ডিপ ফেক হুমকি মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত
নাজমুল আহসান শেখ
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মিথ্যা, বিকৃত ছবি ও সংবাদ প্রচার নতুন কিছু নয়। এ ব্যাপারে সবচেয়ে কুখ্যাত ‘মারডক মিডিয়া’র ফক্স টিভি চ্যানেল এবং তাদের মালিকানাধীন বিভিন্ন মূলধারার টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র।
মিথ্যা সংবাদ তৈরি এবং পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন এবং সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে কুখ্যাতি অর্জন করেছে এ চরম ডানপন্থি ‘মারডক মিডিয়া’।
আমাদের দেশে ১৯৭৪ সালে রংপুরের বাসন্তী এবং দুর্গতিকে জাল পরিয়ে ছবি তুলে এবং সেই ছবি পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রচার করে সমগ্র জাতিকে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। ৭৫-পরবর্তী সময়ে গরুর গুঁতায় এক তরুণীর মৃত্যু হলে ডানপন্থি এক পত্রিকায় উসকানিমূলকভাবে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল-ভারতীয় ষাড়ের গুঁতায় বাংলাদেশি তরুণী নিহত!
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ফটোশপের মতো সহজলভ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন বিভ্রান্তি ছড়ানো নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশের মানুষ খুবই সংবেদনশীল ও আবেগপ্রবণ; বিশেষত ধর্মীয় ব্যাপারে।
যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর রায়ের পর ফটোশপের মাধ্যমে ‘চাঁদে সাঈদীর ছবি’ অপ্রচারের মধ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং দাঙ্গা সৃষ্টির ঘটনা মনে করিয়ে দেয় এ জাতিকে কত সহজে বিভ্রান্ত করা যায়। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর কুমিল্লায় দাঙ্গার সূত্রপাত এবং এ দাঙ্গাগুলোকে খুবই দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কয়েক বছর আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র-আন্দোলনকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে সমগ্র দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে বারবার প্রমাণ হয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা ও বিকৃত ছবি বা সংবাদ প্রচারের মধ্য দিয়ে দেশকে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করা কত সহজ।
সহজলভ্য প্রযুক্তির দ্বারা তৈরি এবং প্রচলিত মূলধারার সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমে ক্ষতিকর মিথ্যা এবং সত্যের বিকৃতি নতুন কিছু নয়। ‘ডিপ ফেক’ টেকনোলজি ক্ষতিকর মিথ্যা ও সত্যের বিকৃতির ক্ষেত্রে এক ভয়ংকর নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এ নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তি যা বলেনি অথবা করেনি, সহজেই সে ধরনের বিশ্বাসযোগ্য ভয়ংকর মিথ্যা অডিও এবং ভিডিও সংবাদ, তথ্য ও প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করা সম্ভব। ‘মেশিন লারনিং’ কৌশল এ প্রযুক্তিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে, যার ফলে ডিপ ফেকের জালিয়াতি ধরা অসম্ভব না হলেও খুবই কষ্টসাধ্য।
ডিপ ফেক টেকনোলজি সর্বপ্রথম ২০১৭ সালে প্রচারণা পায় আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে অত্যন্ত বাস্তব; কিন্তু প্রচণ্ড ভুয়া ছবি, অডিও, ভিডিও এবং অন্য ধরনের জালিয়াতির মধ্য দিয়ে। ভবিষ্যতে এ ডিপ ফেক এবং সিনথেটিক মিডিয়ার মাধ্যমে সমাজে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি খুবই সহজ হবে, যদি না কর্তৃপক্ষ সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে।
আমরা যদি ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার বিবেচনায় ফটোশপকে হাতবোমার সঙ্গে তুলনা করি, তবে ডিপ ফেককে ১০০০ কেজি বা তার চেয়েও বড় বোমার সঙ্গে তুলনা করতে হবে এবং এর ক্ষমতা সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তার কারণে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্বে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সিনথেটিক মিডিয়া-সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূলধারার মিডিয়ার (প্রিন্ট ও ডিজিটাল মিডিয়া) জনপ্রিয়তা হারানোর পাশাপাশি এসব মূলধারার মিডিয়ার বিশ্বাসযোগত্যাও তলানিতে ঠেকেছে। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষ, বিশেষত নতুন প্রজন্মের কাছে সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি বানোয়াট এবং বিকৃত খবর আর তথ্যচিত্রের সমন্বয়ে আরও এক নতুন ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তার সুযোগে এ ডিপ ফেক টেকনোলজি অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া এ মিডিয়াকে বলা হয়ে থাকে সিনথেটিক মিডিয়া। যতদিন যাচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল এবং বিকৃত তথ্যের পরিমাণ উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সোশ্যাল মিডিয়া এখন অনেকটা সিনথেটিক মিডিয়ায় পরিণত হয়েছে।
এ সিনথেটিক মিডিয়ার ব্যাপক প্রসার এবং প্রচার ক্ষমতার কারণে ডিপ ফেকের পরিধি এবং ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আরও পাবে তা বলাই বাহুল্য। এ সিনথেটিক মিডিয়া স্বভাবতই সম্পূর্ণ বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনের ক্যাপিটলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা এ ডিপ ফেকের মাধ্যমে তৈরি সিনথেটিক মিডিয়ার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার সবচেয়ে সফল ও জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। ট্রাম্প সমর্থকদের উসকানি প্রদানের মাধ্যমে হামলা সংঘটিত করার পেছনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল এ ডিপ ফেকের মাধ্যমে তৈরি সিনথেটিক মিডিয়ার।
অতীতের ক্ষতিকর এবং তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, ডিপ ফেকের মাধ্যমে তৈরি সিনথেটিক মিডিয়া আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের প্রতি মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে অচিরেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব আমাদের দরকার অত্যন্ত দক্ষ সাইবার নিরাপত্তা বাহিনী প্রস্তুত করা, যারা এ আসন্ন হুমকি মোকাবিলায় সক্ষম। এ সাইবার নিরাপত্তা প্রতিরক্ষা বাহিনী, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, পারমাণবিক এবং অনান্য বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিমান চলাচল, ব্যাংকিংসহ সব গুরুত্বপূর্ণ খাতের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যেন সক্ষমতা অর্জন করে।
এ সাইবার নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তোলার জন্য সর্বাগ্রে দরকার সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন, সেই নীতির বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ জনবল তৈরি এবং সেই জনবল কাজে লাগানোর জন্য কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান যুগে অপ্রাসঙ্গিক এবং অপ্রয়োজনীয় বিভাগে আসন সংখ্যা কমিয়ে যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন বিভাগে আসন সংখ্যা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আশা করি, দলাদলি এবং সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে এবং তাদের দেখাদেখি অন্যসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একই নীতি অনুসরণ করবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ১২টি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। ভবিষ্যতে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আমাদের দেশে দক্ষ সাইবার নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল সরবরাহ করবে বলে আশা করছি।
অধ্যাপক নাজমুল আহসান শেখ : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, ভূ-রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক
victory1971@gmail.com