স্বদেশ ভাবনা
পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হোক
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ১ ফেব্রুয়ারি পালিত হলো ‘জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস-২০২২’। দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তাছাড়া বাণী দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী, খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং খাদ্য সচিব। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য যেমন রোগপ্রতিরোধ বাড়ায়, তেমনই অনিরাপদ খাবার গ্রহণের কারণে দেহে ক্যানসার, কিডনি রোগ ও বিকলঙ্গতাসহ অনেক রোগ বাসা বাঁধে।
নিরাপদ খাদ্যের জন্য প্রয়োজন খাদ্য উৎপাদনে নিরাপদ প্রযুক্তি ও নিরাপদ খাদ্য উপকরণ ব্যবহার নিশ্চিত করা। প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেছেন, নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। তিনি আরও বলেছেন, খাদ্য উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে খাদ্যের নিরাপত্তা ও পুষ্টিমান বজায় রাখা জরুরি। দেশের প্রত্যেক মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
যিনি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তার যেমন সচেতনতা প্রয়োজন; তেমনই যিনি ভোগ করবেন তার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হবে। উল্লেখ্য, দেশে পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয় এবং বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা সূচকে দেশটির অবস্থান অনেকটা তলানিতে। কেন এ অবস্থা এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী, তা পর্যালোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
জাতিসংঘের বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা কমিটির সংজ্ঞা অনুযায়ী তখনই খাদ্যনিরাপত্তা বিরাজমান, যখন সবার কর্মক্ষম, স্বাস্থ্যকর ও উৎপাদনমুখী জীবনযাপনের জন্য সব সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্যের লভ্যতা ও প্রাপ্তির ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে। খাদ্যনিরাপত্তা নির্ধারণের তিনটি নিয়ামক হলো-এক. খাবারের প্রাপ্যতা, দুই. ক্রয়ক্ষমতা ও তিন. খাদ্যের গুণগত মান ও নিরাপত্তা। খাবারের প্রাপ্যতা নির্ধারণে ওইসব ফ্যাক্টর মূল্যায়ন করা হয়, যেগুলো খাবারের সরবরাহ ও সহজলভ্যতাকে প্রভাবিত করে। এগুলো হলো: খাবার সরবরাহে প্রাচুর্য, কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয়, কৃষি অবকাঠামো, খাদ্য উৎপাদনে অনিশ্চয়তা, দুর্নীতি এবং খাদ্য অপচয়। ক্রয়ক্ষমতা পরিমাপে যে ছয়টি অনুসূচক ব্যবহার করা হয় সেগুলো হলো, একটি খানার সার্বিক ব্যয়ে খাবারের ব্যয়ের পরিমাণ, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যার অনুপাত, মাথাপিছু জিডিপি, কৃষিপণ্য আমদানিতে ট্যারিফের হার, খাদ্যনিরাপত্তামূলক কর্মসূচি এবং কৃষকের আর্থিক সহায়তা লাভের সুযোগ। খাদ্যের গুণগত মান ও নিরাপত্তা নির্দেশকে বিশ্লেষণ করা হয় খাদ্যের বহুমুখীকরণ, পুষ্টিমান ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের উপস্থিতি, প্রোটিনের মান এবং নিরাপদ খাদ্য।
প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বনির্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। স্বাধীনতালাভের সময় দেশে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল কমবেশি ১ কোটি টন; যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার টনে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২১)। শর্করাজাতীয় খাদ্য আলু উৎপাদনে দেশ শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেনি, বরং প্রয়োজন মেটানোর পর বিদেশে রপ্তানি করছে।
পণ্যটি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। সবজি উৎপাদনেও দেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। মাছ ও মাংস উৎপাদনেও দেশ স্বনির্ভর। ডিম উৎপাদনে দেশ স্বনির্ভরতা অর্জনের কাছাকাছি। এতৎসত্ত্বেও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে পিছিয়ে থাকা এবং বাজারে অনিরাপদ খাদ্যের ব্যাপক সরবরাহের কারণে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটা তলানিতে।
আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) আর্থিক সহায়তায় এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) যৌথ উদ্যোগে তৈরি ও প্রকাশিত বাংলাদেশ আন্ডারনিউট্রিশন ম্যাপ বা অপুষ্টি মানচিত্র ২০১৪-এর ফাইন্ডিংসের মধ্যে রয়েছে-ক. গত দুই দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় উন্নতিসাধন হলেও, দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে এলেও, প্রধান খাদ্য চালে স্বনির্ভরতা অর্জনে প্রায় সক্ষম হলেও, জন্মহার ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেলেও, শিক্ষার হার বেড়ে গেলেও পুষ্টির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।
খ. দারিদ্র্য মানচিত্রে চট্টগ্রাম ও সিলেট সবচেয়ে সচ্ছল বিভাগ হিসাবে চিহ্নিত হলেও অপুষ্টি মানচিত্রে ওই দুটি বিভাগে অপুষ্টিজনিত কারণে পাঁচ বছর বয়সের নিচে খর্বাকৃতি ও কম ওজনের শিশুর হার সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে পাঁচ বছর বয়সের নিচে খর্বাকৃতি শিশুর সর্বোচ্চ হার চট্টগ্রাম বিভাগের বান্দরবান জেলায়; এ হার ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে একই বিভাগের কক্সবাজার জেলা; ৪৭ শতাংশ। সিলেটে এ হার ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ। পাঁচ বছরের নিচে কম ওজনের শিশুর সর্বোচ্চ হার সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায়। এ হার ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ। দারিদ্র্য মানচিত্র অনুযায়ী, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৩৯টিতে খর্বাকৃতি শিশুর এবং ৫৫টি জেলায় কম ওজনের শিশুর হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি। তবে ২০১৬ সালে দেশে পাঁচ বছর বয়সের নিচে খর্বাকৃতি শিশুর হার ৩৬ শতাংশে নেমে আসে বলে বৈশ্বিক পুষ্টি প্রতিবেদন-২০১৬ থেকে জানা যায়।
বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে মাথপিছু আয় ও পারিবারিক আয় দুই-ই বেড়েছে। তবে সেই সঙ্গে বিবিএসের প্রতিবেদনে এটিও স্বীকার করা হয়েছে, ধনী-দরিদ্রের আয়বৈষম্য বেড়েছে। আয়বৈষম্য পরিমাপের অন্যতম সূচক গিনি সহগের মান ২০১০ সালে ছিল দশমিক ৩২১, যা ২০১৬ সালের চূড়ান্ত হিসাবে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৩২৪। তাছাড়া মানুষের মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ কমেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক গড়ে ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ২ হাজার ২১০ কিলোক্যালরি, যা ২০১০ সালে ছিল ২ হাজার ৩১৮ কিলোক্যালরি। ক্রয়ক্ষমতার অভাবে দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করতে পারছে না। ফলে তাদের খাবারে ক্যালরির পরিমাণ উপর্যুক্ত গড় পরিমাণ ক্যালরির চেয়ে অনেক কম থাকে। তারা খাদ্যনিরাপত্তার হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। ‘দ্য স্টেট অব ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-২০১৯’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ছয়জনের একজন অপুষ্টিতে ভুগছে। এর পেছনের কারণগুলোর অন্যতম অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ।
বাজারে অনিরাপদ খাদ্যের প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন সরবরাহ বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের অস্বস্তিকর অবস্থানের জন্য অনেকটা দায়ী। আমাদের প্রধান খাদ্য চালে ভেজাল। বিভিন্ন অটো রাইস মিল কর্তৃক চাল কেটে বা ছেঁটে পুষ্টিগুণ নষ্ট করে বাজারজাত বা বিক্রি করাতে জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। এরূপ চালের বাজারজাত বন্ধে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে উচ্চ আদালত রুল জারি করেছেন। মুড়িতে ইউরিয়া, মাছ, দুধ, ফলমূলে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক, শুঁটকিতে ডিডিটি, ভাজা খাবারে লুব্রিক্যান্ট, বিস্কুট, আইসক্রিম ও নুডলসে টেক্সটাইল ও লেদার রং, গুঁড়া মসলায় ভুসি, ইটের গুঁড়া-এসব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ভেজালের দৌরাত্ম্য রয়েছে মধু, মিষ্টি, দধি, আচার, ঘি, জুস, ডালডা, সেমাই, ভোজ্য তেল ও বেসনে। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল মোটাতাজা করতে খাওয়ানো হয় বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিক্যাল। মাছ অল্প সময়ে বড় করার জন্য ব্যবহার করা হয় হরমোনসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল। এসব ভেজাল খাবার খেয়ে জনগণ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিজ্ঞজনের মতে, খাদ্যে ভেজাল মেশানো একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এবং যারা এতে জড়িত, বিশেষ করে যারা এর মূল হোতা, তারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান। এরা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের সদস্য। তাই তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। কোনো আইন তাদের স্পর্শ করতে পারে না।
‘গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেস্ক বা বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা সূচক-২০২০’-এ ১১৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। ২০১৯ সালে অবস্থান ছিল ৮৩তম। শুধু বৈশ্বিকভাবেই নয়, সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে।
বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থাকরণ এবং তাদের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত করেছে [অনুচ্ছেদ ১৫(ক) এবং ১৮(১)]। এ সূত্র ধরেই প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। রাষ্ট্রের পক্ষে মানুষের এ সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। মানুষের অনেক মৌলিক অধিকারের মতো এটিও অবহেলিত। বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা সূচকে উন্নতি করতে হলে অনিরাপদ খাদ্য সরবরাহের ওপর জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বাজারে অনিরাপদ খাদ্য সরবরাহ বন্ধে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। অনেকে এ সংস্থাটির অস্তিত্ব সম্পর্কেই অবহিত নন। জনগণের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা এবং বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের সম্মানজনক অবস্থান অর্জনে খাদ্যে পুষ্টিমানের বৃদ্ধি এবং নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com