
প্রিন্ট: ০১ মে ২০২৫, ০৮:০১ এএম
রাজনীতির মধ্যে সত্যিই পলটিক্স ঢুকে গেছে?

রফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র যেমন পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত, তেমনই প্রগতিশীল রাজনীতিতে সমানতালে আগুয়ান। ছেলেটি পড়াশোনা করে সবার মুখ উজ্জ্বল করবে সেই আলোচনাও যেমন চাউর, তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আলাপও গ্রামের ছোট-বড় সবার মুখে মুখে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় মেধাবী ছেলেটি তার গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে কিছুদিন অবস্থান করছিল। গ্রামের বিভিন্ন বয়সি মানুষের সঙ্গে ছেলেটির কথা হয়; সে তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা তাদের কাছে তুলে ধরে।
এক কান, দুই কান করে আলাপগুলো গ্রামের প্রায় সব মানুষের কাছে পৌঁছে যায় এবং সবার আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ লোকজন দুঃখ করে বলতে থাকে, ‘ছেলেটি ঢাকায় গিয়ে নষ্ট হয়ে গেল, রাজনীতিতে যোগ দিল’ ইত্যাদি। তাদের পরিতাপের শেষ নেই। ছেলেটির ছুটি প্রায় শেষ আর দিন দুই পর সে ঢাকায় চলে আসবে। এমন সময় একদিন গ্রামের এক বৃদ্ধ ‘চাচা’ ছেলেটির কাছে এসে অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে বললেন, ‘বাবা, শুনলাম তুমি ঢাকায় গিয়ে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছ, আমরা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছি। তুমি অনেক ভালো ছাত্র, আমাদের আশা-ভরসা। তুমি এগুলো বাদ দাও, রাজনীতি খারাপ জিনিস, কারণ সুষ্ঠু রাজনীতি আমাদের দেশে আর নেই। এখন রাজনীতির মধ্যে পলটিক্স ঢুকে গেছে।’
এখন দেখছি গল্পের সেই চাচার কথাটাই সত্য! সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে আমরা প্রায়ই বলে থাকি, সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র। আর রাষ্ট্রকে জনস্বার্থে পরিচালনার যে রীতি, সেটাই রাজনীতি। বর্তমানে রাজনীতির নামে যে ধরনের পরস্পরবিরোধী অপপ্রচার ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, তাতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বই না হুমকির মুখে পড়ে। রাজনীতির নামে সরকারবিরোধী শিবির থেকে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিরোধী দল নাকি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধরনা দিচ্ছে, লবিস্ট নিয়োগ দিচ্ছে দেশের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের প্রত্যাশায়। চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে অকার্যকর ও সন্ত্রাসী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে। আমার কাছে এ ধরনের তৎপরতা গাছের ডালে বসে গাছের গোড়া কেটে দেওয়ার শামিল। কারণ বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে যে অর্থনৈতিক আস্থা তৈরি করেছে, তাতে চিড় ধরলে সবার জন্যই বিপর্যয় নিয়ে আসবে; তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে-বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এমন ধ্বংসাত্মক এবং প্রতিপক্ষের প্রতি বিধ্বংসী সেই ডকট্রিনের মতো, ‘হয় মরো না হয় মারো’ প্রকৃতির হয়ে উঠছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনের বিষয়। তবে আমার মনে হয়, দীর্ঘ ঔপনিবেশিক রাজনীতির একটা প্রভাব এখানে পড়তে পারে। আমরা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে সব সময় অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাজনীতিতে অভ্যস্ত ছিলাম এবং সেখানে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরোধিতায় একই প্রকৃতির রাজনৈতিক কার্যক্রমকে তুলে ধরা হতো। পাকিস্তান আমলেও একই ধরনের তৎপরতা লক্ষ করা গেছে। আমরা যদি ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের স্লোগানগুলো দেখি, তাহলে সহজেই তা বোঝা যাবে। তখন রাজপথে মিছিল হতো-‘পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা; ঢাকা, ঢাকা’। সেসব রাজনৈতিক স্লোগান সরকারের নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে সমূলে আঘাত করত এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে আহ্বান জানাত।
আজ বাংলাদেশ কোনো পরাধীন উপনিবেশ নয়। আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। লাখ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। যদিও স্বাধীনতার অব্যবহিত পর কোনো কেনো বৃহৎ শক্তি ভেবেছিল, বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশ হিসাবে অভিহিত করা হতো। আজ আমরা সেখান থেকে অনেক পথ এগিয়েছি; আজ বাংলাদেশ একটি অর্থনৈতিক শক্তি এবং উন্নয়নের রোল মডেল। কিছু স্বার্থান্বেষী দুষ্ট রাজনীতিকের কারণে সেই সম্মান ও অর্জন যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক অবরোধের সম্মুখীন হয়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম তাদের ঘৃণা জানাবে এবং মীরজাফর ও মহাম্মদী বেগের মতো বিশ্বাসঘাতক হিসাবে চিহ্নিত করতে দ্বিধা করবে না।
এটাও সত্য, শুধু ঔপনিবেশিক লিগেসির কারণে যে আমাদের রাজনীতি দুই বিপরীত মেরুতে এবং পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে উপনীত হয়েছে, তা নয়। ’৭৫-এ জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা, সামরিক শাসন, ২১ আগস্টসহ নানা ঘটনা রয়েছে, যা বড় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঋণাত্মক সম্পর্ক তৈরি করেছে এবং তা এ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আজ এমন যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে যে, এখানে প্রতিপক্ষকে আঘাত করে করে ধ্বংস না করা পর্যন্ত অন্যপক্ষের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। এ ভাবনা রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা এবং দলীয় যুদ্ধকে একাকার করে তুলেছে। এখানেই বড় শঙ্কা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি শিক্ষকতা করি এবং তরুণদের নিয়ে সংগঠন করি। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে তরুণদের সঙ্গেই থাকি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে হলফ করে বলতে পারি, বিদ্যমান এ যুদ্ধাবস্থাকে পরবর্তী প্রজন্ম, যারা আগামী দিনের বাংলাদেশের মালিক; যাদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তথাকথিত এত প্রচেষ্টা, তারা এ ধরনের তুচ্ছ মানসিকতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। এ কারণেই বিদ্যমান রাজনীতির প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহের ঘাটতি প্রায়ই চোখে পড়ে।
আমার কাছে রাজনীতি হচ্ছে সংস্কৃতি ও দেশপ্রেমের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই দেশবিরোধী বালখিল্য রাজনৈতিক তৎপরতা অন্য দশজনের মতো আমাকেও ভাবায়, আমাকেও কাঁদায়। তবে সচেতন নাগরিক হিসাবে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিকরা খেলা খেলে যাবে আর আমরা দর্শকের মতো দেখে যাব, তা হতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে যতখানি দীপ্যমান, তার অংশীদার আমি, আপনি, আমরা সবাই। পরিতাপের বিষয়, আমরা দেশবিরোধীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত নই।
ব্যক্তিগতভাবে আমি একটা সহজ ফর্মুলা অনুসরণ করি আর তা হচ্ছে-বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও জাতির পিতার প্রতি সম্মান। কেউ যদি এ ছকের মধ্য দিয়ে পাশ করে যায় এবং ইতিবাচক স্কোরিংয়ে থাকে, তাহলে এদেশে তার রাজনীতি করার অধিকার থাকা উচিত। এবং তাকে সহযোগিতা করাও একধরনের কর্তব্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফ্যাকাল্টি হিসাবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ঘটনাকেও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, যা তুলে আনা দরকার। ছাত্রদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর পুলিশি হামলা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। ছাত্রছাত্রীরা বা জনগণ শিক্ষক বা ডাক্তারদের বিরুদ্ধে যত আন্দোলন ও অনশন করছে, অন্য কারও বিরুদ্ধে যৌক্তিক কারণ থাকা সত্ত্বেও তা করতে পারছে না। কারণ ডাক্তার বা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তেমন কোনো ঝুঁকি নেই। সেক্ষেত্রে তাদের সংগ্রামী তকমা পাওয়া সহজ। সমাজের অন্যান্য অসংগতির বিরুদ্ধেও এ তৎপরতা দেখা গেলে ভালো হতো। আমি কোনোভাবেই উপাচার্য বা সরকারের পক্ষে সাফাই গাইছি না এবং সুযোগও নেই; কিন্তু ঘটনা সত্য। তাছাড়া শিক্ষাঙ্গনেও বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ‘পলিটিক্স’ দেখা যায়, বিশেষ করে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে যখন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়; তখন সেই উপাচার্য প্রায়ই বহিরাগত বনে যান এবং প্রায়ই অসহযোগিতার শিকার হন। এসবও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তবে ছাত্রছাত্রীরা যখন সম্মান করতে প্রস্তুত নয়, তখন সেই শিক্ষাঙ্গন পরিত্যাগ করাই ভালো।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, লেকার শুরুতে উল্লেখিত চাচার কথাই সত্য। রাজনীতির মধ্যে পলটিক্স ঢুকে গেছে। আর যেহেতু রাজনীতির বাইরে কিছুই নেই, তাই রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেলে আর কিছুই বাকি থাকে না। আমাদের উচিত রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন এনে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে হীন ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখা এবং দেশের স্বার্থে রাজনীতি করা।
রফিকুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়