আত্মহত্যা কমিয়ে আনা সম্ভব
ড. মতিউর রহমান
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
সম্প্রতি প্রকাশিত এক সমীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছর (২০২১) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, করোনা মহামারিকালে ওই বছর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১০১টি। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে, যা ৬১.৩৯ শতাংশ বা ৬২ জন।
মেডিকেল কলেজ ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার এ সংখ্যাটি ১২, যা মোট আত্মহননকারীর ১১.৮৮ শতাংশ। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংখ্যাটি ৪, যা মোট আত্মহত্যাকারীর ৩.৯৬ শতাংশ। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২২.৭৭ শতাংশ, যা সংখ্যায় ২৩ জন।
আত্মহত্যাকারীদের একটি বড় অংশই ছিল পুরুষ শিক্ষার্থী। সর্বমোট ৬৫ জন পুরুষ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন, যা মোট শিক্ষার্থীর ৬৪.৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটি ছিল ৩৬ জন বা ৩৫.৬৪ শতাংশ। করোনার মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপ বেড়ে যাওয়া পুরুষ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে বড় প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন। এক বছরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ওই বছরই বেশি বলে তারা মনে করেন।
স্নাতক (সম্মান) অধ্যয়নরত তৃতীয় ও চতুর্থবর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার তুলনামূলক বেশি, যা ৩৬.৬৩ শতাংশ। ধারণা করা যায়, এ শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক মানসিক ও সামাজিক চাপ বেশি থাকে এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে তাদের মাঝে হতাশার ছাপ বেশি দেখা যায়। এ কারণে তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
সম্পর্কগত কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ২৪.৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং পারিবারিক সমস্যার কারণে এ পথে ধাবিত হয়েছে ১৯.৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী। অন্যদিকে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫.৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ। পড়াশোনাসংক্রান্ত কারণে আত্মহত্যা করেছে ১০.৮৯ শতাংশ এবং আর্থিক সমস্যায় আত্মহত্যা করছে ৪.৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।
প্রতিবেদন থেকে আরও দেখা যায়, মাদকাসক্ত হয়ে নির্বিকারে নিজের জীবনহননের পথ বেছে নিয়েছে ১.৯৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া আরও নানাবিধ কারণে আত্মহত্যা করেছে মোট ২১.৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাধারণত নারী শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা গেলেও এবার বিশেষভাবে লক্ষণীয়, পুরুষ আত্মহত্যাকারীদের সংখ্যা নারীদের প্রায় দ্বিগুণ। করোনার মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপ বেড়ে যাওয়া পুরুষ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে বলে সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যার কারণগুলো বাইরে থেকে যতটা দেখা যাচ্ছে, সমস্যা এর চেয়েও গভীর। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজনীয় শিক্ষার সুযোগ অপর্যাপ্ত বিধায় তাদের জীবনে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে তারা সেটা সামলাতে পারে না। প্রেমে বিচ্ছেদ হলে তারা যেমন ভেঙে পড়ে, তেমনই পরীক্ষায় খারাপ ফলও তাদের আশাহত করে। শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুযোগের সমতার অভাব বা রাষ্ট্র কর্তৃক কর্ম প্রদানের নিশ্চয়তার অভাবের কারণেও অনেকের মধ্যে হতাশাবোধ জন্ম নেয়, যা পরবর্তী সময়ে তাদের আত্মহত্যার দিকে চালিত করে।
সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্রবণতার কারণগুলো বিভিন্নভাবে উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করেছেন। মনোবিজ্ঞানীরা আত্মহত্যার কারণ হিসাবে বিষণ্নতা ও মানসিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন, সামাজিক কারণগুলো হতাশা ও মানসিক অসুস্থতার জন্য দায়ী। সুতরাং সামাজিক কারণগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা সংঘটনের জন্য দায়ী।
সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত তার ‘সুইসাইড’ গ্রন্থে আত্মহত্যার জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করে সামাজিক কারণগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার মতে, আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা। তিনি মূলত সামাজিক সংহতি এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে আত্মহত্যাকে সম্পর্কিত করে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ডুর্খেইম বলেন, যারা সমাজের সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত, তারা আত্মহত্যা করে। আবার যারা সমাজ থেকে অতিমাত্রায় বিচ্ছিন্ন, তারাও আত্মহত্যা করে।
যা হোক, আত্মহত্যার চিন্তা জটিল এবং যেসব কারণ আত্মহত্যার দিকে পরিচালিত করে, তা আরও জটিল ও বহুমাত্রিক। কোনো একক কারণ সবার জন্য সমানভাবে কাজ করে না। আমরা যা জানি তা হলো, কিছু নির্দিষ্ট কারণ এবং জীবনের ঘটনা আছে, যা কাউকে আত্মহত্যার জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা, যেমন উদ্বেগ এবং বিষণ্নতাও এক্ষেত্রে অবদান রাখে। যারা আত্মহত্যা করে তারা তাদের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং আশপাশের লোকের সঙ্গে প্রবল সংহতিবোধ করতে পারে। আবার তারা নিজেদের অন্যদের কাছে বোঝাও মনে করতে পারে। সুতরাং উভয় ক্ষেত্রেই কারোর জন্য আত্মহত্যার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। এবং এভাবে তারা মনে করে, আত্মহত্যা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই। কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষের জন্য বিচ্ছিন্নতা এবং দুর্বলতার অনুভূতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে, যা অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাকে তীব্র করে তুলেছে।
আত্মহত্যা মহাপাপ। আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। পৃথিবীর সব ধর্মে এবং নৈতিকতায় আত্মহত্যার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। তাহলে মানুষ কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? আত্মহত্যা নির্মূল বা কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টা রয়েছে। আইন, বিধি ও নীতিমালাও রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। যদি আমরা আত্মহত্যার পেছনের গল্পটি দেখি, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই যে চিত্রটি মনে আসে, তা হলো যৌতুক, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, প্ররোচনা, চাপ, হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, চাহিদা এবং আকাক্সক্ষার মধ্যে পার্থক্য, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীনতা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি প্রভৃতি।
এসব কারণে অনেকেই আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথ বেছে নেয়। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? বিশেষজ্ঞদের মতে, এর থেকে পরিত্রাণের জন্য সাইকোথেরাপি, ইতিবাচক মনোভাব, সহানুভূতি, বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করা, কথা বলার ও আবেগ ভাগাভাগি করার পরিবেশ তৈরি করা এবং আত্মসমালোচনা অপরিহার্য। আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে হলে নীতিনির্ধারকদের প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে আরও বেশি সমন্বিত প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মের সুযোগ সৃষ্টি ও কর্মনিশ্চয়তা প্রদান জরুরি। ক্রমবর্ধমান অসমতা দূরীকরণ এবং সেই সঙ্গে দরকার সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, এখনই পদক্ষেপ নিতে না পারলে পরবর্তী সময়ে আমাদের অনুশোচনা করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় দায়িত্বশীলদের অবদান রাখার সঠিক সময় এখনই। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান বিশেষত কোভিড পরিস্থিতিতে এ বিষয়ের পরিসংখ্যান এবং এর ফলাফল যথেষ্ট ভীতিকর। কোভিড-১৯ ভাইরাস নিয়ে আমরা যতখানি আতঙ্কিত, আত্মহত্যা করা অসংখ্য মানুষকে নিয়ে আমরা ততটা চিন্তিত নই।
এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা যদি তাদের শেখাতে পারি, ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না কেন, সেটা জীবনেরই অংশ এবং আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে তাদের ধৈর্যশীল হতে হবে, তাহলে এ শিক্ষার্থীরা যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারবে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বাস্তবমুখী কিছু জ্ঞান যেমন: আর্থিক ব্যবস্থাপনা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক দক্ষতা উন্নয়ন ইত্যাদি আত্মহত্যা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রচারণা, প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এবং আত্মকর্মসংস্থান তৈরি, কমিউনিটি ও পরিবারের সহায়তায় হতাশামুক্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করতে এখনই সবার এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দৃঢ়করণে একজন করে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলর নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। আমাদের সবার সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা কমানো সম্ভব।
আত্মহত্যা রোধ করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব এবং এর প্রতিরোধে আমি-আপনি সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি। কারও জীবনের কঠিনতম সময়ে আমাদের কর্মের মাধ্যমে সমাজের সদস্য হিসাবে, বাবা-মা হিসাবে, শিক্ষক হিসাবে, বন্ধু হিসাবে, সহকর্মী বা প্রতিবেশী হিসাবে অবদান রাখতে পারি। যারা আত্মঘাতী হওয়ার মতো সংকটে ভুগছেন বা যারা কারও আত্মহত্যায় শোকাহত, তাদের সহায়তায় আমরা সবাই ভূমিকা রাখতে পারি। তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি-সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজ জীবনের জন্য যা অপরিহার্য।
ড. মতিউর রহমান : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী