সামাজিক পুঁজির সংকট ও করণীয়
ড. মতিউর রহমান
প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনাভাইরাস ডিজিস-১৯ (কোভিড-১৯) পুরো বিশ্বকেই ওলটপালট করেছে। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। বাংলাদেশে এটি শনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চে। দুই বছরেরও বেশি সময় চলা এ ভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বকে ব্যাপকভাবে পালটে দিয়েছে। কোভিড-১৯ আমাদের চিরচেনা জগৎকে সবদিক দিয়ে অপরিচিত করে দিয়েছে। মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এ রোগের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, স্বাস্থ্যগত ও মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক গবেষণা হয়েছে। শুধু আর্থিক দিক থেকেই বিবেচনা করলে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে এ রোগের অভিঘাত ব্যাপকতর, যা ক্রমান্বয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে।
সামাজিক পুঁজি (সোশ্যাল ক্যাপিটাল) প্রধানত সমাজবিজ্ঞানের একটি প্রত্যয় বা ধারণা। আমেরিকান সমাজ সংস্কারক লিডা জুডসন হানিফান ১৯১৬ সালে ‘ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীর মধ্যে শুভেচ্ছা, সহযোগিতা, পারস্পরিক সহানুভূতি এবং সামাজিক আন্তঃসম্পর্ক’ বোঝাতে সামাজিক পুঁজি শব্দটি ব্যবহার করেন। সামাজিক পুঁজির ধারণাটি সর্বপ্রথম ১৮৯০-এর দিকে ব্যবহৃত হয়। তবে ১৯৯০-এর পর থেকে সমাজবিজ্ঞানী, সমাজচিন্তক ও উন্নয়নসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে সমাজবদলের ধারণাগুলোর মধ্যে সামাজিক পুঁজি সবচেয়ে জনপ্রিয়। সাধারণভাবে মানুষের মনোগত অবস্থা বা মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে কোনো ধরনের বৈষয়িক স্বার্থে চিন্তা না করে কাউকে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপৃত করতে পারাকেই সামাজিক পুঁজি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সামাজিক পুঁজির তিনটি মৌলিক গুণ রয়েছে যথা-সামাজিক পুঁজি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের উৎস; এটি পারিবারিক সহযোগিতার উৎস এবং এটি পরিবারের বাইরের নেটওয়ার্কগুলোর মধ্য দিয়ে সুফল লাভের উৎস।
কোভিড-১৯-এর দরুন সৃষ্টি হওয়া ভয়াবহ আর্থিক মন্দা ও জনস্বাস্থ্য সংকটের সময় আরও একটি ঘটনা প্রায় অনিবার্যভাবে দেখা দিয়েছে; আর তা হলো, সামাজিক পুঁজির সম্ভাব্য সংকট বা ক্ষয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, সামাজিক পুঁজি শ্রম ও মূলধনের মতোই একটি দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, সামাজিক সংহতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মন্দার ফলে যদি সামাজিক পুঁজির ক্ষয় ঘটে, তা অর্থনীতির ওপর মন্দার কুপ্রভাবকে আরও প্রকট ও সুদূরপ্রসারী করে তুলতে বাধ্য। সামাজিক পুঁজির প্রধান স্তম্ভ দুটি যেমন: এক. মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস এবং দুই. সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা। যে সমাজে বিশ্বাস ও আস্থার মাত্রা যত বেশি, সামাজিক পুঁজির নিরিখে সেই সমাজের অবস্থা তত উন্নত।
কোভিড-১৯-এর মতো মহামারি সামাজিক পুঁজির এই দুটি স্তম্ভকে ভেঙে দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই সতর্ক বার্তা প্রদান করেছিলেন। কারণ, কোভিড-১৯-এর মতো তীব্র সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচতে আমরা নিজেদের সমাজ থেকে যতদূর সম্ভব বিচ্ছিন্ন করেছি। বলতে গেলে প্রায় সব রকম সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অচেনা মানুষদের সঙ্গে মেলামেশার তো প্রশ্নই ওঠে না। এর ফলে সমাজে তৈরি হয় গভীর সন্দেহ ও অবিশ্বাসের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। তার ওপর, সাধারণ মানুষ যদি মনে করে যে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এ সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না বা এ সংকট নিরসনে যথেষ্ট কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না; তখন তাদের মনে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও তীব্র ক্ষোভ জমা হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে এ কারণগুলোর জন্যই ক্ষয় হতে শুরু করে সামাজিক পুঁজি। এতে সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রতি তারা ঝুঁকে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে তাদেরকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিণত করতে পারে।
একথা বলা যায়, কোভিডের অভিঘাত সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক সাফল্য ধরে রাখতে পেরেছে। বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিুমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে, জীবনযাত্রার মানও কিছুটা উন্নত হয়েছে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্প যেমন: পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, মেট্রোরেল প্রভৃতি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু একটা বিষয় আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে আর তা হলো, সামাজিক অবস্থা। মানুষে মানুষে আন্তরিকতা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আস্থা প্রভৃতি; যা সামাজিক পুঁজির অন্যতম উপাদান। এ পুঁজির ঘাটতি থেকে তৈরি হয় সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য।
কোভিডের অভিঘাতে সামাজিক পুঁজির এসব উপাদানে ফাটল ধরেছে কি না, এ সম্পর্কিত কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে ও বিভিন্ন ঘটনা সংঘটনের পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা যায়, আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, পারস্পরিক বিশ্বাস, আন্তরিকতা ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষের আস্থা প্রভৃতিতে অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব ঘটনা হয়তো আগেও ছিল; কিন্তু করোনাকালে এগুলো আরও বেড়ে গেছে। আস্থা ও বিশ্বাস সমাজ থেকে উঠে গেলে সমাজে অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। সামাজিক পুঁজি কমে গেলে সামাজিক নৈরাজ্য ও অর্থনৈতিক পতন ঠেকানো সম্ভব হয় না।
কয়েকটি বিষয় এখানে তুলে ধরলে হয়তো এ সামাজিক সংকট সম্পর্কে কিছুটা অনুধাবন করা সম্ভব হবে। যেমন: করোনা মহামারির কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এতে ছাত্রছাত্রীদের মনোজগতে বিশাল একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে। ভয়, সংকীর্ণতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার মতো বিষয়গুলো তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে। এটিও সামাজিক পুঁজি ক্ষয়ের একটি নমুনা। কারণ, শিক্ষা হলো সামাজিক পুঁজির অন্যতম উপাদান, যার মাধ্যমে সমাজ অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সামগ্রিকভাবে উন্নতি লাভ করতে পারে। এছাড়াও প্রায় দুই বছর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদারতাবোধ নষ্ট হয়েছে। কূপমণ্ডূকতা ও অন্ধকারের সংস্কৃতি দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়েছে। ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা এক্ষেত্রে অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে।
বিভিন্ন পরিসংখান থেকে দেখা যায়, করোনাকালে বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটি বা তারও অধিক মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। করোনায় নবসৃষ্ট এ বিরাট জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্র বা সরকার ব্যর্থ হলে তাদের মধ্যে তৈরি হতে পারে অপরাধপ্রবণ আচরণ, যা সামাজিকভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনাস্থারই জন্ম দেবে। এছাড়াও এই করোনাকালে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত বিরাট জনগোষ্ঠীর মনোজগতে ঘটে গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। মানসিক স্বাস্থ্যের সংকটে মানুষ দিশেহারা হয়; ঠিক-বেঠিক নির্ণয় তাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। এ কারণে তাদের সহজেই প্রভাবিত করা যায়। জাতীয় জনস্বাস্থ্যের দুরবস্থা থেকে আমরা এর কিছু লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করতে পারি।
করোনা মহামারি শেষ হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, শ্রীলংকায় অর্থনৈতিক সংকট প্রভৃতিও সাধারণ মানুষের মনোজগতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বেকারত্ব, আত্মহত্যা, নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, পারিবারিক সহিংসতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার সম্পর্কের পরিবর্তন, মাদক, অর্থ পাচার, নারী ও শিশু পাচার, ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হওয়া, সুদ, ঘুস, দুর্নীতি, বৈষম্য, অসমতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা প্রভৃতি অনেক বেড়ে গেছে। এগুলোকে সামাজিক পুঁজির সংকটের উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা যায়। সুতরাং, একথা বলা যায়, সামাজিক পুঁজি না বাড়লে বা এর ক্ষয়রোধ করা সম্ভব না হলে সমাজে নৈরাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা পাবে; অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এমনকি রাজনৈতিক ব্যবস্থারও পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। যেমনটি আমরা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিভিন্ন দেশে দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং, এখনই এ বিষয়ে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
সরকারি উদ্যোগে দ্রব্যমূল্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় নিয়ে আসা; ক্রমবর্ধমান অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ; ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দূরকল্পে ব্যাপক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম গ্রহণ; ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ; শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াও মাদক, খুন, জখম, ছিনতাই, নারী নির্যাতন, নারী পাচার. সুদ, ঘুস, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও সুশীলসমাজও এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
কোভিডের কারণে আমাদের দেশে সামাজিক পুঁজির কতটা ক্ষয় হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে সামাজিক পুঁজিতে সংকট যে তৈরি হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিহাস বলে, ভেঙে পড়া অর্থনীতি যতবার সমাজের গায়ে আঁচড় বসিয়েছে, যতবার দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সাধারণ মানুষের; ততবারই বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে সমাজে ও রাষ্ট্রে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত করোনা মহামারিসৃষ্ট ক্ষতবিক্ষত সমাজ পুনর্গঠনের। করোনাসৃষ্ট আর্থিক সংকটের আসল গভীরতা, ব্যাপ্তি ও মেয়াদ আমাদের এখনকার অনুমানের চেয়েও হয়তো অনেক বেশি হতে পারে। আমাদের মতো দেশে এর ফলে নানা রকম সামাজিক অস্থিরতা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা মারাত্মক রূপ নিতে পারে; যার কিছু কিছু আমরা ইতোমধ্যেই পর্যবেক্ষণ করছি। সুতরাং, এ ধরনের অবস্থা মোকাবিলায় আমাদের সবাইকে সেভাবেই প্রস্তুত থাকতে হবে।
ড. মতিউর রহমান : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী