Logo
Logo
×

বাতায়ন

সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত আসলে কী?

Icon

ডা. জাহেদ উর রহমান

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত আসলে কী?

এবার নির্বাচন কমিশন গঠনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে জনগণ সংবিধান শিখতে শুরু করলেন; এটা ভালো। নাগরিকদের অনেকে সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে বললেন, একটি আইন ছাড়া নির্বাচন কমিশন গঠন করা সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। কথাটা ঠিক।

গত বছরের শেষ দিকে যখন এ আলোচনা অত্যন্ত জোরালো হয়ে ওঠে, তখন আইনমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন এবারকার নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন হবে না। তার মতে, এ আইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই সংসদে দীর্ঘ সময় তর্কবিতর্কের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করতে চান তারা। এরপর হলো রাষ্ট্রপতির সংলাপ।

শুধু মাঠের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপিই নয়, রাষ্ট্রপতির সংলাপ বর্জন করেছিল নিবন্ধিত সব বাম দল এবং ইসলামী দলগুলোও। অর্থাৎ সেই মতবিনিময়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থাকা দলগুলো। তারা সেখানে একসুরে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন নিয়ে কথা বলেন। তারপর হঠাৎ করে অতি কম সময়ে সংসদে বিল উত্থাপিত হয়। এক দিন মাত্র সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সেটা নিয়ে কিছু সময় বৈঠক করে এবং সংসদে মাত্র এক দিনের আলোচনায় বিলটি পাশ হয়ে যায়।

নির্বাচন কমিশন গঠনের আইনটি নিয়ে আলোচনার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কমিশন নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মতো আইন এটা হয়নি। এটা আদতে হয়েছে সার্চ কমিটি গঠন এবং সেটা যেভাবে কাজ করবে সেটা নিশ্চিতকরণের আইন। কিন্তু যেটা জরুরি কথা সেটা হলো, এ ঘটনাগুলো ঘটানোর মাধ্যমে সরকার এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা পেয়েছে। এ পাওয়ার পেছনে আমাদের দেশের নাগরিক সমাজ, যাদের প্রচলিতভাবে সুশীলসমাজ বলা হয়, তাদের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

আইনটি পাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক সমাজের নানা জায়গা থেকে খুব স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে, এটা কেন কোনো আইন হয়নি। তারা প্রমাণ করেছেন, কেন এ আইনের অন্তর্নিহিত সমস্যার কারণেই কোনোভাবে একটা স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভব নয়। এরপর সার্চ কমিটি গঠনের পরও দেখা গেল এখানে অন্তত দুজন সদস্য ক্ষমতাসীন দলের হয়ে সংসদ নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। আর এ দেশের সাংবিধানিক পদগুলোর নিয়োগ কীভাবে হয়, কাদের সেখানে পদায়ন করা হয়, সেটা সবাই জানে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই কলাম লিখে, টকশোতে বলে দিকনির্দেশনা দিতে শুরু করলেন-কীভাবে সার্চ কমিটির কাজ করা উচিত, কীভাবে তারা একটা সঠিক নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারেন ইত্যাদি। এরপর দলে দলে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সার্চ কমিটির ডাকে তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে শুরু করলেন। সে কমিটিকে তারা কী বলেছেন, সেটা নিয়ে মিডিয়ার সামনে কথা বললেন, কলামও লিখলেন।

সার্চ কমিটির ডাকে নাগরিক সমাজের যারা গিয়েছেন, সবাইকে আমি এ রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না। তাদের একটা বড় অংশ নানা সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে বর্তমান সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী। কিন্তু কিছু মানুষ ছিলেন যারা পারতেন। আমি তাদের কথা বলছি, যারা মোটা দাগে সরকারের কোনো উপকারভোগী মানুষ ছিলেন না এবং সরকারের নানা অন্যায়ের সমালোচনা করতেন। কিন্তু তারাও সরকারের ফাঁদে পা দিলেন। সে ফাঁদের কথায় আসছি কলামের শেষের দিকে।

সার্চ কমিটি আগ্রহী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নির্বাচন কমিশনার হওয়ার জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের নাম চেয়েছিল। বিএনপিসহ যে দলগুলো রাষ্ট্রপতির সংলাপে যায়নি, তারা ছাড়া নাম দিয়েছে আর প্রায় সবাই। তাতে প্রস্তাবিত নামের সংখ্যা দাঁড়াল ৩২২। এবার মিডিয়া মেতে উঠল এই নামগুলো নিয়ে। এ তালিকায় কারা আছেন, এর মধ্যে কতজন কোন শ্রেণিতে পড়েন (অবসরপ্রাপ্ত আমলা, বিচারক, শিক্ষক ইত্যাদি), এসব নিয়ে মিডিয়াগুলো দীর্ঘ রিপোর্ট করেছে। কেউ কেউ যুক্ত করেছেন চমৎকার গ্রাফিক্স। অর্থাৎ আমরা ভীষণভাবে মেতে আছি এসব নিয়ে।

কিছু দিন পর ঘোষিত হবে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সেই কমিশনের নাম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা নিশ্চয়ই আবারও ভীষণভাবে মেতে উঠব। প্রত্যেক নির্বাচন কমিশনার, বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কুষ্ঠি-ঠিকুজি খোঁজা হবে, কোন সরকারের আমলে কী পরিস্থিতিতে ছিলেন, তা-ও। একপক্ষ আবার খুঁজে দেখবে কমিশনের সবাই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, নাকি কেউ আবার স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। এ নির্বাচিত কমিশনারদের তালিকা কোন দল-ব্যক্তির প্রস্তাব থেকে এসেছে, পত্রিকায় সেই অনুসন্ধানী রিপোর্ট আসবে। সঠিক তথ্য নিশ্চিত না হওয়া গেলেও বিতর্ক কিন্তু চলবেই।

সামনের আরও বেশ কিছু দিন মেতে থাকার মতো বেশ কিছু বিষয় আমাদের সামনে আসতেই থাকবে। অনেকেই আবার এর মধ্যেই চলতে থাকা কিছু আলোচনা চালিয়ে যাবেন-আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা কমিয়ে আনতে হবে, তাদের আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান করতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার উচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছেন, আমরা কতদিন নির্বাচন নিয়ে নিজেদের মধ্যকার অনাস্থা রেখে দেব, সঠিক নির্বাচন করলেই কি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে ইত্যাদি।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন তৈরি করা হবে নাকি হবে না, হলে সে আইনটা কেমন হবে থেকে শুরু করে সার্চ কমিটি গঠন, তার সদস্য নির্বাচন প্রতিটি ক্ষেত্রে নানারকম বিতর্কিত পদক্ষেপ সরকার ইচ্ছা করে নিয়েছে, যাতে আমরা সেসব বিতর্ক নিয়ে মেতে থাকি। সরকার এ বিতর্ক জারি রাখতে চাইবে নির্বাচন কমিশন তৈরি হওয়ার পরও।

২০২০ সালের মে মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তার সরকারি বাসভবনে করোনাকালের নিষেধাজ্ঞা ভেঙে পার্টি করে ভীষণ বিপদে পড়েছেন। তার প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। কিছু দিন আগে প্রথম যখন বিষয়টি সামনে আসে, তখন জনসন সরকার জোরেশোরে করোনার ওমিক্রন ধরন নিয়ে বিধিনিষেধ ও করণীয় নিয়ে খুব ঢাকঢোল পেটানো শুরু করে। তখন তার প্রতিপক্ষ এবং নানা মিডিয়ার পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল, করোনা নিয়ে তিনি এখন অপ্রয়োজনীয়ভাবে ‘মাঠ গরম’ করছেন তাকে নিয়ে ওঠা তীব্র বিতর্কটি থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে।

বিতর্কের সময় মানুষকে মূল বিষয় থেকে অনেক দূরে ভুল জায়গায় নিয়ে গিয়ে সে বিষয়ে বিতর্ক তৈরি করার এ চর্চাকে যুক্তিবিদ্যার ভাষায় বলে ‘স্ট্রম্যান ফ্যালাসি’। সারা বিশ্বের রাজনীতিকদের কাছে এটা এক অতি প্রিয় অস্ত্র। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সরকারের তৈরি করা ফাঁদে অনেকেই পা দিয়েছে। তাদের মধ্যে এমন মানুষ আছেন, যারা তাদের নির্দলীয় একটি অবস্থান থেকে এ চরম সংকটময় মুহূর্তে জাতিকে সঠিক পথ দেখাতে পারতেন।

নির্বাচন নিয়ে একমাত্র আলোচনা হওয়া উচিত নির্বাচনকালীন সরকার। তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন যে নামেই ডাকি না কেন, একটি নির্দলীয় সরকার ছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের কল্পনা করা অর্থহীন। একটা অসাধারণ শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন হলেও সেটা সম্ভব নয়।

কেন দলীয় সরকারের অধীনে একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না, তা নিয়ে আলাপ আর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কোনো তাত্ত্বিক আলোচনার প্রয়োজন নেই। আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে কোন ধরনের সরকারের অধীনে একটা সঠিক নির্বাচন হয়। বিশেষ করে যে ক্ষমতাসীন সরকারটির অধীনে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের মতো একটি প্রশ্নবিুদ্ধ নির্বাচন হয়, তার অধীনে আরেকটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এ কথা কল্পনা করাও অসম্ভব।

আর হ্যাঁ, একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপন্থিও নয়। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে বিচার বিভাগকে বাইরে রাখার শর্তে উচ্চ আদালত বলেছিলেন, সংসদ চাইলে আরও দুটি মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা যেতে পারে। আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার মতো কোনো অপশন যদি নাও থাকত, তবু একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে আমাদের দাবি জারি রাখা ও আলোচনা চলাই উচিত হতো। সংবিধান জনগণের জন্য, জনগণ সংবিধানের জন্য নয়।

একটা অসাধারণ নির্বাচন দেশের সব কিছু ঠিক করে দেবে তা নয়, কিন্তু সেটা অন্তত রক্তপাত বন্ধ করে জীবন বাঁচাবে রাষ্ট্রের। বাকি আছে অনেক জরুরি কাজও, সেগুলোতেও হাত দিতে হবে দ্রুতই।

ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম