সংবাদপত্রের প্রাসঙ্গিকতা
অমিত রায় চৌধুরী
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্থান-কাল-পাত্র নিয়ত বদলে চলে। চারপাশ-প্রতিবেশও পালটে যায়। সময় এগিয়ে যায়। সভ্যতারও বয়স বাড়ে। রাষ্ট্র কিংবা সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কেও ধারণাগত রূপান্তর অব্যাহত থাকে। আর সমাজের যেসব প্রকরণ সভ্যতার কাঠামোকে মজবুত ও যুক্তিশীল করেছে-তার মধ্যে সংবাদমাধ্যম অন্যতম। সভ্যতার এক মৌলিক অবদান সংবাদপত্র। নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশ কিংবা স্রেফ যোগাযোগের এ সেতুবন্ধটি আধুনিক রাষ্ট্রে আজ অপরিসীম গুরুত্ব পাচ্ছে। গণমাধ্যমের বৈশিষ্ট্য অনেক ক্ষেত্রেই সমষ্টির চরিত্র নির্ধারণে মাপকাঠি হয়ে পড়ছে।
ব্রিটিশরা ব্যবসা করতেই ভারতবর্ষে এসেছিল। আর এ কথাও ভুল নয়-প্রাচ্যের অনেক আঁধারও হয়তো ঘুচে গিয়েছিল পাশ্চাত্য সভ্যতার আলোকস্পর্শে। ১৭৮০ সালে প্রকাশিত হিকির বেঙ্গল গেজেট পৃথিবীকে নতুন করে জানা-চেনার জানালা খুলে দিয়েছিল। ১৮১৮ সালটি এই উপমহাদেশে সংবাদপত্র বিকাশের ইতিহাসে খুবই চর্চিত একটি অধ্যায়। শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চের প্রকাশনায় সমাচার দর্পণ বা গঙ্গাকিশোরের বাংলা ভাষায় মুদ্রিত বেঙ্গল গেজেটের প্রকাশকালও এই বছর। বেশকিছু পত্রপত্রিকার আত্মপ্রকাশ নতুন ভোরের আভাস দেয়। মুক্ত মতপ্রকাশের দাবি শক্তি সঞ্চয় করে। মুদ্রণ সাংবাদিকতা ঔপনিবেশিক কলকাতায় উর্বর জমি পেয়ে যায়। ইউরোপীয় রেনেসাঁর উত্তাপ তখনও ম্লান হয়নি। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাপট জারি থাকলেও চিন্তার জগতে তার ছাপ তখনও বেশ স্পষ্ট। এডমন্ড বার্ক ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে আখ্যায়িত করেন। এ ধারণা গণতন্ত্রের ধ্রুপদি কল্পনায় নতুন মাত্রা নিয়ে আসে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বা মানবাধিকার উন্নয়নের সঙ্গেও মতপ্রকাশের অধিকার ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়ে। রাজা রামমোহন রায় বাংলায় নবজাগরণের মানসপুত্র হিসাবে আবির্ভূত হন। তার সম্পাদিত পত্রিকাগুলো কার্যত হয়ে ওঠে মুক্তবুদ্ধি, শুদ্ধ বিবেক ও প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। সতের শতকে কবি মিলটন যেমন বাকস্বাধীনতার পক্ষে ইউরোপে আওয়াজ তুলেছিলেন, স্বাধীন প্রেসের পক্ষে এমনই যুক্তিশীলতা চর্চার বলিষ্ঠ উচ্চারণ হয়ে ওঠেন রাজা রামমোহন রায়। আদালতে তার সওয়াল ‘অ্যারিওপ্যাজেটিকা অব হিস্ট্রি’ বলে খ্যাত হয়।
১৯৩৬ সালে কলকাতায় প্রকাশিত মওলানা আকরম খাঁর ‘আজাদ’ পত্রিকা ১৯৪৮ সালে পরিবর্তিত বাস্তবতায় নতুনভাবে পথচলা শুরু করে। ১৯৪৯ সালে দৈনিক অবজারভার ও সংবাদ পত্রিকাই বিভক্ত ভারতের এ ভূখণ্ডে প্রথম সংবাদপত্র। এরপর আসে পূর্বদেশ, মর্নিংনিউজ, ইত্তেফাক। তবে যেটা খেয়াল করার মতো বিষয়, তা হলো-দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর দেশভাগ হলেও ৪৭-৭০ পর্যন্ত একটি ধর্মভিত্তিক, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবাদপত্রগুলো শুধু স্বাধীন মতপ্রকাশে বা সুস্থ জনমত গঠনে ভূমিকা নেয়, তা নয়; কার্যত জনমানসে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, দেশাত্মবোধ ও বিশেষ করে অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। পাকিস্তানি কর্তৃত্বকামী শাসন কাঠামোর বিরুদ্ধে উদার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শানিত করতে ইতিহাসের পরতে পরতে অবদান রেখে চলে। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব ঐক্য সৃষ্টি হয়। ভাষা আন্দোলন হতে শিক্ষা আন্দোলন হয়ে ছয় দফা, এগারো দফা বা গণ-অভ্যুত্থান সর্বত্রই সংবাদপত্র নির্ণয়ক ভূমিকা পালন করে। আরও গুরুত্বপূর্ণ যে, আন্দোলন সংগ্রামগুলোকে নস্যাৎ করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের সব চক্রান্ত রুখে দেওয়া বা বিভাজন-সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেওয়ার মতো পরিকল্পিত অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ওয়াচডগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বিভিন্ন মতের বিভক্ত স্রোতধারার অভিমুখ ঠিক করে দেওয়াও গণমাধ্যমের অ্যাজেন্ডায় পরিণত হয়েছিল। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু এ স্বাধিকার আন্দোলনকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে পরিণত করেন। সেখানেও সংবাদপত্রের ভূমিকা হয় তাত্ত্বিক ও অভিভাবকসুলভ।
অথচ মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে পত্রিকা বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। আক্ষেপ আছে, সংখ্যা বেড়েছে; কিন্তু মান কমেছে। নিষ্ঠাতেও ঘাটতি পড়েছে। সমকালীন বিশ্ববাজারের ঢেউ উপচে পড়েছে এদেশেও। শিক্ষা, বাণিজ্য, শিল্প সবখানেই মুক্তবাজারের অবাধ দখলদারি। প্রতিযোগিতা, লোভ, কর্তৃত্ব সমানে শাসন করছে সমাজ। বণ্টনে অসমতা তীব্রভাবে দৃশ্যমান। সংবাদপত্রের দায় সমাজ ও বিবেক উভয়ের কাছেই। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের পপুলিস্ট উত্থানের মাঝেও মূলধারার সংবাদপত্রের একদিকে বেঁচে থাকার লড়াই, অন্যদিকে বাণিজ্যের হাতছানি। তার সঙ্গেই রয়েছে রাষ্ট্রের খবরদারি। এর মধ্যে নীতি-আদর্শ নিয়ে সংবাদপত্র শিল্পের টিকে থাকা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ।
সংবাদপত্রের অস্তিত্ব টিকে থাকে পাঠকের মস্তিষ্কে। সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় চাহিদা। আবার এ তাড়নাও তৈরি করে পত্রিকা; যা সত্তর পূর্ববর্তী সময় আমরা দেখেছি। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, জহুর হোসেন চৌধুরী, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কিংবা আব্দুস সালামের মতো তারকা পুরুষেরা মধ্যবিত্তের রুচিতে স্নিগ্ধতা, দৃষ্টিতে স্বচ্ছতা, মননে সংবেদনশীলতা ও মস্তিষ্কে বিজ্ঞানমনস্কতার ভ্রূণ সঞ্চার করতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক পর্যায়গুলো এভাবেই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছিল। আজ সেখানে প্রকট এক শূন্যতা ক্রমশ গ্রাস করছে। বিবর্তিত মূল্যবোধ পাঠকের দৃষ্টিকেও আচ্ছন্ন করে ফেলছে। মিথ্যা সংবাদ, গুজব ও প্রোপাগান্ডার অব্যাহত ঢেউ সামাজিক মনস্তত্ত্বকে বদলে ফেলছে। সৃষ্টি হচ্ছে চাহিদার নতুন আদল।
বিজ্ঞাপন সব সময়ই পত্রিকার বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন; কিন্তু বিজ্ঞাপনসর্বস্ব হয়ে পত্রিকা আগে তার আদর্শ হারায়নি। এটা যেমন ঠিক, অন্যদিকে একথা সত্য-সাংবাদিকও এ সমাজের মানুষ। তারও সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। পত্রিকাকে আবার সামলাতে হয় কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতাকে; যার মালিক কখনো কালোটাকার কারবারি, কখনো অনিয়ন্ত্রিত মুনাফাকামী বাজার বা কখনো রাষ্ট্র স্বয়ং। ফলে তাকে আপস করতে হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, গণমাধ্যম যদি তথ্যনির্ভর বা বস্তুনিষ্ঠ না হয়, তাহলে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিপত্তি বা শক্তির অনুগত হলে সাময়িক সুবিধা মেলে বটে; কিন্তু সাংবাদিকতা হেরে যায়, মৃত্যু হয় যুগলব্ধ প্রতিজ্ঞার। পাঠকের সস্তা চাহিদা সংবাদের অগ্রাধিকার ঠিক করলে, জনপ্রিয়তা বাড়ে ঠিকই; কিন্তু চূড়ান্ত সত্য দিন শেষে আবেগের কাছেই হার মানে।
সংবাদপত্র তার বৈধতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে সবচেয়ে বেশি লাভ হয় ক্ষমতার। পুঁজি হারায় সংবাদপত্র; যার আনুগত্য থাকে জনগণের কাছে। ক্ষমতা, পেশি, অর্থ বা রাষ্ট্র যাই হোক না কেন-স্বভাবতই তা প্রতিস্পর্ধাকে সহ্য করে না। কিন্তু সংবাদপ্রবাহকে হতে হবে সরল, নিরপেক্ষ ও নির্মোহ। চমক না, নির্ভেজাল তথ্যই হবে গণতন্ত্রের নিশ্বাস। এমনকি তাৎক্ষণিক সংবাদের ভালো-মন্দ যাচাই করাও সাংবাদিকের কাজ নয়। এমনকি নৈতিকতা-অনৈতিকতা বিচারও নয়। তবে প্রযুক্তিচালিত এই সমাজ যখন তথ্যের সুনামিতে ডুবে আছে, তখন যুক্তির মুখোশে মিথ্যা প্রচারের ঝুঁকি তো থাকবেই। তাই জটিল এ সময়ে সাংবাদিককে থাকতে হবে সজাগ, হতে হবে সাবধানি, দায়িত্বশীল।
কর্তৃত্ব ও শক্তির বিপরীতে সংবাদপত্রই হলো আমজনতার কণ্ঠ। বহুত্ববাদী সমাজকে এক সুতোয় বেঁধে রাখার ক্ষমতাও এ মাধ্যমের। সুস্থ জাতিগঠনের দায়ও তাই এ মাধ্যমের। কেননা জনমতকে ভুলপথে চালিত করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা এ মাধ্যমের। অক্ষর ও ছবির এত পরাক্রম মানবজাতি আগে দেখেনি। আয়েশি মনকে তা আশ্রয় করে সহজেই। আবেগকে উসকে দেয়। প্রতারণার ফাঁদে বিকৃতির জাল বোনে গোপনে। সমষ্টিগত ধারণা আক্রান্ত হয়, পরিবর্তিত হয়, যা ভয়ংকর ও বিপজ্জনক। মিডিয়ার পরাক্রম মৌলবাদের দখলে গেলে তো আর কথাই নেই। সত্য বিনির্মাণ হতে থাকে অবিরাম। মতলববাজ রাজনীতি তা নিয়ে খেলা করে। তৈরি হয় আন্তর্জাতিক সমাজ। সামাজিক রূপান্তরের নতুন পর্ব। মৌলবাদ এ অবস্থার সুবিধা ঘরে তোলে সহজেই। বিপদটা এখানেই।
মানবমন খুবই রহস্যময়। নিজের মতকেই সে নিয়ত পুষ্ট করে চলে। সত্য হেরে যায় পক্ষপাত ও আবেগের কাছে। জনপ্রিয়তা কিংবা নিজস্ব মতাদর্শ খবরের মূল্য সংযোজন করে। যে দৃষ্টি নিজ দেশে ‘হাইব্রিড গণতন্ত্রের’ ছায়া দেখে, তা চীন-উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে উধাও হয়ে যায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে দেশে যে বিচারবোধ জাগ্রত, পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের বেলায় তার আখ্যান আলাদা। ভারত, ইংল্যান্ড বা আমেরিকার বেলায় ধর্ম নিরপেক্ষতার ধারণা এক রকম, কিন্তু নিজ দেশে তা সম্পূর্ণই বিপরীত।
গুজব, অসত্য তথ্য বা বিকল্প সত্য-যাই বলি না কেন, আধুনিক যুগে এসব নানা বিপত্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মূলধারার গণমাধ্যমই শেষ ভরসা। প্রহরীহীন সামাজিক মাধ্যমের দুরন্ত গতিকে সামলে নিতে দরকার পড়বে প্রযুক্তির সাহচর্য ও ত্বরিত সত্য যাচাইয়ের সক্ষমতা। মনে রাখতে হবে, পাঠক এখন ডিজিটাল বাজারেও ভোক্তা। প্রয়োজন হবে তথ্য, মানসম্মত বিশ্লেষণ ও বিশ্বাসযোগ্যতা। সংবাদপত্রের সাতকাহন আজ যখন আলোচনায়, শীর্ষ দৈনিক যুগান্তর তখন তার প্রতিষ্ঠাকাল উদযাপন করছে। ফিরে ফিরে দেখছে তার পথচলার নানা চড়াই-উতরাই। এ পত্রিকার একজন নিয়মিত পাঠক হিসাবে হয়তো যুগান্তরের জন্য আমার মনেও কিছু আবেগ জমা হয়ে থাকবে, খানিকটা পক্ষপাতও কি না বলতে পারি না; তবে যা বলতে পারি, তা হলো-সমকালীন প্রবণতাকে পেছনে ঠেলেও কাগজটি প্রচারের আলোয় এখনো ভেসে আছে স্বমহিমায়। হয়তো তা কালের নিয়মেই এগিয়ে যাবে শক্ত পায়ে। যুগান্তরের ২৩ বছর পদাপর্ণে এমন শুভকামনাই থাকবে।
লেখক: সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ
archowdhury562@gmail.com