Logo
Logo
×

বাতায়ন

যত্নের সঙ্গে শুনুন

Icon

ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী

প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যত্নের সঙ্গে শুনুন

আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে শ্রবণেন্দ্রিয় বা কান। কান দিয়ে আমরা শুনি অথচ গুরুত্ব দেই কম এবং এই কানে শোনার যত্নের ব্যাপারে বরাবরই আমরা উদাসীন। অথচ এর ফলে বধিরতা পর্যন্ত হতে পারে। কানের যত্ন সবারই নেওয়া উচিত; তবে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদের বিশেষ সতর্ক হওয়া দরকার।

বিশ্বে শতকরা পাঁচ ভাগের বেশি মানুষের কোনো না কোনো মাত্রায় শ্রবণহীনতা রয়েছে। সমীক্ষায় দেখা যায়, আমাদের দেশের প্রায় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ বধিরতায় ভুগে থাকেন। অথচ একটু সচেতন হলেই এড়ানো যায় কানের অনেক রোগ। সচেতনতা হলো যে কোনো রোগ প্রতিরোধের প্রাথমিক পদক্ষেপ। শ্রবণশক্তি হ্রাস রোধ করা এবং বিশ্বজুড়ে শ্রবণশক্তির যত্ন কীভাবে নেওয়া যায়, সে সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ৩ মার্চ বিশ্ব শ্রবণ দিবস পালন করা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০০৭ সালের এই দিনে প্রথমবারের মতো পালিত হয় বিশ্ব শ্রবণ দিবস। দিবসটি সামনে রেখে প্রতিবছরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি নতুন স্লোগান ঘোষণা করে। এবারের স্লোগান বা থিম হচ্ছে-‘To hear for life; Listen with care’, অর্থাৎ ‘যত্নের সঙ্গে শুনুন, জীবনভর শুনুন’।

এই থিমের তাৎপর্য হচ্ছে, আমরা মনে করি, বর্তমানে ভালো শুনতে পাচ্ছি বলে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না বা হবে না। কিন্তু শব্দ দূষণজনিত বেশকিছু কাজ আমরা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি, সেগুলোর কিছু দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে এবং যার ফলে আমাদের কানের হেয়ার সেল ধ্বংস হয়ে শ্রবণশক্তি স্থায়ীভাবে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

যেমন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেডফোনের ব্যবহার কিংবা মাইক বা সাউন্ড বক্স বা ইয়ারফোনে অতিরিক্ত সাউন্ড দিয়ে গান শোনার অভ্যাস কানের ও শ্রবণশক্তির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। চিকিৎসকদের গবেষণা বলছে, যদি কেউ ৮৫ ডেসিবলের বেশি শব্দ লাগাতার শুনতে থাকে, তাহলে ধীরে ধীরে তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এসব অভ্যাস থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিত। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার জন্যই এবারের স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে।

চোখে যেমন কম দেখা স্বাভাবিক, তেমনি কানে কম শোনাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কানে কম শোনার সমস্যা নিয়ে আমাদের সমাজে মানুষকে প্রায়ই হীনম্মন্যতায় ভুগতে দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, শ্রবণ ক্ষমতা যে কমছে, এটাই বহু মানুষ উপলব্ধি করতে পারেন না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তাই প্রতিরোধের জন্য কানে কম শোনার সাধারণ উপসর্গ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

ফোনে কথা বলার সময় কম শুনতে পাওয়া, বাড়ির অন্যান্য সদস্য যে শব্দে টিভি দেখছেন, তার থেকে বেশি ভলিউমে টিভি দেখা, আড্ডায় বা বাড়ির ঘরোয়া আলোচনায় স্বাভাবিক স্বরে কথা বললে না শুনতে পাওয়া, চার-পাঁচজন একসঙ্গে কথা বললে বুঝতে না পারা-এগুলো কানে কম শোনার সাধারণ উপসর্গ। তাই বাড়ির কোনো সদস্যের এমন উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই সতর্ক হোন এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন।

শ্রবণশক্তি হ্রাস ঠেকাতে বা কানে কম শোনা রোধ করতে যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এ জন্য যা করা প্রয়োজন :

১. গর্ভকালীন অবস্থায় মায়ের যত্ন নেওয়া এবং সময়মতো রুবেলা, বসন্ত, হাম ইত্যাদির টিকা দেওয়া। এ সময় অটোটক্সিক বা শ্রবণে ক্ষতিকারক ওষুধ গ্রহণে বিরত থাকা। সব ধরনের টিকাদান কর্মসূচি জোরদার করা।

২. জন্মের প্রথম দিন বা ছয় মাসের মধ্যে শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করা উচিত। একে বলে ইউনিভার্সাল হিয়ারিং স্ক্রিনিং, যা বিশ্বব্যাপী চলমান। এরপর শিশুর দাঁত ওঠা, হাঁটা-চলার পাশাপাশি শিশু শব্দের প্রতি সাড়া দিচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখা উচিত। শিশুর বেড়ে ওঠার অন্যতম প্রধান লক্ষণ হচ্ছে শুনতে পাওয়া। সাধারণত জন্মের পর ৩ মাস বয়সে শিশু ঘাড় ঘুরাতে এবং অন্যের কথার উত্তরে হাসতে পারে। ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যে শিশু ভাঙা ভাঙাভাবে কথা বলতে শুরু করে।

১৫ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে শিশু সহজ কয়েকটি কথা বলতে পারে। কোনো শিশু যদি এগুলো না পেরে থাকে, সেক্ষেত্রে বাবা-মা একটু চিন্তিত হয়ে পড়তেই পারেন। এ ছাড়া কানে কম শুনলে শিশু হতাশ বা মনমরা হয়ে থাকে। যদি স্বাভাবিক নিয়মে এসব লক্ষণ কোনো শিশুর বেড়ে ওঠার মধ্যে দেখা না যায়, তাহলে অবশ্যই দ্রুত নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

৩. গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় উচ্চ ভলিউমে গান শোনা শ্রবণশক্তি কমিয়ে দেয়; তরুণ প্রজন্মের জন্য যা অশনিসংকেত। তাই অবশ্যই হেডফোনে গান শোনার সময় বিরতি দিয়ে এবং ভলিউম কমিয়ে গান শোনা উচিত।

৪. একনাগাড়ে জোরালো শব্দের কারণে অন্তঃকর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে। তাই উচ্চশব্দের কলকারখানার শ্রমিকদের ক্ষেত্রে স্ক্রিনিংসহ বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। গাড়িচালকদের অযথা হর্ন বাজানো থেকে বিরত থাকা উচিত। অপ্রয়োজনীয় শব্দদূষণ রোধে প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা উচিত।

৫. কানে কম শোনার যন্ত্র/হিয়ারিং এইড সহজলভ্য এবং এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কানের শ্রবণশক্তি পরীক্ষা/অডিওলজি টেস্টের ব্যবস্থা সহজলভ্য করার মাধ্যমে শ্রবণ শক্তি রোধ করা সম্ভব। কারও ইতোমধ্যে শুনতে পাওয়ার ক্ষতি কতটুকু হয়েছে তা জানতে অডিওগ্রাম নামে পরিচিত হেয়ারিং টেস্ট সম্পর্কে জনমনে ধারণা দিতে হবে। কারণ যারা শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন, তারা প্রাথমিক শনাক্তকরণ এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারেন।

৬. যদি হঠাৎ করেই কেউ কানে কম শোনার সমস্যায় আক্রান্ত হন, তাহলে জরুরি ভিত্তিতে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। যত দ্রুত Sudden hearing loss-এর রোগী তার চিকিৎসকের কাছে যাবেন, তত দ্রুত আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা থাকে।

মনে রাখতে হবে, কানে কম শোনা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রচলিত সমস্যা। আর তাই কানে কম শোনার সঠিক কারণ নির্ণয় এবং তা প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তাই বলছি-

‘বাড়ছে বধির অজান্তে,

কানের যত্নের প্রতি অনীহায়।

শ্রবণশক্তি হারালে একবার ,

ফিরবে না আর বহু চেষ্টায়।’

ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী : নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম