আন্দোলন আর সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান সফল পরিণতি লাভ করে। নতুন করে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯১ সাল থেকে সরকারব্যবস্থায় আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি নতুন টার্ম সংযুক্ত হয়, যেগুলো আগে কখনো ছিল না। এ সময় (১৯৯১) থেকে পৌনঃপুনিকভাবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত ও পরিচালিত হওয়ায় উভয় সরকারই টার্মগুলো ব্যবহার করেছে। যেমন ‘গণতান্ত্রিক সরকার’, ‘ঐকমত্যের সরকার’, ‘জোট সরকার’, ‘মহাজোট সরকার’। একইসঙ্গে কম আর বেশি উল্লিখিত সরকারগুলো নিজেদের ‘শিক্ষাবান্ধব সরকার’ বা ‘শিক্ষকবান্ধব সরকার’ বলেও দাবি করেছে, দাবি করে আসছে।
কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিস্থিতি-পরিবেশ পরিদৃষ্ট হয় মূলত ওই সময় থেকেই। ইত্যবসরে প্রতিষ্ঠিত হয় দুটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান-জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি যুগের চাহিদা অনুযায়ী একে একে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের অশুভ প্রতিযোগিতা এবং প্রভাবশালী মহলের অপরিণামদর্শিতার ফলে দীর্ঘদিনে তিল তিল করে গড়ে ওঠা গোটা ব্যবস্থাটিই আজ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ সবকিছুর জন্য দায়ী প্রধানত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
গত তিন দশকে (১৯৯২-২০২২) যেখানে-সেখানে এবং যখন-তখন ইচ্ছামাফিক অনার্স কোর্স খুলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার যে ক্ষতি করা হয়েছে, আর কোনো ক্ষেত্রে বোধকরি ততটা হয়নি। এ ধ্বংস সাধনের শুরু হয়েছে মূলত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর। একশ্রেণির অপরিণামদর্শী ও লোভাতুর ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতার মাশুল দিতে হচ্ছে গোটা জাতিকে। কেবল কি অনার্স? একইভাবে চালু করা হয়েছে কলেজে কলেজে মাস্টার্স কোর্স। কোনো বোধ-বিবেচনা ছাড়া অনুমোদন দেওয়া হয় ডিগ্রি পাস কোর্সের। জানি না এর শেষ কোথায়।
সহজে হৃদয়ঙ্গমের সুবিধার্থে এখানে অতীত থেকে খানিকটা আলোকপাত করি। ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন ও বরিশালের ব্রজমোহন কলেজসহ দু-চারটি কলেজে দু-একটি বিষয় করে অনার্স খোলা হয়। এর নয়-দশ বছর পর ১৯৭২ সালে সারা দেশে অনার্স পড়ার কলেজ ছিল আনুমানিক ২০টি। ১৯৮০ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে আমি যখন অনার্স পরীক্ষায় অবতীর্ণ হই, সারা দেশে তখন মোট ২৬টি কলেজে অনার্স পড়ার ব্যবস্থা ছিল আর পরীক্ষার্থীর মোট সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ২০০।
১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেল। তখন থেকেই শুরু হয় লোভ ও স্বার্থ চরিতার্থ করার খেলা। যাকে বলা যায় খামখেয়ালিপনা আর অপরিণামদর্শিতার চূড়ান্ত! ‘চারদিকে এ কী শুনি, অনার্সের জয়ধ্বনি’। ২০১১ সালে একসঙ্গে উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন স্তরে মোট ১০০ কলেজে অনার্স খোলার অনুমোদন দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী, ২০০৩ সালে অনার্স ছিল ১৩১টি কলেজে, ১০ বছরের ব্যবধানে (২০০৩-২০১২) ২০১২ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৪১৬-তে। এভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৪ সালে ৫৫৭টি, ২০১৫ সালে ৬১৯টি, ২০১৬ সালে ৬৮৫টি, ২০১৭ সালে ৭১৮টি এবং ২০১৮ সালে ৭৬৪টি। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০ সালের পকেট ডায়েরিতে উল্লিখিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৮৫৭টি। সর্বশেষ (২০২২) পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ৮৭৯টি কলেজে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করা হয়। অনার্স পাঠদান ও গ্রহণোপযোগী কলেজের এমন সংখ্যাবৃদ্ধির হারকে গাণিতিক বা জ্যামিতিক অথবা আর কী বলা যায়, তা আমার মাথায় আসছে না।
একই পরিস্থিতি ডিগ্রি পাস কোর্সের বেলাতেও। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনতা থেকে আনুমানিক ৫৫০ কলেজ নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। মাত্র আট-নয় বছরের ব্যবধানে ২০০০ সালেই ডিগ্রি স্তরের কলেজের সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১ হাজারে। আর বর্তমানে (২০২২) ২ হাজারের বেশি (আনুমনিক ২ হাজার ২৫০টি)।
সারা দেশ বা সব জেলা নয়, এখানে আমার নিজ জেলার উচ্চশিক্ষার কথা কিছুটা উল্লেখ করি। ১৯৪৩ সালে কিশোরগঞ্জ সদরে গুরুদয়াল কলেজ স্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় জেলার উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম। ১৯৪৭ সালে ভৈরব হাজী আসমত কলেজ দ্বিতীয় এবং ১৯৬৪ সালে স্থাপিত বাজিতপুর কলেজ জেলার তৃতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান [২২ বছরের ব্যবধানে (১৯৪৩-১৯৬৪) কলেজ প্রতিষ্ঠা তিনটি]। ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ডিগ্রি স্তরের সব কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। ১৯৯৪ সালে অনার্স চালু হয় গুরুদয়াল কলেজে। বর্তমানে কিশোরগঞ্জের ডিগ্রি স্তরে পাঠদানকারী কমপক্ষে ২৫টি কলেজের মধ্যে ১৫টিতে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু আছে। কলেজ স্থাপন, ডিগ্রি কিংবা অনার্স খোলার অনুমোদন, শিক্ষা প্রশাসন ও পাঠদানের ক্ষেত্রে সব জেলা তথা গোটা দেশেরই বলতে গেলে একই চিত্র। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমাদের গর্বের কোনো শেষ নেই। আর মান? তা তো চোখের সামনেই ভাসছে; দেশে চোখ-কান খোলা মানুষের সংখ্যাটি একেবারে কম নয়। এখানে সবকিছু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বলার দরকার আছে বলে মনে করি না। সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে মনোনিবেশ করলে সহজেই বোঝা ও জানা যায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২ হাজার ২৫০টি ডিগ্রি স্তরের কলেজ। এর মধ্যে ৮৭৯টিতে অনার্সে পাঠদান করা হয়। মাস্টার্স কোর্স রয়েছে, তা-ও অন্তত দেড়-দুশ কলেজে। অনেক কিছু থাকলেও কী যেন নেই আমাদের। ফলে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সবার মাঝেই এক ধরনের অস্বস্তি ও অস্থিরতা।
অতীব আক্ষেপের বিষয় হলো, বিগত তিন দশকেও বৃহৎ কলেবরের এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠতে পারেনি। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন মহলসহ সবার মনের সংশয়-সন্দেহ আর অস্বস্তির ওপর ভর করে কোনোরকমে যেন পথ চলছে আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক