Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

হাওড়াঞ্চলে বন্যা কি এবারও অশুভ সংকেত দিচ্ছে?

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাওড়াঞ্চলে বন্যা কি এবারও অশুভ সংকেত দিচ্ছে?

উজানের (ভারতের) পাহাড়ি ঢলের চাপে এবং স্থানীয়ভাবে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা দেখা দিয়েছে দেশের হাওড়াঞ্চলে। এ অঞ্চলে এখন পর্যন্ত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হলো-সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রোকোনা, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ।

এ পর্যন্ত হাওড়াঞ্চলে প্রায় ৭ হাজার ৮৩ হেক্টর জমির বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে এবং এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা (দ্য ডেইলি স্টার, ১৮ এপ্রিল)। কেবল সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে শতকোটি টাকার বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হলো সুনামগঞ্জ। সরকারি তথ্য ও গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, এ জেলায় ৫ হাজার ৫১০ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর কোথাও কোথাও সীমিত আকারে বোরো ধান কাটা শুরু হলেও অধিকাংশ এলাকায় তা হয়নি। ১৬ এপ্রিল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সুনামগঞ্জ জেলা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, হাওড়ের ফসল নিয়ে সরকার চিন্তিত। সব মিলিয়ে ১৫ দিন সময় পেলে ফসল গোলায় তুলতে পারবেন কৃষক। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, হাওড়াঞ্চলে বন্যার প্রকোপ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন যে প্রশ্নটি উঠতে পারে তা হলো, এবারের হাওড়াঞ্চলের বন্যা ২০১৭ সালের বন্যার অশুভ সংকেত দেয় কি?

দেশের হাওড়াঞ্চলে অবস্থিত জেলাগুলো হলো-সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, ৩৭৩টি হাওড়সমৃদ্ধ জেলায় মোট ভূমির পরিমাণ ১৯ লাখ হেক্টরের সামান্য বেশি, যার মধ্যে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমবেশি ৯ লাখ হেক্টর। দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল উৎপাদনে বোরোর অবস্থান শীর্ষে। মোট উৎপাদিত চালের প্রায় ৫৫ শতাংশ আসে বোরো ফসল থেকে। বাকিটা আসে আমন ও আউশ থেকে। হাওড়াঞ্চলে বোরোর আবাদ ও কাটা-মাড়ির সফলতা দেশে বোরো ফসল উৎপাদনের ওপর তথা মোট চাল উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে।

দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ২০ বছরে ছয়টি আগাম বন্যা হাওড়াঞ্চলে দেখা দেয় এবং এসব বন্যায় উৎপাদিত বোরো ফসলের প্রচুর ক্ষতি হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এসব আকস্মিক বন্যার জন্য যেসব কারণ চিহ্নিত করেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-ক. হাওড়ের পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা; খ. ধানচাষি ও মাছ উৎপাদনকারীদের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্বন্দ্ব; গ. সঠিক সময়ে বাঁধ সঠিকভাবে নির্মাণ ও মেরামত না হওয়া; ঘ. প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের অভাব।

হাওড়াঞ্চলে সর্বশেষ অকাল বন্যা দেখা দেয় ২০১৭ সালের এপ্রিলের প্রথমদিকে। টানা বৃষ্টি ও উজান (ভারত) থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওড় রক্ষাবাঁধ ডুবে ও ভেঙে গেলে মাঠের বোরো ফসলের প্রভূত ক্ষতি হয়। সরকারি হিসাবে ওই বন্যায় ১০ লাখ টন বোরো ধান নষ্ট হয়, যদিও বেসরকারি মতে নষ্ট হওয়া ফসলের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারি খাতে কোনো চাল আমদানি না হওয়া এবং চাল আমদানিতে উচ্চহারের শুল্ক চালু থাকায় বেসরকারি খাতে খুব স্বল্প পরিমাণ চাল আমদানি হয়। এর প্রভাব পড়ে চালের দামে। বাজারে চাল সরবরাহে স্বল্পতা দেখা দেয়। ফলে মোটা চাল বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ৫০-৫২ টাকায়, যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে। আর মাঝারি ও সরু চালের দামও অনেকটা বেড়ে যায়।

অনেক বছর ধরে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ সারা দেশ থেকে আসা কৃষি শ্রমিকরা হাওড়াঞ্চলে বোরো ধান কাটা ও ঘরে তোলার কাজ করে আসছেন। গত দুই বছর করোনা মহামারি চলাকালে দেশের এক অঞ্চল বা জেলা থেকে অন্য অঞ্চল বা জেলায় মানুষের যাতায়াতের সব ধরনের যানবাহন চলাচল সীমিত ঘোষণা করা হলেও সরকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ সারা দেশ থেকে লাখ লাখ কৃষি শ্রমিক নিয়ে আসার বিশেষ ব্যবস্থা করলে হাওড়াঞ্চলে বোরো ধান কাটার উদ্ভূত সমস্যার সমাধান হয়। বন্যা আসার আগেই ঘরে ধান ওঠায় একদিকে কৃষকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, অন্যদিকে উৎপাদিত বোরো ধান দেশে খাদ্যনিরাপত্তায় অবদান রাখে। ২০১৭ সালের মতো এ বছরও বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে-এ আশঙ্কায় হাওড়াঞ্চলের বোরো চাষিরা দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। কৃষিমন্ত্রীর মতে, আর কয়েকদিন পরই হাওড়াঞ্চলের সব বোরো ফসল কেটে ঘরে তোলার উপযুক্ত হবে। তাই গত দুই বছরের মতো বিশেষ ব্যবস্থায় উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ সারা দেশ থেকে কৃষি শ্রমিক এনে হাওড়াঞ্চলে বোরো ধান কাটার ব্যবস্থায় সহায়তা করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে ধান কাটার জন্য হারভেস্টার মেশিন সরবরাহ ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থাও সরকারকে নিতে হবে।

এটা ঠিক, স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের প্রধান খাদ্য চালের উৎপাদন তিনগুণের বেশি বেড়েছে। স্বাধীনতার সময়কালের কমবেশি এক কোটি টন চালের উৎপাদন বর্তমানে সাড়ে তিন কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে; কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় চাল উৎপাদনে নিম্ন প্রবৃদ্ধি, বীজ হিসাবে সংরক্ষণ, পশুখাদ্য হিসাবে ব্যবহার এবং কাটা-মাড়া থেকে শুরু করে খাবার হিসাবে পরিবেশন পর্যন্ত অপচয় প্রভৃতি কারণে উৎপাদিত চালে আমাদের চাহিদা মিটছে না। প্রায় প্রতিবছর আমাদের বেশকিছু পরিমাণ চাল উচ্চমূল্যে আমদানি করতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) চলতি বছর বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন, চাহিদা, আমদানি ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর চালের উপাদন ১ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে ৩ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার টনে দাঁড়াতে পারে। এরপরও এ বছর ১ কোটি ৫ লাখ টন চাল, গম ও ভুট্টা আমদানি করতে হবে। এর মধ্যে চালের পরিমাণ হবে ৭ লাখ টন। চলতি বছর বাংলাদেশের মানুষের জন্য মোট ৩ কোটি ৭০ লাখ টন চাল দরকার হবে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১ শতাংশ বেশি। এ পর্যন্ত হাওড়াঞ্চলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বোরো ফসলের পরিমাণ সরকারিভাবে জানানো হয়নি। তবে বন্যায় হাওড়াঞ্চলের অন্যান্য জেলার বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতির পরিমাণ ২০১৭ সালের সমান বা এর চেয়েও বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের চাল আমদানির পরিমাণ বেড়ে যাবে। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরও ভয়াবহ রূপ নিয়ে দীর্ঘায়িত হলে পণ্যটির আমদানি মূল্যই শুধু আরও বাড়বে না, বরং এটির আমদানি কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বর্তমানে বাজারে মোটা চালের দাম ৫০ টাকা ছুঁইছুঁই করছে। আর সরু চালের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে কেজিপ্রতি ৬৬ থেকে ৭২ টাকায়। প্রধান খাদ্য চালের মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষ চিন্তিত। কারণ একটি পরিবারে মাসিক যে ব্যয় হয়, তার প্রায় অর্ধেক চলে যায় খাদ্য সংগ্রহে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬ মোতাবেক জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট আয়ের ৪৭ দশমিক ৭০ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। গরিব ও অতি গরিব পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। আবার তাদের চাল ভোগের পরিমাণও অন্যদের চেয়ে বেশি। যখন দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চালের মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ৪৭০ গ্রাম, তখন অন্যদের ক্ষেত্রে তা ৩৬৬ গ্রাম। প্রধান এ খাদ্যপণ্যটির মূল্যস্ফীতিতে তারা ভোগেন সবচেয়ে বেশি। বিআইডিএসের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্য-মূল্যস্ফীতি বাড়লে ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতদরিদ্র পরিবারই চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। দরিদ্র পরিবারের বেলায় এ হার ৬৬ শতাংশ। তাই মোটা চালের দাম উচ্চহারে বৃদ্ধি পেলে তাদের খাদ্যনিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়ে।

শুধু দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা নন, চালের দামবৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরাও, বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। চালের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের আমিষজাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হয়। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের পুষ্টির অভাব ঘটে। এতে অবনতি ঘটে তাদের স্বাস্থ্যের। তাছাড়া এসব পরিবারকে কমিয়ে দিতে হয় শিক্ষা খাতে ব্যয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। সংকুচিত করতে হয় তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই খাদ্যের, বিশেষ করে চালের মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের কাছে ভীতি হয়ে দেখা দেয়।

সবশেষে যা বলতে চাই তা হলো, এখন সরকারের কাজ হবে যত দ্রুত সম্ভব হাওড়ের বোরো ধান ঘরে তুলতে কৃষককে সর্বোতভাবে সহায়তা করা। চাল আমদানিতে বর্তমানের উচ্চ শুল্কহার হ্রাস করে বেসরকারি খাতকে চাল আমদানিতে উৎসাহিত করতে হবে। ২০১৭ সালে চালের আমদানি শুল্ক পুরোপুরি রহিত করেও জনগণকে দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করা যায়নি, কারণ শুল্ক হ্রাসের সিদ্ধান্তটি গ্রহণে দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে চালের উচ্চমূল্য অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে। সরকারকে এ দিকটি খেয়ালে রাখতে হবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম