মিঠে কড়া সংলাপ
শিথিল হয়ে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একজন মানুষের জীবনচক্রকে একটি বৃত্তের সঙ্গে তুলনা করা চলে। যেমন একজন নবজাতক বা শিশুর ক্ষেত্রে তার বেড়ে ওঠার জন্য জন্মদাতা, জন্মদাত্রী অথবা অন্য কারও সাহায্য, যত্ন ইত্যাদির প্রয়োজন হয়, তেমনি বৃদ্ধকালেও তার গোসল, খাওয়া-পরা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। খাওয়া-দাওয়াসহ চলাফেরা, চিকিৎসা সহযোগিতা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার দিকনির্দেশনার দরকার হয়।
এ অবস্থায় আমাদের দেশ তথা পাক-ভারত উপমহাদেশে শিশুকাল থেকে কর্মক্ষম না হওয়া পর্যন্ত সব পিতামাতাই যেমন তাদের সন্তানদের দেখভাল, ভরণপোষণ ইত্যাদির দায়িত্বভার গ্রহণ করে, ঠিক তেমনি সন্তানরাও তাদের বৃদ্ধ পিতামাতার সব দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে। আর এ ব্যবস্থাটি আমাদের আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের একটি অপরিহার্য বিষয় হিসাবে পালন করা হয়।
হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে উপমহাদেশের প্রায় সব ধর্মের মানুষই পিতামাতাকে শ্রদ্ধার আসনে রেখে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখে। এ কারণে আমাদের দেশে সামান্য একজন দরিদ্র রিকশাচালকও তার বৃদ্ধ পিতামাতাকে সাধ্যমতো ভরণপোষণ ও সেবাযত্ন করে থাকে। ফলে বৃদ্ধ অসহায় সেসব পিতামাতাকে শেষ বয়সে অযত্ন-অবহেলার মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয় না এবং মৃত্যুকালেও সন্তানের সান্নিধ্যেই তাদের মৃত্যু ঘটে।
কিন্তু ইদানীং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব ঘটনার ব্যতিক্রমও দেখা যাচ্ছে। অনেক সন্তানই তাদের বৃদ্ধ পিতামাতার সেবাযত্ন করতে অনীহা প্রকাশ করে চলেছে। এমনকি অনেক শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন সন্তানও তাদের বৃদ্ধ পিতামাতার সেবাযত্ন তো দূরের কথা, খোঁজখবর পর্যন্ত রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। এমন অনেক সন্তান আছে, নানা অজুহাতে যারা অসহায়, বিপন্ন পিতামাতাকে এড়িয়ে চলে।
আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত ওইসব সন্তান নিজেদের আরাম-আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করে বৃদ্ধ, অসুস্থ পিতামাতার ধারেকাছে ভেড়ে না বা তাদের আচার-আচরণ দিয়ে পিতামাতাকেও তাদের কাছে ভিড়তে দেয় না। পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণে জীবনযাপনের কারণেও অনেক সন্তান পিতামাতাকে দূরে রাখে বা পিতামাতা থেকে দূরে থাকে। আবার পিতামাতার আদর-যত্নে ও কষ্টার্জিত অর্থে লেখাপড়া শিখে অনেক সন্তান বিদেশ পাড়ি জমিয়েও জন্মদাতা পিতামাতাকে বেমালুম ভুলে যায়, এমন প্রমাণও ভূরি ভূরি আমাদের জানা আছে। এমনকি মাসে-দুমাসে তারা একটা ফোন করেও কথা বলার সময় পায় না।
পিতামাতা এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে বলা হয়, ‘বিদেশে তারা ব্যস্ত থাকে।’ আর এসব নিয়ে অভিযোগ বা অভিমান করলে এই শ্রেণির সন্তানরা পিতামাতার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়ে দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেয় বলেও আমরা জানতে বা শুনতে পাই।
অথচ, আমরা এ উপমহাদেশের মানুষ বিশ্বাস ও অনুশীলনে এ ধারণাই পোষণ করি যে, বৃদ্ধ বয়সে আমরা আমাদের সন্তানদের সাহায্য-সহযোগিতায় বাকি জীবন কাটিয়ে দেব। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই যে তা হয় না তারই একটি প্রমাণ হলো, রাজধানী ঢাকা শহরের এক ব্যক্তির অতিসম্প্রতি আত্মহত্যার ঘটনা। ঘটনাপরম্পরায় জানা যায়, আত্মহননকারী ব্যক্তি একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন এবং ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত অমায়িক এবং ভদ্র মানুষ হিসাবে পরিচিত ছিলেন।
অথচ স্ত্রী এবং পুত্রের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না বা সম্পর্ক থাকলে যোগাযোগ ছিল না। স্ত্রী-পুত্রকে অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড করতে তিনি তাদের সেখানে একটি বাড়ি কিনে দেওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ ছিল না! তার স্ত্রী-পুত্র অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব লাভের জন্য মরিয়া হয়ে সেখানে পড়ে আছে।
আত্মহননকারী মহসিন খান মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, ‘সারা জীবন পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করে তিনি পরিবারকে সুখী এবং খুশি করেছিলেন, কিন্তু এখন আগের মতো সেসব করতে না পারায় স্ত্রী, পুত্র, কন্যা কেউ তাকে পছন্দ করে না!’ তিনি আরও যেসব কথা বলে গেছেন তার সবই মর্মস্পর্শী এবং বেদনাদায়ক। এ অবস্থায় মহসিন খানের আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের বর্তমান সমাজ জীবনেরই একটি করুণ চিত্র।
এক সময় যে মানুষটি পরিবারকে সুখী রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে, সে ব্যক্তিকেই দুঃসময়ে তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা দূরে ঠেলে দিলে তা মনোকষ্ট, মর্মযাতনার কারণ হবেই। কিন্তু তাই বলে এসব ক্ষেত্রে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণও ঠিক নয়। যেহেতু এ পৃথিবীতে কেউ কারও নয়, সুতরাং আত্মহত্যা না করে সংসার জীবনে একজনকে একটি লক্ষ্য খুঁজে নিতে হবে। আর সে লক্ষ্য সামনে রেখে তা অর্জনের জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা অব্যাহত রেখে অপেক্ষা করা উচিত। যে কোনো পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার কথা মাথায় আনা উচিত নয়। মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের ধর্মেও ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’ কথাটি উল্লেখ আছে।
জন্ম-মৃত্যু একটি জীবনচক্র। স্বাভাবিকভাবেই এই জীবনচক্রের পরিসমাপ্তি ঘটতে দেওয়া উচিত। কাউকে হত্যা করা যেমন উচিত নয়, তেমনি নিজেকেও হত্যা করা উচিত নয়। বিশ্বের কোনো কোনো দেশে মানুষের গড় আয়ু প্রায় ১০০ বছর বা ৩৬,৫০০ দিন। আর এ দিনগুলো বিশ্বের প্রত্যেক মানুষই উপভোগ করতে চায়। প্রতিটি দিনই মানুষ আশাবাদী হয়। অতএব সব মানুষকেই আশাবাদী হয়ে বাঁচতে হবে, সব সময় হৃদয়ে পজিটিভ ধারণা পোষণ করতে হবে।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট