ বা হ্রাস করতে পারে-এমন ধারণা থেকে চালকল মালিকরা আগের ধান কাটা-মাড়ার মৌসুমগুলোর চেয়ে চলতি বোরো মৌসুমে বেশি পরিমাণে ধান কিনে মজুত করছেন। তাদের আশা, মজুত ধান চালে রূপান্তর করে সময়-সুযোগ মতো বেশি দামে বিক্রি করে তারা প্রচুর লাভ করবেন। আগের মতো চলতি বোরো মৌসুমেও দেশে উৎপাদিত মোট বোরো ধানের অতি সামান্য অংশ সরকার কৃষকের কাছ থেকে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে হাওড়ে বন্যায় ৮০ হাজার টন চাল নষ্ট হওয়ার পরও এবার বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৭ লাখ টনের উপরে চাল উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ধানের আকারে পরিমাণ দাঁড়াবে কম-বেশি ৩ কোটি টন। সরকার চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে মাত্র ৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর সুযোগ নিয়েছেন চালকল মালিকরা। কাটা-মাড়ার মৌসুমে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে কম দামে বোরো ধান কিনে মজুত করছেন চালকল মালিকরা। আসলে অনেক বছর ধরে তারা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আসছেন। গত কয়েক বছর দেশে বোরো ও আমন ফসলের উৎপাদন এবং সরকার কর্তৃক কৃষকের কাছ থেকে কেনা ধানের পরিমাণ থেকেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে। সরকার চাল সংগ্রহে পুরোপুরিভাবে চালকল মালিকদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় তারা মৌসুমে কম দামে ধান কিনে ধান থেকে তৈরি চাল সরকারকে সরবরাহ করে এবং অবশিষ্ট চাল পরবর্তী সময়ে সুযোগ বুঝে বাজারে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ লাভ করে আসছেন।
খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, অধিকাংশ চালকল মালিক বাজার থেকে ধান কিনলেও তারা চাল উৎপাদনে যাচ্ছেন না। এতে চালের দাম বাড়াই স্বাভাবিক। চলতি সপ্তাহে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) চালের দাম ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। পাইকারিতে দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। বাজারে কেজিপ্রতি মোটা চালের দাম ৫০ টাকা ছুঁইছুঁই করছে। আর কেজিপ্রতি সরু চালের দাম বেড়ে ৭০-৮০ টাকা হয়েছে। সুগন্ধি চাল প্রতি কেজি ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বিবিএসের সর্বশেষ হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬ মোতাবেক, জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট আয়ের ৪৭ দশমিক ৭০ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। গরিব ও অতিগরিব পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। আবার তাদের চাল ভোগের পরিমাণও অন্যদের চেয়ে বেশি। যখন দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চালের মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ৪৭০ গ্রাম, তখন অন্যদের ক্ষেত্রে তা ৩৬৬ গ্রাম। প্রধান এ খাদ্যপণ্যটির মূল্যস্ফীতিতে তারা ভোগেন সবচেয়ে বেশি। বিআইডিএসের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্য-মূল্যস্ফীতি বাড়লে ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতদরিদ্র পরিবারই চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। দরিদ্র পরিবারের বেলায় এ হার ৬৬ শতাংশ। তাই চালের দাম উচ্চহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় অতিগরিব ও গরিবদের খাদ্যনিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়ে।
শুধু গরিব ও অতিগরিবরা নয়, চালের দামবৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরাও, বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। চালের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের আমিষজাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হয়। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের পুষ্টির অভাব ঘটে। এতে অবনতি ঘটে তাদের স্বাস্থ্যের। তাছাড়া এসব পরিবারকে কমিয়ে দিতে হয় শিক্ষা খাতে ব্যয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। সংকুচিত করতে হয় তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই খাদ্যের, বিশেষ করে চালের মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের কাছে ভীতিকর।
এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। বাজারে চালের সরবরাহ স্বাভাবিক করতে সরকারকে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিতে হবে। এক. চালকল মালিক এবং চাল ব্যবসায় নিয়োজিত করপোরেট হাউজগুলো কোন সময় কী পরিমাণ ধান চাল তৈরির জন্য মজুত রাখতে পারবে, সে সম্পর্কে ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ, ১৯৫৬’, ‘অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি নিয়ন্ত্রণ আদেশ, ১৯৮১’ এবং ‘দ্য ফুড গ্রেইন সাপ্লাই (প্রিভেনশন অব জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিটি) অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৯’-এ সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই। মন্ত্রিপরিষদ ‘খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহণ, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন, ২০২২-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এটি বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হবে। উপর্যুক্ত বিষয়টি খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত না হয়ে থাকলে সংসদে বিবেচনার সময় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
দুই. কৃষিতে প্রবৃদ্ধিহার ঊর্ধ্বমুখী করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। বিবিএসের সাময়িক প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে কৃষিতে প্রবৃদ্ধিহার হবে ২ দশমিক ২০ শতাংশ, ২০০৯-১০ অর্থবছরে যা ছিল ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধিহার বাড়লে খাতটির প্রধান উপখাত শস্য উপখাতের প্রধান ফসল ধানের উৎপাদনও বাড়বে।
তিন. সরকারি গুদামে চাল সরবরাহের জন্য চালকল মালিকদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরতা কমিয়ে আনা যায় কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। বিকল্প উপায় হিসাবে ২০০৬ সালের জাতীয় খাদ্য নীতিতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্যশস্য কেনার বিধান রয়েছে। সরকারি গুদামে চাল সরবরাহের জন্য চালকল মালিকদের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না করে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে কিছু পরিমাণ চাল সংগ্রহ করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
চার. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গমের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে। উল্লেখ্য, এ দুটি দেশ যৌথভাবে প্রায় ৩০ শতাংশ গম রপ্তানি করে। গমের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এর প্রভাবে দেশে গমের দাম হু হু করে বেড়েছে। দুই কেজি আটার প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ১০৮ থেকে ১১৫ টাকায়। এতে পণ্যটির দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। ফলে আটা-ময়দার ভোক্তারা চালের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। চালের ওপর চাপ কমাতে দেশে গমের বার্ষিক উৎপাদন বর্তমানের ১০-১১ লাখ টন থেকে কমপক্ষে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরের উৎপাদন পর্যায়ে (১৯ লাখ টন) নিতে হবে।
পাঁচ. আগামী ছয় মাসে দেশে চালের সম্ভাব্য মজুত ও চাহিদা অবিলম্বে নির্ধারণের ব্যবস্থা নিতে হবে। চলতি মৌসুমে আকস্মিক বন্যায় হাওড়াঞ্চলে কম-বেশি ১০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ফসল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় এবং চলমান ঝড়-বৃষ্টির কারণে দেশের প্রায় সর্বত্র মাঠে পাকা বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কী পরিমাণ বোরো চালের উৎপাদন কমে যাবে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মজুত ও চাহিদার পরিমাণ নির্ধারণের পর জরুরি ভিত্তিতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় চাল আমদানির ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে চাল রপ্তানিকারক দেশগুলো চালের রপ্তানি হ্রাস করতে পারে। সেক্ষেত্রে আরও উচ্চমূল্যে চাল আমদানি করতে হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com