স্বদেশ ভাবনা
বিভ্রান্তিকর তথ্য খাদ্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ২৪ মে ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আবারও মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০০-২০২১ অর্থবছরে বিবিএস ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের খাদ্যশস্য উৎপাদনের তথ্যে ব্যবধান ৪০ লাখ টনের বেশি। এটি নতুন নয়।
এর আগেও এমনটি ঘটেছে এবং তার খেসারত জনগণকে দিতে হয়েছে। এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। খোদ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন-বিশ্বব্যাংক, ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইন কাউন্সিল (আইজিসি), খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দিয়েছে।
এই যখন অবস্থা, তখন আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয় দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনের বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ করছে। এতে একদিকে যেমন সরকারের খাদ্য ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তেমনি অন্যদিকে খাদ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। চাল, গম, ভুট্টা, ভোজ্যতেলসহ খাদ্যপণ্যের লাগামহীন উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
একটি দৈনিকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের পাশাপাশি ভোক্তাদের সুরক্ষায় প্রয়োজন কৃষিপণ্য উৎপাদনের সঠিক তথ্য। উৎপাদন কম হলে দ্রুত আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং বেশি হলে আমদানি বন্ধ কিংবা শুল্কারোপের প্রয়োজন হয়। তবে দেশে সরকারি প্রধান দুটি প্রতিষ্ঠানের খাদ্যশস্য উৎপাদনের তথ্যে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের বৈসাদৃশ্য। গত অর্থবছরে (২০২০-২১) বিবিএস ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের খাদ্যশস্য উৎপাদনের তথ্যে ব্যবধান রয়েছে ৪০ লাখ টনের বেশি। বিবিএস বলেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ২৮ লাখ ৯ হাজার টন। আর খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, একই অর্থবছরে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ৬৮ লাখ ২৯ হাজার টন। এই হিসাবে খাদ্যশস্য উৎপাদন নিয়ে সরকারি এ দুই সংস্থার তথ্যে ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ৪০ লাখ ২০ হাজার টন। শস্যভিত্তিক উৎপাদন বিবরণীতে বলা হয়েছে, বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে আউশ চাল উৎপাদন হয়েছে ৩২ লাখ ৮৫ হাজার টন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, একই অর্থবছরে আউশ চাল উৎপাদন হয়েছে ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার টন। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে আমন চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ১ কোটি ৪৪ লাখ ৩৮ হাজার টনে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে একই অর্থবছরে আমন চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৫৬ লাখ ১১ হাজার টন। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বোরো চাল উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৯৮ লাখ ৮৫ হাজার টনে। আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, একই অর্থবছরে বোরো চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৫ লাখ ৮১ হাজার টন।
শুধু চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রেই যে কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিবিএসের তথ্যে পার্থক্য রয়েছে তা নয়, দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গম ও ভুট্টা উৎপাদনের তথ্যের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে গমের উৎপাদন ১২ লাখ ৯৯ হাজার টন হলেও বিবিএসের তথ্যে তা ১০ লাখ ৮৫ হাজার টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ভুট্টা উৎপাদন ৫৬ লাখ ৯৩ হাজার টন হলেও বিবিএসের হিসাবে তা ৪১ লাখ ১৬ হাজার টন।
কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক খাদ্যশস্য উৎপাদনের অতিরঞ্জিত তথ্য প্রদান নতুন নয়। এ বিষয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮৭ লাখ টনে। কিছুদিন পর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া হিসাবে ওই অর্থবছরে চালের প্রকৃত উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৬৬ লাখ টনে। বিবিএসের হিসাবের সঙ্গে ডিএইর হিসাবের পার্থক্য দাঁড়ায় ২১ লাখ টনে। অর্থাৎ ডিএই ২১ লাখ টন বেশি চাল উৎপাদনের তথ্য সরবরাহ করে। এই যখন অবস্থা, তখন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক বলেছিলেন, দেশের চাহিদা মিটিয়ে সাড়ে ৫৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে।
ডিএই ও ব্রির এমন অতিরঞ্জিত তথ্যের কারণে সঠিক সময়ে চাল আমদানি করতে পারেনি সরকার-স্বয়ং খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এ অভিযোগ করেন। সংবাদ সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ করা তথ্যের চেয়ে প্রায় ২১ লাখ টন কম চাল উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। উৎপাদনের সঠিক তথ্যটি যথাসময়ে জানা গেলে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত। সময়মতো চাল আমদানিতে ব্যর্থতার কারণে চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। নিুবিত্ত, গরিব ও অতিগরিবদের খাদ্যনিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) খাদ্যশস্য উৎপাদনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্যমাত্রা এবং বিবিএসের প্রাক্কলনের মধ্যেও ব্যবধান দেখা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার টন আউশ চাল উৎপাদন হবে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও বিবিএসের প্রাক্কলন হচ্ছে চলতি অর্থবছরে আউশ উৎপাদন হবে ৩০ লাখ টন। চলতি অর্থবছরে কৃষি মন্ত্রণালয় ২ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার টন বোরো চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও আকস্মিক বন্যায় হাওড়াঞ্চলে কমবেশি ১০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ফসল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় এবং চলমান ঝড়-বৃষ্টির কারণে দেশের প্রায় সর্বত্র পাকা বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সম্ভাবনা খুবই কম।
এসব তথ্যবিভ্রাট ঘটছে এমন এক সময়ে, যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা জোরদার হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অতিসম্প্রতি বলেছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত সমাধান করা না গেলে আগামী মাসগুলোতে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।’
এর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বেড়ে চলা খাদ্য সংকট বিশ্বকে একটি মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে আগামী মৌসুমে (২০২২-২৩) খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক মজুদ কমার পূর্বাভাস দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইন কাউন্সিল (আইজিসি)। খাদ্য রপ্তানিকারক দুই দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘাতের ফলে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। সংস্থাটি বলেছে, ২০২২-২৩ সালে ইউক্রেনে খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস পাবে, কারণ দেশটির ২০ থেকে ৩০ শতাংশ জমি অনাবাদি থাকবে। আর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রধান ডেভিড বিসলি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যের দাম এতটাই বেড়ে যেতে পারে যে, তা বিশ্বের দরিদ্র মানুষের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। খাদ্যশস্যের দাম হু হু করে বেড়ে চলেছে। চাল উৎপাদনে দেশ স্বনির্ভরতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলেও প্রায় প্রতিবছর বেশকিছু পরিমাণ চাল আমদানি করতে হচ্ছে।
বোরোর ভরা মৌসুমেও বাড়ছে চালের দাম। চাল দেশের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষের প্রধান খাদ্য হওয়ায় চালের মূল্যবৃদ্ধিতে ভোক্তার নাভিশ্বাস আরও তীব্র হয়েছে। দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গমের চাহিদার (বছরে কমবেশি ৭০ লাখ টন) পাঁচ ভাগের চারভাগ মেটানো হয় আমদানির মাধ্যমে। বৈশ্বিক গমের বাজারে ৩০ শতাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধের কারণে পণ্যটির রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে। ভারতের গম রপ্তানি বন্ধের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দামে অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি করেছে। আমদানিনির্ভর পণ্যটির আকাশছোঁয়া দামে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের ভোক্তারা। তাছাড়া অতিউচ্চমূল্যে পণ্যটির আমদানি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চল থেকে সূর্যমুখী তেলসহ সব ধরনের ভোজ্যতেল সরবরাহ বন্ধ থাকায় এবং এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়া আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় (সম্প্রতি এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে) ভোজ্যতেলের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের উচ্চমূল্য এবং সরকারের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে পণ্যটি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এদেশের কৃষি, বিশেষ করে ধানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে সারের ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়া ও বেলারুশ প্রধান বৈশ্বিক সার রপ্তানিকারক দেশ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক রাশিয়ার ওপর আরোপিত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এ বাজারগুলোকে ব্যাহত করেছে। বাংলাদেশ তার পটাশ চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ রাশিয়া (৩৪ শতাংশ) ও বেলারুশ (৪১ শতাংশ) থেকে আমদানি করে। সারের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে অন্য দেশ থেকে পণ্যগুলো আমদানি করতে হবে এবং এতে করে বেশি দাম দিতে হবে। এর ফলে সারের ব্যবহার কম হবে, বিশেষ করে নাইট্রোজেনভিত্তিক সারের, যা চালের উৎপাদন হ্রাস এবং চালের আমদানি বৃদ্ধি করতে পারে।
এ অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক দেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের অতিরঞ্জিত তথ্য প্রদান নীতিনির্ধারক, পরিকল্পনাবিদ এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষকে ভুল সিগন্যাল দেবে, যা দেশের খাদ্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। তাই কৃষি মন্ত্রণালয় এবং ডিএই’র উচিত হবে দেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের সঠিক তথ্য তুলে ধরা। এর ব্যতিক্রম দেশের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com