Logo
Logo
×

বাতায়ন

সাতবাড়িয়া গণহত্যা

Icon

মো. আবদুল লতিফ

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২২, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাতবাড়িয়া গণহত্যা

গত ১২ মে ছিল সাতবাড়িয়া গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে গ্রামবাসীর ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও লুটপাট চালায় দখলদার পাকিস্তান বাহিনী। সেই ঘটনা সংক্ষেপে তুলে ধরছি এখানে। ১১ মে বিকালে পদ্মার চর থেকে গ্রুপের সবাইকে ছেড়ে বাড়ি এলে মায়ের পীড়াপীড়িতে রাতে বাড়িতেই থাকতে হয় আমাকে। কিন্তু অজানা আতঙ্কে বারবার ঘুম ভেঙে যায়। ভোরে ফজরের আজানের সময় ঘর ছেড়ে বাড়ির সামনে মাঠের খোলা বাতাসে একটা চেয়ার নিয়ে বসি। তখনো অন্ধকার। এমন সময় স্থানীয় হাইস্কুলের কেরানি বাবু বিমল চৌধুরী একটি কাপড়ের ব্যাগ হাতে আমাদের বাড়িতে এলেন। আমাকে খুব আস্তে আস্তে বললেন, ‘তোর বাবাকে একটু তাড়াতাড়ি ডেকে দে।’ আমার বাবাকে ডাকতেই তিনি বাইরে এলে বিমল চৌধুরী তার সঙ্গে খুব সংগোপনে কিছু কথা বলেই দ্রুত নিরাপদ স্থানের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পরপরই আমার বাবা আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ছেড়ে নদীর ধারে খেয়াঘাটে যেতে বলে হাঁটতে শুরু করলেন। আরও বললেন, মিলিটারি আসবে, খুব তাড়াতাড়ি এসো। শার্ট-লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই বাবাকে ফলো করে হাঁটতে লাগলাম। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে খেয়াঘাট।

যাওয়ার পথে আমার সহপাঠী স্বপনকে ঘুম থেকে ডেকে উঠিয়ে বললাম-মিলিটারি আসছে, চল, চরে চলে যাই। স্বপন একটা হালকা নীল শার্ট হাতে নিয়ে খালি গায়ে আমার সঙ্গে দ্রুত খেয়াঘাটে চলে আসে। কিন্তু বারবার বলার পরও সে নদী পার হয়ে চরে যেতে রাজি হয় না। ওদিকে আমার বাবা ঘাটে একটা নৌকা ধরে রাখেন। সেই নৌকায় একটা হিন্দু পরিবার ছিল। আমাকে খুব তাড়া দিয়ে বাবা নৌকায় উঠিয়ে দেন। আমি নৌকায় উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার বাবা ও স্বপন কেউই নেই। তখনো সূর্য ওঠেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাঙার মানুষ মিলিটারি মিলিটারি বলে দৌড় শুরু করে। আমার বাবা এ স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাড়ি এসে ছোট ভাইবোনদের নিয়ে দৌড়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। স্বপনও ওর বাবাকে দোকান থেকে ডেকে নিরাপদ স্থানের দিকে দৌড় শুরু করে।

মানুষের দৌড়াদৌড়ি দেখে আমাদের নৌকা আরও দু-একজনকে নিয়ে পদ্মার ওপারে রাজবাড়ীর দিকে রওয়ানা হয়। দু-একশ গজ দূরে নদীর ভেতর যেতে না যেতেই একটু দূর থেকে মেশিনগানের বার্স্ট ফায়ারের শব্দ শোনা গেল। মাঝি-মাল্লা ও ৮-১০ জন যাত্রীসহ নৌকা যখন পদ্মার মাঝখানে, তখন মেশিনগানের গুলি নদীর ভেতরে আসতে শুরু করে। আমাদের নৌকা ছাড়া আরও অনেক নৌকা নদী পার হচ্ছিল। মেশিনগানের গুলির তীব্রতা দেখে হিন্দু পরিবার ‘হরি হরি, রাম রাম’ বলতে শুরু করে। মাঝি-মাল্লা জোরে জোরে বৈঠা চালাচ্ছে, আমরা কেউ হাত দিয়ে, কেউবা চরাট দিয়ে নৌকায় বসে বৈঠা টানছি। আর শুনছি মানুষের চিৎকার, অনবরত গুলির শব্দ। পানির মধ্যে অনবরত গুলি পড়লেও আমাদের নৌকায় একটি গুলিও লাগেনি।

১০-১৫ মিনিটের মধ্যে আমাদের ছোট নৌকাটি রাজবাড়ীর হাবাসপুরের দিকে পদ্মার চরে পৌঁছায়। নারী-শিশুসহ সবাই নৌকা থেকে নেমে বালুরচর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। নৌকা ছেড়ে মাঝি-মাল্লাসহ আমিও দৌড়াতে শুরু করি। ওই সময় পাক আর্মির মেশিনগানের গুলির বুলেট বালির চরে এসে পড়তে থাকে। দূরত্বের কারণে কারও গায়ে লাগেনি এবং কেউ আহতও হয়নি। হাবাসপুরের চরে গিয়ে উঠলাম আমরা। তখন পদ্মা কোথাও কোথাও এক/দেড় কিলোমিটার প্রশস্ত ছিল। নদীর ভেতর যেসব নৌকা ছিল, সবই হাবাসপুরের চরে চলে আসে। কিন্তু সাতবাড়িয়া এলাকায় তখনো চলছে বাঙালি নিধনযজ্ঞ। কোথাও বার্স্ট ফায়ার করে, কোথাও লাইনে দাঁড় করিয়ে এক গুলিতে ৮-১০ জনকে মারা হচ্ছিল। কোথাও ঘর থেকে ধরে এনে, কোথাও রাস্তার ধারে, কোথাওবা নদীর ধারে সারিবদ্ধ করে বার্স্ট ফায়ারে মানুষ মারার পৈশাচিক খেলা চলছিল। হিন্দু-মুসলমান বলে কথা নেই, নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে, সে অবস্থায় হত্যা করে মিলিটারিরা।

এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যা। পাবনা শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের অবস্থান। ২৪ এপ্রিল দুপুর ৩টায় একটি জিপ ও একটি পিকআপ নিয়ে ১০-১২ জন সেনা সাতবাড়িয়ায় এসে এলাকা রেকি করে আবার বিকালে ফিরে যায়। তারা পুরো এলাকার প্রতিটি গ্রাম, রাস্তাঘাট, বাজার, স্কুল-কলেজ, ঈদগাহের একটি ম্যাপ তৈরি করে। ১২ মে খুব সকালে কয়েকশ পাকসেনা সুজানগর থানা হয়ে সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ইউনিয়নে ঢুকতে তারা তাদের তৈরীকৃত ম্যাপ অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়, যেন ওই ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রাম, রাস্তাঘাট তাদের অপারেশনের আওতায় আসে।

তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, মোমরাজপুর থেকে শুরু করে নিশ্চিন্তপুর, কুড়ীয়পাড়া, কাচুরি, তারাবাড়িয়া, কন্দর্পপুর, ফকিতপুর, সাতবাড়িয়া বাজার, ভাটপাড়া, হরিরামপুর, গুপিনপুর, তিলমাদিয়াসহ গোটা ইউনিয়নের প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশি করে। প্রতিটি গ্রামের ঘরবাড়ি থেকে মানুষদের বের করে লাইনে দাঁড় করিয়ে বার্স্ট ফায়ার করে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ যাকে দেখেছে তাকেই গুলি করে মারা হয়। গুলি খেয়ে অনেকে আহত অবস্থায় লাশের স্তূপের মধ্যে মৃতের ভান করে শুয়ে থেকেছে। সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর ওই আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসা করা হয়। আহতদের মধ্যে কেউ কেউ মারা যায়, আবার কেউবা বেঁচে যায়। পাক আর্মি মানুষ মারার পাশাপাশি বাড়িঘর লুটপাট করে এবং নারী নির্যাতন চালায়।

ওদের ম্যাপ অনুযায়ী তারাবাড়িয়া ঈদগাহের কাছ থেকে অপারেশন শুরু করার কথা ছিল; কিন্তু ওই ঈদগাহ রাস্তা থেকে একটু দূরে থাকায় তা তাদের চোখে পড়েনি। তারা সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, কারও কারও কাছে জিজ্ঞেস করে ‘মালাউন কাহা?’ বাঙালি উর্দু বোঝে না, শুধু হাত দিয়ে বলে, ওদিকে। যেতে যেতে তারা কয়েকটি গ্রাম পার হয়ে গিয়ে দেখে রাস্তার পাশে একটি ঈদগাহ মাঠ। ওটি জামায়াত-মুসলিম লীগের এলাকা। অর্থাৎ কুখ্যাত আমিন উদ্দিন খাঁর বাড়ির এলাকা। শ্যামনগর, ভাটপাড়া, গুপিনপুর এলাকায় তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ ওইসব গ্রামে বেশি হয়। রাজাকাররা এবং তাদের লোকজন পাক আর্মিকে বিভিন্ন গ্রাম ও বাড়ি চিনিয়ে দেয়। গুপিনপুরের মহির উদ্দিনকে মোস্তফা রাজাকার সরাসরি আর্মির ক্যাপ্টেনকে চিনিয়ে দেয়। তার বাড়িতেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনা ঘটে সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত।

আমরা হাবাসপুর চরে অপেক্ষা করছিলাম-কোনো নৌকা ওপার থেকে আসে কি না। কিন্তু কোনো নৌকা আসে না এবং পুরো এলাকা একেবারে ফাঁকা। ১২টার দিকে কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পর সাড়ে ১২টার দিকে একটি বিমান এসে সাতবাড়িয়ার ওপর দিয়ে চক্কর দিতে থাকে। আনুমানিক দুপুর একটার দিকে পাক আর্মিরা সব ক্লোজ হয়ে সাতবাড়িয়া কানাই বাবুর দোতলা বাড়ি/সিও অফিসের মাঠে সমবেত হয় এবং দুপুর ২টায় পাবনার দিকে চলে যায়। আর্মি চলে যাওয়ার পর সব গ্রাম থেকে ও ঝোপজঙ্গল থেকে ২/১ জন করে মানুষ বের হতে থাকে। সবাই সবার আত্মীয়স্বজনকে খুঁজতে বের হয়। রাস্তাঘাটে, বাড়ির পাশে লাশ পড়ে থাকতে দেখে মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। কে কোথায় মারা গেছে, কার লাশ কোথায় এসব খোঁজ নিতে থাকে।

আমরা হাবাসপুর চর থেকে বিমানের গতিবিধি লক্ষ করছি। কিছুক্ষণ পর বিমান পাবনামুখী হয়ে চলে যায়। বিকাল ৩টার দিকে কিছু কিছু নৌকায় সাতবাড়িয়া থেকে লোকজন চরে এলে তাদের মুখে পাক আর্মির অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যার বর্ণনা শোনা যায়। কেউ কেউ ওই বিকালেই চর থেকে সাতবাড়িয়া ফিরে যায়।

আমরা কয়েকজন পরদিন সকালে সাতবাড়িয়াতে এলাম। এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অনেক রাস্তার পাশে নতুন মাটি খোঁড়ার চিহ্ন। রাস্তার পাশে কোথাও চারজন, কোথাও আটজন, কোথাও ১০ জনের লাশ মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। শহিদ লোকমান ভাইয়ের বাড়ির পাশে ১৫/২০ জনের লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়। হাইস্কুলের মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় রাস্তার পাশে স্কুলের দপ্তরি মদনসহ ৪/৫ জনের লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। এলাকায় ঘুরে অনেক ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুরো এলাকা বিভীষিকাময় পরিবেশে রূপ নেয়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বাররা কিছু লাশ মাটিচাপা দেয়, কিছু নদীতে ভাসিয়ে দেয়। স্থানীয় মুসলমানরা তাদের আত্মীয়স্বজন এবং চেনা পরিচিতদের কবরের ব্যবস্থা করে। নরপিশাচের দল এভাবে হত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন করে পাবনা শহরে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

মো. আবদুল লতিফ : সাবেক যুগ্ম সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়; বীর মুক্তিযোদ্ধা (৭নং সেক্টর)

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম