পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের বিচার করুন

মাহমুদুর রহমান মান্না
প্রকাশ: ১৬ মে ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পিকে হালদার। ফাইল ছবি
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের ঘটনার দীর্ঘ তালিকায় একটি নাম পিকে (প্রশান্ত কুমার) হালদার। সম্প্রতি ভারতে গ্রেফতার হওয়ার পর নামটি পুনরায় আলোচনায় এসেছে; কিন্তু পিকে হালদারের মতো আরও অনেক নাম, অনেক দুর্নীতি, অর্থ পাচারের ঘটনা এ দেশে নিয়মিত ঘটে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত কিংবা বেসরকারি-প্রায় প্রতিটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক কিংবা বেসরকারি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক বা রিলায়েন্স ফাইন্যান্স-কোনো দুর্নীতি, অর্থ লোপাট বা অর্থ পাচারের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় প্রতিটি ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতিবছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০, পাঁচ বছরে পাচারকারীরা ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে; যার মধ্যে শুধু ২০১৫ সালে ১ বছরেই দেশ থেকে পাচার হয়ে যায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। এ পাচার হয়েছে ব্যাংকিং চ্যানেলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে। তার মানে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির সিকিভাগও আমাদের সামনে আসেনি। আর যেগুলো এসেছে, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সরকার সেগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করেনি। অজ্ঞাত কারণ বললে অবশ্য ভুল হবে। কারণ প্রত্যেকেরই জানা। আর্থিক খাতে দুর্নীতির প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে সরকার বা সরকারি দলসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত থাকায় তদন্ত বেশিদূর এগোতে পারেনি।
প্রশান্ত কুমার হালদার সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আমরা সবাই মোটামুটি জেনেছি। সে কী করেছে, কোথায় কীভাবে গ্রেফতার হয়েছে-সেই ব্যাপারে নতুন করে লেখার কিছু নেই। বরং পিকে হালদারদের জন্ম কীভাবে হলো, সেই বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। প্রশান্ত কুমার হালদাররা হলো একটি জবাবদিহিতাহীন, অনির্বাচিত সরকারের ফসল কিংবা আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়া ওঠা চক্র। মাত্র ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৯ সালে পিকে হালদার অদৃশ্য আশীর্বাদে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন। দুটি প্রতিষ্ঠানই সরকারের মদদপুষ্ট একটি শিল্পগ্রুপের, যাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সে নির্বিঘ্নে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং সেই টাকা বিদেশে পাচার করে।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে কমপক্ষে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। সেই চার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা এখন চরম খারাপ। একটি বিলুপ্তের পথে, বাকি তিনটিও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। নানা কৌশল করে এসব প্রতিষ্ঠান দখল করে পিকে হালদার। প্রতিষ্ঠানগুলো দখলের সময় পিকে হালদার প্রথমে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পরে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিল। সুতরাং সে কাজগুলো করেছে সরকারি দলের মদদপুষ্ট সেই শিল্পগ্রুপের পক্ষ থেকে তাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়। আর এসব কাজে তাকে সব ধরনের সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এ দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনেই সবকিছু ঘটেছে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের (ব্যাংকিং এবং নন ব্যাংকিং) দৈন্যদশার জন্য সরকার দায়ী। তারা এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, উলটো পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, করে যাচ্ছে। বেশির ভাগ ব্যাংকে শীর্ষ পদগুলোয় বিধিবহির্ভূতভাবে ‘এক্সিলারেটেড প্রমোশন’ দিয়ে সরকারপন্থি (সরকারি দল) ব্যাংকারদের পদায়ন করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। আর তাদের মাধ্যমেই ১০ বছরে পাচার হয়েছে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা; যা বাংলাদেশের এক অর্থবছরের বাজেটের চেয়েও বেশি।
উন্নয়নের ডামাডোল বাজিয়ে সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে আসছে অনেক আগে থেকেই। উন্নয়নের নামে বিশেষ করে মেগা প্রকল্পের আড়ালে হাজার নয়, লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং বিদেশে পাচার করা হয়েছে। আজ আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ কমতে কমতে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চলে এসেছে। বৈদেশিক ঋণের ভারে দেশ আজ ন্যুব্জ। ২০১৫ সালে যে বৈদেশিক ঋণ ছিল ৪৯১০ কোটি টাকা, তা ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৯৭,৭৪০ কোটিতে। ২০২৫ সাল থেকে এক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে বছরে ৫৬৫ কোটি ডলার। ‘নিজেদের অর্থায়নে’ তৈরি পদ্মা সেতুর ঋণের কিস্তি টানতে হবে ২০৫৭ সাল পর্যন্ত। তিন বছরে এক পয়সাও আয় করতে পারেনি বাংলাদেশি স্যাটেলাইট। অথচ খরচ করা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। কর্ণফুলি টানেল, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অন্য সব প্রকল্পের ঋণের কিস্তি দেওয়া শুরু হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কী অবস্থায় দাঁড়াবে, সেটিই এখন প্রশ্ন। সরকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। এ সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে এক দশকেরও বেশি সময় বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
জেমস এ রবিনসন এবং ড্যারেন এসেমগ্লু রচিত হোয়াই নেশন্স ফেইল বইয়ে লেখকদ্বয় ইনক্লুসিভ এবং এক্সট্র্যাক্টিভ ডেভেলপমেন্ট দেখাতে গিয়ে বিশ্বের দুজন শীর্ষ ধনীর উদাহরণ দিয়েছেন। একজন হচ্ছেন আমেরিকার বিল গেটস, আরেকজন মেক্সিকোর কার্লোস স্লিম। বিল গেটস ধনী হয়েছেন পরিশ্রম, উদ্ভাবনী শক্তি এবং প্রতিনিয়ত তার বিকাশের কারণে। এতে সে বা তার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তার দেশ রাজস্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে, যা দেশের জন্য ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট (অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন)। অন্যদিকে কার্লোস স্লিম ধনী হয়েছেন তার দেশের ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশে মনোপলি টেলিকম ব্যবসার মাধ্যমে। এতে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর অর্থ রাষ্ট্রক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় একজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এটি একজন ব্যক্তির স্বার্থে রাষ্ট্রের এক্সট্র্যাক্টিভ ডেভেলপমেন্ট (নিষ্কাশনমূলক উন্নয়ন)। আমাদের দেশে একশ্রেণির মানুষ অগণতান্ত্রিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাতারাতি শত-সহস্র কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি এবং অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা বলা হলেও সত্যিকার অর্থে বেড়েছে কেবল আয়বৈষম্য। আমাদের দেশের কার্লোস স্লিমরা (পিকে হালদারের মতো সরকার বা সরকারদলীয় ক্ষমতাবানদের মদদপুষ্ট) ধনী থেকে অতি ধনী হয়েছেন, অন্যদিকে মধ্যবিত্ত, নিুবিত্তে আর দরিদ্র অতি দরিদ্রে পরিণত হয়েছে।
পিকে হালদারে ফিরে আসি। মি. হালদার ভারতে গ্রেফতার হয়েছে। তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। হালদারের সঙ্গে আর কে কে যুক্ত ছিল, কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সে অর্থ লোপাট ও পাচার করেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কারা সহযোগিতা করেছে, কোন শিল্পগ্রুপ বা ক্ষমতাবানরা এর পেছনে ছিল, তা উদ্ঘাটন করতে হবে, প্রকাশ করতে হবে এবং তাদের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংকসহ সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ কেলেঙ্কারির সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কোনো দৃশ্যমান বা অদৃশ্য ছায়া যেন এ তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়াকে গ্রাস করতে না পারে সেই ব্যাপারে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। আর আর্থিক খাতের এ ক্যানসার এখনই সারাতে না পারলে আমাদের অর্থনীতি কোনদিকে যাবে, তা সহজেই অনুমেয়।
মাহমুদুর রহমান মান্না : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য