Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষাক্রম রূপরেখার আরও কিছু সমস্যা

Icon

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষাক্রম রূপরেখার আরও কিছু সমস্যা

গত ২১ মার্চ এই দৈনিকে প্রকাশিত ‘শিক্ষাক্রমের রূপরেখার ত্রুটিগুলো’ শীর্ষক নিবন্ধে আমি পরিমার্জনাধীন জাতীয় শিক্ষাক্রমের প্রধান পাঁচটি ধারণাগত ত্রুটি আলোচনা করেছিলাম। আলোচিত সেসব বিষয়ের চেয়েও গুরুতর তিন-চারটি সমস্যা রয়েছে প্রস্তাবিত এ রূপরেখায়। আজকের লেখায় সেগুলো বর্ণনা করে দীর্ঘ দুবছরে লিখিত, এখনো প্রধানত ‘রূপরেখা’ নামের এ শিক্ষাক্রম-ভূমিকায় এত সমস্যা থাকার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এ লেখা শেষ করতে চাই।

১. নবম-দশম শ্রেণিতে ‘একমুখী’ শিক্ষা এগিয়ে নয়, ৬০ বছর পিছিয়ে দিতে পারে!

পাকিস্তান আমলে শরিফ শিক্ষা কমিশনের (১৯৫৯) আওতায় এবং ১৯৬০ সালের শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে এদেশে শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরের মাঝখানের নবম-দশম শ্রেণির উপস্তরে সমন্বিত/একমুখী শিক্ষার পরিবর্তে শাখাভিত্তিক শিক্ষা এবং ম্যাট্রিকুলেশনের পরিবর্তে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা চালু করা হয়। শাখাভিত্তিক শিক্ষা তখনকার ইন্টারমিডিয়েট স্তরের দুশ্রেণি নিচ থেকে শুরু হওয়ায় তা ব্রিটেন ও আমেরিকার ‘ও লেভেলের’ সমতুল হয়। এতে ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যবধান কমে আসে। কিন্তু বিষয়টা না বুঝে শাখাভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতি প্রচলনের ৪২ বছর পর ২০০৩-২০০৪ সালে একবার ‘নবম শ্রেণির কচি শিক্ষার্থীরা শাখা নির্বাচনের যোগ্যতা অর্জন না করার’ ধোয়া তুলে এ উপস্তরের শিক্ষাকে একমুখী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক জাফর ইকবালসহ দেশের বিশিষ্টজনদের প্রতিবাদের ফলে শিক্ষার্থীরা সে যাত্রায় মন্ত্রণালয়ের জবরদস্ত সচিব শহীদুল আলমের ভুল পদক্ষেপ থেকে রক্ষা পেয়েছিল।

এখন শাখাভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতি প্রচলনের ৬০ বছর পর বলা হচ্ছে: বিশ্বের ৪০টি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করে নাকি এ উপস্তরের শিক্ষাকে একমুখী করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু ওই ৪০টি দেশের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। আমি ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা খাত মানোন্নয়ন প্রকল্পের (Secondary Education Sector Improvement Project-SESIP) আওতায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (জাশিপাবো) বিশেষজ্ঞ হিসাবে তখনকার সদস্য শিক্ষাক্রমের নির্দেশে ১৪টি বিভিন্ন দেশের উপাত্ত সংগ্রহ করেছিলাম এবং পরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরও ১৬৮টি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উপাত্ত নিয়ে (মোট ১৮২টি দেশের) দেখেছি: কথা সত্য, অধিকাংশ উন্নত দেশে এ উপস্তরে ‘ঘোষিত শাখা’ থাকে না; কিন্তু বিষয় নির্বাচনের খোলা সুযোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে শাখাবিন্যাস স্পষ্ট করে তোলে। তাতে উচ্চমাধ্যমিক উপস্তর ও উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ধারার মজবুত ভিত তৈরি হয়ে যায় নবম-দশম শ্রেণিতেই।

জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা অনুসারে নবম ও দশম শ্রেণিতে দুই কিস্তিতে বিজ্ঞান/মানবিক বিষয়ের দুটি বই লেখার পরিকল্পনা করা হয়েছে; কিন্তু প্রমাণ ‘উপযুক্ত পরীক্ষা’ (Standard High-stake Examination) হবে শুধু দশম শ্রেণির কোর্সের ওপর। তাই নবম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক গুরুত্বের সঙ্গে পড়া হবে না। পরিণামে মাত্র এক পত্রের বিজ্ঞান/মানবিকের সরু ভিত্তি নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক উপস্তরে গিয়ে ছয়টি পত্রের ব্যবস্থা শিক্ষাক্রমের সমকেন্দ্রিক ধীর কলেবর বৃদ্ধির নীতি লঙ্ঘন করবে এবং শিক্ষার্থীরা এ হঠাৎ ছয়গুণ কলেবরের পড়া নিয়ে হিমশিম খাবে। আর উচ্চমাধ্যমিক উপস্তর থেকে যারা ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় পড়াশোনা করবে, তাদের জন্য নবম-দশম শ্রেণিতে কোনো প্রস্তুতির ব্যবস্থাই রাখা হয়নি।

২. সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষায় কারিগরি বিষয় অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য

দেশে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে তিনটি প্রধান শিক্ষাধারা (সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি) চলে এসেছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কারিগরি শিক্ষার বিপুল উন্নয়ন অবশ্যই দরকার। কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি আশাব্যঞ্জক হারে বাড়ানোর জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়ে সাধারণ শিক্ষাধারায় কারিগরি বিষয় প্রচলনের চেষ্টা একটি বিভ্রান্তি। কার্যকর কারিগরি শিক্ষার জন্য যে মানের ব্যাবহারিক জ্ঞান দরকার হয়, তার ব্যবস্থা করা হয় সে মানের পরীক্ষাগারে ব্যাবহারিক কাজের এবং শিল্প-সংযোগ (Industrial Attachment/ Linkage)-এর মাধ্যমে। ওসব খরচবহুল ব্যবস্থা সাধারণ বিদ্যালয়ের আওতার বাইরে। তাছাড়া প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ শিক্ষা উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিপর্ব; ঠুনকো কারিগরি বিষয়ের ভারে উচ্চশিক্ষার ভিত রচনাকারী বিষয়ের পাঠ দুর্বল করা সমীচীন নয়। কারিগরি শিক্ষার উন্নতি-অগ্রগতি চাইলে তা ১৯৬৭ সাল থেকে জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত কারিগরি ধারায়ই করতে হবে। দুঃখের বিষয়, কারিগরি স্কুল ও কলেজগুলোয় সৃষ্ট শিক্ষক পদের প্রায় অর্ধেক শূন্য পড়ে আছে কয়েক দশক ধরে। এটা কি কারিগরি শিক্ষায় অগ্রগতি-প্রচেষ্টার নমুনা?

জানা যায়, শিক্ষাপ্রশাসন থেকে প্রতি উপজেলায় একটি ভালো পরীক্ষাগার নির্মাণ করে সেখানে উপজেলার সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কারিগরি বিষয়ের ব্যাবহারিক ক্লাসের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ ব্যবস্থা উপজেলার শতাধিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই।

৩. প্রমাণ পরীক্ষার চেয়ে মনগড়া নম্বর প্রদানের প্রাধান্য!

শিক্ষাক্রম রূপরেখার সবচেয়ে দুর্বল এবং অসাধ্য পরিকল্পনা করা হয়েছে মূল্যায়ন বিষয়ে। শিক্ষক/অভিভাবক/বন্ধুদের দিয়ে শিখনকালীন (Formative, Continuous) মূল্যায়ন প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ১০০ শতাংশ, চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৬০ শতাংশ, নবম-দশম শ্রেণিতে ৫০ শতাংশ, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩০ শতাংশ। আমরা জানি, শিক্ষার সব উদ্দেশ্য/যোগ্যতা/ শিখনফল মূল্যায়ন করতে হলে শিখনকালীন মূল্যায়নের হার অবশ্যই বাড়াতে হবে। কিন্তু দেশের সামাজিক বাস্তবতা তো বুঝতে হবে! ২০০৩-২০০৮ সালে সেসিপের আওতায় স্কুলভিত্তিক মূল্যায়ন (School Based Assessment) শীর্ষক ২০-৩০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন পদ্ধতিও বাস্তবায়ন করা যায়নি। কারণ শিক্ষকের হাতে বেশি নম্বর প্রাইভেট পড়া শুধু উৎসাহিত নয়, আবশ্যিক করে তোলে। আর স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও কলেজ গভর্নিং বডির হস্তক্ষেপে শিখনকালীন মূল্যায়ন নম্বর প্রদানের হিড়িকে পরিণত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই প্রমাণ লিখিত পরীক্ষার ক্ষেত্র যতই সরু হোক, তার শতকরা হার অন্তত ৬০ থেকে ৮০ শতকরায় না ওঠালে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় ধস নেমে তা পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই বিকল করে দিতে পারে।

শিক্ষাক্রম নিয়ে কাজের চেয়ে কথার এমন ফুলঝুরি কেন

এখন ভাবতে হচ্ছে-শিক্ষাক্রমের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এমন হেলাফেলা কেন করা হচ্ছে? মনে পড়ছে: ‘যার কাজ তারই সাজে, আনাড়ির লাঠি বাজে’! অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, জাশিপাবোর বিগত প্রায় ৩৮ বছরের (১৯৮৪-২০২১) ইতিহাসে মাত্র বছর দশেক প্রথম সদস্য-শিক্ষাক্রম অধ্যাপক এমএ জব্বার, মাঝখানে অধ্যাপক আলী আজম এবং শেষে অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী এ পদটিকে যোগ্যতা বলে অলংকৃত রেখেছিলেন। বাকি প্রায় তিন দশক ধরে এ পদটিকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে যে কোনো বিষয়ের অধ্যাপকদের দিয়ে। প্রায় সাত বছর ধরে এ পদটিকে বাংলার যে অধ্যাপক আপাতভাবে অলংকৃত, আসলে কলঙ্কিত করে রেখেছেন তিনি শিক্ষাক্রম বোদ্ধাদের পছন্দ করেন না; কম জানা লোকদের তার বেশি পছন্দ। বাংলাদেশে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের গুরু, জাশিপাবোর সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমদকে (যিনি গত বছর করোনায় মারা যান) তিনি দেশের ‘শিক্ষার শত্রু’ বলে গাল দিয়েছেন। বিষয়টি লক্ষ করে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২’-এর পরামর্শক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর-এর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান নিজের সম্মানের কথা ভেবে এবারের শিক্ষাক্রম কোর কমিটি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। গত ৫ জানুয়ারি দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত ‘নতুন কারিকুলাম নিয়ে তালগোল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিষয়টি বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে।

বাংলার এ অধ্যাপকের ‘গড়ে ওঠা’, জে ডেলরস-বর্ণিত শিক্ষার চার স্তম্ভের (Four Pillars of education in ‘Learning:The treasure within’ by J. Delors, 1996) একটির ভাষায় ‘হয়ে ওঠার জন্য শেখা’ (Learning to be), মানে চরিত্র (Character) শিক্ষাক্রমের মূল বৈশিষ্ট্য ও নীতি-‘অবিরাম পর্যালোচনা ও সংশোধন (Continuos revision and updating), বাস্তব অবস্থার সঙ্গে অভিযোজন (Adaptation to the context)’-বিরোধী; তিনি ভুল স্বীকার না করার পক্ষের উকিল। তার উইং-এ ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষাক্রম উন্নয়নের জন্য বিশেষভাবে নিয়োজিত ২০ জন শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞের একটি ইউনিট রয়েছে। এদের নিষ্ক্রিয় রেখে কেন বেসরকারি সংস্থার লোক দিয়ে শিক্ষাক্রম উন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে, তা এক গুরুতর প্রশ্ন বটে।

যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষা এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা উভয়টির প্রধান উপজীব্য অন্তর্ভুক্তি (Inclusion)। কিন্তু আমাদের এবারের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়া চলছে উলটোপথে; জানাশোনা লোকদের বর্জন করা, এক্সক্লুড করা এবার কৌশলে পরিণত হয়েছে। আশা করি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়দ্বয় (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং ‘মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা’ মন্ত্রণালয়) শুধু শিক্ষাক্রমকে বাস্তবায়নযোগ্য করা নয়, শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়াকেও অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) করবে এবং যোগ্য লোককে যথাস্থানে পদায়ন করবে। এ কাজে যত দেরি হবে. ততই ক্ষতি: ‘সময় গেলে সাধন হবে না’।

উল্লেখ্য, ক্যাডার সার্ভিসের অধিকাংশ লোকই যোগ্য; কিন্তু বোঝা জরুরি, কে কী কাজের জন্য বেশি যোগ্য। পরিবেশদূষণের উপাদান-দূষক (Pollutant) পদার্থের একটি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু খুব সুন্দর সংজ্ঞা রয়েছে: Resource out of place (অস্থানে রাখা সম্পদই দূষক)। আমরা সম্পদকে যথাস্থানে না রেখে অন্যত্র রাখলে তা দূষকে পরিণত হয় এবং পরিবেশকে দূষিত করে। পরবর্তী লেখায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইং-এর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবজনিত সমস্যা এবং তা দূরীকরণের উপায় নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা রইল।

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষাক্রম গবেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)

asmolla@ymail.com

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম