
প্রিন্ট: ০১ মে ২০২৫, ০৫:৫৩ পিএম
পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি শনাক্ত করতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
উদ্ভাবনের সূচনালগ্নে কম্পিউটার তার আকৃতির কারণে একটি দালান দখল করে রাখলেও যুগে যুগে গবেষণার মাধ্যমে একে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন এবং এটি কীভাবে আরও দ্রুত গতিতে কাজ করতে পারে, তা নিয়ে অনবরত গবেষণা করে চলেছেন।
ফলে মানুষ পেয়েছে এনালগ থেকে ডিজিটাল কম্পিউটার; অতঃপর সুপার কম্পিউটার, মেইনফ্রেম, মিনি, মাইক্রো ও হাইব্রিড কম্পিউটার। পেয়েছে ডেক্সটপ, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট ইত্যাদি। সাফল্যের এ ধারাবাহিকতায় শিগগিরই সংযুক্ত হতে যাচ্ছে অ্যাটমিক প্রসেসরযুক্ত দ্রুতগতির কোয়ান্টাম কম্পিউটার, যার মূলে রয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং এর অ্যালগারিদম, এসেছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা থেকে।
বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ১৯০০ সালে ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন সমস্যার সমাধান দিয়েছিলেন ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্স’র মাধ্যমে। ১৯৮১ সালে বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান প্রথম কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির প্রসঙ্গ তোলেন। আর বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বিপ্লব চলছে গুগলের হাত ধরে, যেখানে আছেন জন মার্টিনিস, চার্লস নিল, সের্গিও বইক্সো, পেডরাম রওশান প্রমুখ। হুয়াওয়ে, আলিবাবা, গুগল, আইবিএম, মাইক্রোসফট, ইনটেল, অ্যামাজনসহ বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্র ও কোম্পানি নেমেছে এ কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির প্রতিযোগিতায়। চীন ৪০ কোটি এবং আমেরিকা ১.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে এ খাতে। উপযোগী সফটওয়্যার লেখার জন্য মাইক্রোসফট কিউ শার্প নামে নতুন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ উন্মোচন করেছে। প্রোগ্রামের লজিক, সিনট্যাক্স, ভুলভ্রান্তি চেক করা এবং সিমুলেট করার জন্য ‘শর’ ও ‘গ্রোভার’-এর এলগারিদমও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
কম্পিউটারের প্রাণ হলো প্রসেসর, যা কোটি কোটি ট্রানজিস্টর দিয়ে তৈরি। এ ট্রানজিস্টরকে একটা সুইচের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সুইচ অন করলে এটি ১ এবং অফ করলে ০ সংরক্ষিত হয়। আর এই ১ ও ০-এর লম্বা সারির মাধ্যমে কোনো লেটার, নম্বর বা ইনফরমেশন সেভ করা যায়। সারির এই ১ বা ০ কে বলা হয় ‘বাইনারি বিট’। বর্তমান ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটার বাইনারি পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনা করে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী প্রসেসরের ক্ষমতা বাড়াতে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করতে হচ্ছে, ফলে তা আকারে ছোট হতে হতে অ্যাটমিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
এমন অ্যাটমিক ট্রানজিস্টরে আগের মতো বিদ্যুৎ ইচ্ছামতো প্রবাহিত (Ab) বা থামিয়ে (Ad) রাখা সম্ভব হবে না। ঠিক এই পরিস্থিতিতে অ্যাটমিক ট্রানজিস্টর দিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটার’। ট্রান্সক্রিপ্টর নামের জৈব ট্রানজিস্টরটি ডিএনএ’র মধ্যকার এনজাইমের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর ফলে কোনো ডিএনএ’র ম্যাপিং ও তথ্য বিশ্লেষণ করে কোনো রোগের প্রতিষেধক বের করা সম্ভব হবে। আগামীতে এ ধরনের ট্রানজিস্টরসহ যুক্ত থাকবে মানুষের মতো পাঁচটি ইন্দ্রিয় অনুভূতি শনাক্ত করার প্রযুক্তিও। ফলে এটি দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ ও স্পর্শের অনুভূতি সহজে বুঝতে পারবে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে।
এমনকি আচরণ ও অনুধাবন করবে মানুষের মতো। বিশেষজ্ঞদের অনুমান-স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনীতি, এনক্রিপশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, আইওটি, বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং, মেশিন লার্নিং, ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি এবং শক্তিনির্ভর শিল্পকারখানা তথা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাফল্য ত্বরান্বিত হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কল্যাণে।
কোয়ান্টাম তত্ত্বে আলোকরশ্মি কখনো কখনো এমন আচরণ করে যে, এটি কখনো ‘কণা’, আবার কখনো ‘তরঙ্গ’ মনে হয়। ‘ডুয়ালিটি’র এ আচরণ ঘটে ‘কোয়ান্টাম মেকানিকাল ফেনোমেনা’ বা ‘কোয়ান্টাম যান্ত্রিক ঘটনা’র ওপর ভিত্তি করে, যাকে কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা বাইনারি (০, ১) সংখ্যার মিশ্রণ (স্পিন) পদ্ধতি বা ‘সুপারপজিশন’ (উপরিপাতন) হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এ ক্ষেত্রে এ বিটকে কিউবিট এবং তৈরি করা তথ্যকে ‘কোয়ান্টাম ইনফরমেশন’ বলা হয়। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যাক। ধরুন ৫ টাকার একটি মুদ্রার এক পাশে আছে বঙ্গবন্ধু সেতু, অন্য পাশে শাপলা ফুল। বঙ্গবন্ধু পৃষ্ঠকে ১ এবং শাপলার পৃষ্ঠকে ০ মনে করি।
কয়েনটিকে ফ্লোরে ছেড়ে দিলে হয় বঙ্গবন্ধুর পৃষ্ঠ উপরে, সেতুর পৃষ্ঠ নিচে অথবা ঠিক এর বিপরীতটি পরিলক্ষিত হবে। আসলে এটিই হচ্ছে বাইনারি হিসাব। কিন্তু কয়েনটিকে যদি ফ্লোরে সজোরে ঘোরানো হয়, তখন দুটি পৃষ্ঠই অনবরত (অসীম বার) ঘুরতে থাকবে। অনবরত ও দ্রুত ঘোরার কারণে কয়েনটির কোনো পৃষ্ঠকেই স্পষ্ট দেখা যাবে না ঠিকই, কিন্তু বঙ্গবন্ধু (১) এবং শাপলা (০) উভয় পৃষ্ঠই এখানে বিদ্যমান থাকছে এবং সৃষ্টি হচ্ছে ০ ও ১-এর একই সঙ্গে সহাবস্থান বা সংমিশ্রণে (সুপার পজিশন) বিশাল একটি অসীম রাশি। অর্থাৎ কয়েনের দুটি পৃষ্ঠ দিয়ে বাইনারি হিসাব (বিট) এবং অসীম সংখ্যা (কিউবিট) উভয়ই করা যাচ্ছে।
এভাবে কয়েকটি কয়েনকে একসঙ্গে ঘোরালে সৃষ্টি হবে আরও বড় অসীম সংখ্যা। এবার কয়েনের এ পৃষ্ঠকে কোয়ান্টামের কণা বা লক্ষ-কোটি অ্যাটমিক ট্রানজিস্টরের সঙ্গে তুলনা করি এবং তাদের সম্মিলিত সংমিশ্রণের ফলে কত বড় অসীম রাশিমালা সৃষ্টি হতে পারে তা অনুমান করি, যা এখনকার প্রচলিত বাইনারি পদ্ধতিতে ধারণ ও প্রসেস করা সম্ভব নয়। কারণ এখনকার কম্পিউটার একই সঙ্গে ০-১-এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারলেও সুপার পজিশনে তৈরি করা অসংখ্য ০-১-এর হিসাব করতে অক্ষম।
অথচ এ ধরনের অসীম সংখ্যামালার বিন্যাস মুহূর্তেই করে দেবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং সংরক্ষণ করতে পারবে ছোট্ট একটি কোয়ান্টাম হার্ডডিস্কে মিলিয়ন মিলিয়ন ‘কোয়ান্টাম ইনফরমেশন’। আর গতির ব্যাপারে (প্রসেসিং স্পিড) বর্তমানে প্রচলিত বাইনারি কম্পিউটার যদি হয় একটি বাইসাইকেল, কোয়ান্টাম কম্পিউটার হচ্ছে একটি জেটবিমান।
সব উদ্ভাবনই মানুষের উপকারের জন্য। কিন্তু এগুলোর অপব্যবহার মানুষের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অপব্যবহার মানুষের জন্য বয়ে আনতে পারে চরম দুর্ভোগ। আজকের ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং শুধু যৌগিক আর মৌলিক সংখ্যার ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে। অনেক বিশাল যৌগিক সংখ্যার মৌলিক উৎপাদক না জানার কারণে তাকে খুঁজে বের করতে আজকের সুপার কম্পিউটারেরও হাজার হাজার বছর লেগে যেতে পারে।
আর এ ক্ষেত্রে একমাত্র নিশ্চিন্ত ভরসা কোয়ান্টাম কম্পিউটার, যদিও এটি হবে অনেক ব্যয়বহুল। কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে ডেটা এনক্রিপশনের নতুন পদ্ধতি বের করা যাবে। ফলে ডেটা নিরাপত্তা আরও জোরদার করা সম্ভব হবে। এর সাহায্যে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের অনেক জটিল সমস্যার গাণিতিক সমাধান অতি দ্রুত করা যাবে। তৈরি হবে নতুন ধরনের ওষুধ। গাড়ি ও উড়োজাহাজের জন্য তৈরি হবে খুব হালকা ও উন্নত ব্যাটারি। নতুন অনুঘটকের সাহায্যে উন্নতমানের সার তৈরি হবে (যে পদ্ধতিতে খুবই নগণ্য পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হবে)।
এতসব সুবিধা নিয়ে ২০২৯ সালের মধ্যে যে কম্পিউটার আসছে, সেটি কখনোই সাধারণ কম্পিউটারকে রিপ্লেস করবে না। কারণ অনেক কাজ আছে, যা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের চেয়ে সাধারণ কম্পিউটার দিয়ে করা সুবিধাজনক হবে।
ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
sarker@juniv.edu