স্পষ্ট হয়েছে রেলের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি
আবু তাহের খান
প্রকাশ: ১০ মে ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
১৭৬৯ সালে জেমস ওয়াট কর্তৃক বাষ্পীয় রেলইঞ্জিন আবিষ্কারের পর থেকে গত আড়াইশ বছরে রেলকে ঘিরে ভালো-মন্দ মিলিয়ে এত বিচিত্র ঘটনা ঘটেছে যে, উইকিপিডিয়ারও সামর্থ্য নেই এর পুরোটা তুলে ধরে।
তবে এসব ঘটনার বেশিরভাগই ইতিবাচক এবং সেগুলোর মধ্যে এমন বহু ঘটনা রয়েছে, যেগুলো ইতিহাসের গতিপথ পালটে দিয়েছে। একেবারে প্রথম ঘটনাটি হলো, ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের সূচনাই হয়েছিল বাষ্পীয় রেলইঞ্জিনের হাত ধরে। পরবর্তী সময়ে রেলই হয়ে উঠেছে পৃথিবীজুড়ে যোগাযোগের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ মাধ্যম।
এ রেলের কামরায় বসেই মহাত্মা গান্ধী শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানের জুতাজোড়া জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তার চটিজোড়াকে খুঁজে আনার জন্য। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনি প্রচারণার অন্যতম মাধ্যম ছিল ট্রেন; যে ট্রেনে চড়ে তিনি সারা দেশ চষে বেড়িয়েছিলেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ‘জতুগৃহে’র পুরোটাই গড়ে উঠেছে ট্রেন আর রেলস্টেশনকে ঘিরে। আর বইপড়ুয়া ইংরেজ এ কাজটির সিংহভাগই সারেন ট্রেনে বসে।
এত ইতিবাচক ঘটনার পরও রেলকে ঘিরে দেশে দুঃসংবাদের অন্ত নেই। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তো একসময় একে কাটাছেঁড়া করে হাড়টুকু রেখে বাকি সবটাই ফেলে দিতে চেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কোনোরকমে একে পুনরুদ্ধার করা গেলেও একে নিয়ে মানুষের ভোগান্তির অন্ত নেই। ট্রেন যাতে সময়মতো না চলে, সে ব্যাপারে বাস-মালিকরা যেমন বিভিন্ন সময়ে নানা কারসাজি ও অপচেষ্টা চালিয়েছেন, তেমনি একে ডুবানোর জন্য এর কর্মীরাও কম যাননি। আসন খালি অথচ কাউন্টারে টিকিট নেই-রেলের ইতিহাসে এমনটি কোনো বিরল ঘটনা নয়।
তারপরও অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশের মানুষ রেল ভ্রমণকে এখনো অগ্রাধিকার প্রদান করে, যদিও এত যাত্রী ও মালামাল পরিবহণ করেও ব্যবস্থাপনার অদক্ষতায় রেল অধিকাংশ সময়ই একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। আর এ ধরনের অদক্ষতারই সর্বশেষ নজির হচ্ছে ৬ মে রেলের ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেসে’ ঘটে যাওয়া কুটুমকাণ্ড।
খুলনা থেকে ঢাকাগামী ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেসে’ ভ্রমণকারী বিনা টিকিটের তিন যাত্রীকে ওইদিন শ্রেণিচ্যুতকরণ (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরা থেকে শোভন শ্রেণিতে প্রেরণ) এবং যাত্রীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়ের কারণে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশে টিটিই (ট্রেন টিকিট পরীক্ষক) শফিকুল ইসলামকে ওই রাতেই তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করে ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ-ওই তিন যাত্রী ছিলেন রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর খুবই কাছের কুটুম, যদিও এ কুটুম্বিতার কথা মন্ত্রী মহোদয় প্রথমটায় অস্বীকার করেছিলেন। এ ঘটনা এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। একে ঘিরে সর্বত্র সৃষ্ট ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে টিটিই শফিকুল ইসলামের বরখাস্ত আদেশ ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করা হলেও এ ঘটনার মধ্য দিয়ে রেলের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, অদক্ষতা, অপেশাদারত্ব ও অন্যান্য দুর্বলতার দগদগে খতগুলো খুব সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে, যা নিয়ে খানিকটা দীর্ঘ আলোচনাই হওয়া উচিত বলে মনে করি।
প্রথমত, এ ঘটনায় মন্ত্রীর স্ত্রী এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ করেছেন। স্বামী মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে মন্ত্রীর দপ্তরের কাউকে কোনো নির্দেশ প্রদান কিংবা কোনো ন্যায় বা অন্যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করার এখতিয়ার তার নেই। এ ধরনের একটি কর্তৃত্ববহির্ভূত কাজ করে তিনি যে অপরাধ করেছেন, ভবিষ্যতে যাতে তেমনটি আর কেউ না করেন, সেজন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রীর স্ত্রী যখন পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার প্রতি টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্তের নির্দেশ দিলেন, তখন ওই কর্মকর্তার উচিত ছিল আদেশদাতাকে বুঝিয়ে বলা যে, এভাবে কাউকে বরখাস্ত করা নিয়মবহির্ভূত কাজ, যা করার এখতিয়ার তার নেই। কিন্তু তা না বলে বরং নিয়মবহির্ভূত কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে তিনি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে অপেশাদারি আচরণ করেছেন, যা চরম দায়িত্বহীনতার পর্যায়ে পড়ে। এ ধরনের বিধিবহির্ভূত আচরণের জন্য অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু এ নিয়ে প্রায় কেউই কথা বলছেন না। সবাই মূলত মন্ত্রীর স্ত্রীর অপরাধটিকেই বিবেচনায় নিচ্ছেন। ন্যায্যতার স্বার্থে অবিলম্বে ওই কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশপ্রদানপূর্বক সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে এতদসংক্রান্ত অপরাধের বিস্তারিত তদন্ত করা প্রয়োজন।
ওই কর্মকর্তা টিকিট ছাড়া ভ্রমণকারী যাত্রীদের অপরাধের কথা না বলে উলটো নিজ কর্মচারীকে (টিটিই) উগ্র প্রকৃতির ও মানসিক সমস্যাগ্রস্ত বলে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে ধারণা হয়, ওই সহকর্মীর প্রতি তার কোনো পূর্ব আক্রোশ রয়েছে অথবা এ ধরনের মন্তব্য করার মাধ্যমে তিনি মন্ত্রী-স্ত্রীকে চাটুকারিতাসুলভ আচরণের মাধ্যমে উপযাচক হয়ে খুশি করতে চেয়েছেন এবং এ ধারায় টিটিকে বরখাস্ত করে অতি উৎসাহের পরিচয় দিয়েছেন। বস্তুত সংস্থা স্বার্থ ও পেশাদারিত্বের কথা ভুলে গিয়ে এ ধরনের অসদাচরণের কারণেই রেলের আজ এ হাল।
গণমাধ্যমকে দেওয়া বিনা টিকিটের এক যাত্রীর মায়ের বক্তব্য অনুযায়ী, ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার মন্ত্রীর স্ত্রীকে বলেছিলেন, উল্লিখিত ওই যাত্রীদের কোনো টিকিট লাগবে না। কী আশ্চর্য কথা, ট্রেনে ভ্রমণ করলে ওই যাত্রীদের টিকিট লাগবে না-এরূপ সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার তাকে কে দিল? এ বক্তব্য সঠিক হয়ে থাকলে নিজ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে এরূপ দায়িত্বহীন ও অপেশাদারি পরামর্শ প্রদানের জন্য ওই স্টেশন মাস্টারের বিরুদ্ধেও তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করি। রেলকে ডুবানোর জন্য এদের ভূমিকাও নেহায়েত কম নয়।
এদিকে রেলমন্ত্রীর একান্ত সচিব কর্তৃক ৮ মে রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের উদ্দেশে জারিকৃত এক আদেশে কোনো তদবিরকারককে কোনোরূপ অবৈধ সুবিধা না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ওই আদেশে এটাও বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, রেলমন্ত্রীর একান্ত সচিব, সহকারী একান্ত সচিব ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের অগোচরে তাদের নাম উল্লেখ করে রেলের টিকিট দাবিসহ নানা সুবিধা চাওয়া হচ্ছে।’
বস্তুত একান্ত সচিবের আদেশের এ অংশের মধ্যেই নিহিত রয়েছে রেলের মূল সমস্যা। কতিপয়রা নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নেন, আর অন্য কতিপয়রা নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধার বিনিময়ে সেসব অবৈধ সুবিধাদানের জন্য নিজেরাই ওতপেতে বসে থাকেন, যেমনটি বসেছিলেন রেলের ওই বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা। আর সুবিধা দেওয়া-নেওয়ার এ অসাধু চক্রের হাতেই বস্তুত ঘুরপাক খাচ্ছে রেলের ভূত ও ভবিষ্যৎ। আর সে অচ্ছেদ্য চক্রে অনুঘটক হিসাবে উল্লিখিত কুটুমকাণ্ডের অন্দরের কুশীলব সদস্যরা তো রয়েছেনই।
আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক)
atkhan56@gmail.com