বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেন
মো. আলিফ মিয়া
প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সম্প্রতি দেশে দুটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেছে। দুটি ঘটনারই চূড়ান্ত ভুক্তভোগী এ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরা। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ ক্রিয়াশীল নয়, শিক্ষকরাও নানা দল-উপদলে বিভক্ত এবং ছাত্রনেতারা দলীয় লেজুরবৃত্তিতে ব্যতিব্যস্ত, সেহেতু সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে কার্যত দাঁড়ানোর কেউ নেই। কেবল অনলাইন ও অফলাইনের প্ল্যাটফরমগুলোয় লেখালেখিই তাদের জন্য কথা বলার উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও অনেকে সেটিও করতে চান না।
১.
অসদাচরণের অভিযোগ তুলে গত ১৩ জানুয়ারি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট জাফরিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিসহ মোট তিনটি দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। নানা রকম তর্ক-বিতর্ক ও মিটিং-মিছিলের পর গত শনিবার বিকালে ছাত্র উপদেষ্টা ও প্রক্টরের উপস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন দ্বারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হন।
এরপর শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সংহতি জানান। ছাত্রলীগের হামলার পর ছাত্রীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন-দাবি না মানা পর্যন্ত ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন অব্যাহত থাকবে। সর্বশেষ উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদকে অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে পুলিশ ২৭টি রাবার বুলেট ও ২১টি সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে উপাচার্যকে মুক্ত করে তার বাসভবনে নিয়ে আসে। এ সময় অন্তত ৫০ শিক্ষার্থী আহত হন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
বলা বাহুল্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটি আন্দোলনই দাবিদাওয়া, আন্দোলন, ছাত্রলীগের হামলা, উপাচার্যের অপসারণের দাবি, পুলিশি নির্যাতন এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ-এ চক্রাকারে চলতে থাকে। জাবি, ঢাবি, চবি, রাবি ও ববির আন্দোলনগুলোয়ও এ বৃত্তটি পরিলক্ষিত হয়েছে।
কেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি? বর্তমান সময়ে শিক্ষকরা যতটা না শিক্ষক, তার চেয়ে বেশি প্রশাসক। একই যোগ্যতা সত্ত্বেও নির্বাহী বিভাগে চাকরি করে একজন প্রশাসক যে ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন, তা একজন শিক্ষক পারেন না। তবে এখনকার শিক্ষকদের সম্মানি যে কম, তা বলা যাবে না। কিছুকাল আগেও আমাদের প্রথিতযশা শিক্ষকরা কোনো প্রশাসনিক পদে যেতে চাইতেন না। তারা দেশের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলসভাবে গবেষণা ও জ্ঞান দান করে গেছেন।
এখনকার শিক্ষকরা যেহেতু কমিটমেন্ট থেকে শিক্ষকতায় আসেন না, বরং অন্য কোনো পেশায় সুযোগ না পেয়ে এ পেশায় জড়িত হন, তাই কতিপয় শিক্ষককে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স বা হীনম্মন্যতায় ভুগতে দেখা যায়। ফলে তাদের সীমিত ক্ষমতার বলির পাঁঠা হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এছাড়া শিক্ষকতা পেশার আদর্শিক ভিত্তিটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা এর প্রধান অন্তরায়।
শাবিপ্রবির উপাচার্য আগে দুটি ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। কর্তৃপক্ষ তাকে উপাচার্য পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকে তার সফলতা বা ব্যর্থতার বিষয়টি আমলে নিতে পারতেন। যিনি ব্যাংক ঠিকমতো পরিচালনায় ব্যর্থ হলেন, তাকে কীভাবে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হলো! দলীয় বিবেচনা, ঘুস-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ খবরের কাগজে উঠে আসে প্রতিনিয়ত।
উপরন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এখন জ্ঞানের তেমন চর্চা নেই বললেই চলে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো শিক্ষকদেরও সংগঠন করার অধিকার থাকতেই পারে। কিন্তু সেই সমিতির কার্যক্রম হওয়া উচিত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীবান্ধব। কিন্তু কোনো শিক্ষক সমিতি শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি, গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি, ছাত্রদের আবাসন সমস্যার সমাধান এবং শিক্ষার্থীদের কর্মবাজার উপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য কোনো আন্দোলন করেছেন বলে সাধারণত শোনা যায় না।
রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দুর্নীতির ভাগ-বাঁটোয়ারা এবং নিজেদের প্রভাববলয় তৈরিতেই শিক্ষকদের বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। সব শিক্ষকই যে এরকম করে থাকেন তা নয়। এখনো ভালো শিক্ষক আছেন। কিন্তু তাদের মাঝে ‘গ্রেসহাম বিধি’র কার্যকারিতা বিদ্যমান।
অর্থাৎ আমাদের দুর্নীতিপরায়ণ শিক্ষকরা ভালো শিক্ষকদের কোণঠাসা করে রাখেন। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনের যে স্পিরিট, তা হারিয়ে গেছে। রাষ্ট্র যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেবে, কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করবে, তখন দলীয় আনুগত্যের ব্যক্তি শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পাবেন, এটিই স্বাভাবিক।
সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা ছিল-শিক্ষকরা হবেন নিবেদিতপ্রাণ ও জাতির পথপ্রদর্শক। তারা জ্ঞান আহরণ, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং তা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আলোকিত মানুষ তৈরি করবেন। আমাদের সমাজের সর্বস্তরে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। শিক্ষকরা যেহেতু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নন, তাই এখানেও সেই অবক্ষয়ের প্রতিফলন ঘটেছে।
তবে যেহেতু সমাজে শিক্ষকদের আলাদা একটি অবস্থান রয়েছে এবং তারা সম্মানজনক দায়িত্ব পালন করেন, তাই তারা যদি কোনো অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে তাদের প্রতি সমাজের আস্থা ভূলুণ্ঠিত হয়। তাই সাধারণ মানুষের কথা ভেবেও অপকর্ম থেকে শিক্ষকদের দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়।
২.
গত ১২ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে কাওয়ালি গানের আসর বসিয়েছিল একদল শিক্ষার্থী। এ অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়ে মঞ্চ ও চেয়ার ভাঙচুর এবং আয়োজক ও শিল্পীদের মারধরের জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন আয়োজকরা। দেশে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি সীমাবদ্ধ। যদি মূলধারার দুয়েকটা দল অনুমতি পেয়েও যায়, সেখানে কীভাবে তা ভণ্ডুল করা যায় তার ছক কষা হয় সূক্ষ্মভাবে। হামলা-মামলা, আগের মামলা আবার জাগ্রত করা, গায়েবি মামলায় আসামি বানিয়ে গ্রেফতার-এগুলো ঘটে হরহামেশাই।
খোদ একটি রাজনৈতিক দল যেখানে অপর একটি দলের কার্যক্রম সহ্য করতে পারে না, সেখানে রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন অপরকে সহ্য করবে এটা ভাবা অবান্তর।
কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র অধিকার পরিষদের মতো একটি সংগঠনের সৃষ্টি, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে তাদের প্রভাব বিস্তার, ডাকসু নির্বাচনে তাদের সদর্প অংশগ্রহণ-এসব অবশ্যই ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে হুমকি। এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দল কখনোই চাইবে না আরেকটি ঝামেলা তৈরি হোক।
কাওয়ালি অনুষ্ঠানের হামলা বিতর্কে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন, কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন-যেহেতু বঙ্গবন্ধু এটি পছন্দ করতেন, সুতরাং এটির আয়োজন করা জায়েজ; আবার কেউ কেউ এটি ইসলামিস্টদের কাতারে ফেলতে চেয়েছেন ইত্যাদি। কিন্তু সবাই যে বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছেন তা হলো আধিপত্যের দ্বন্দ্ব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থী আসে বলে, মিডিয়ায় আলোড়ন বেশি হয় বলে, যে কোনো ঘটনা আলোচিত হয় বলে এখানে মতপ্রকাশ, সভা-সমাবেশ করা যায়। তবে হলফ করে বলতে পারি, ঢাকার বাইরে আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বা কোনো জেলা শহরে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের ছত্রছায়ার বাইরে গিয়ে যদি কেউ কোনো আয়োজন করতে চায়, তাহলেই সে আক্রমণের শিকার হবে। সেটি কাওয়ালিই হোক আর মাইজভাণ্ডারি, ভাটিয়ালি, ব্যান্ড দল বা অন্যকিছু। কাজেই ধর্মীয় মতভেদ বা উগ্র জাতীয়তাবাদের আলোচনা দূরে রেখে আসল ব্যাপারটিতে নজর দেওয়া জরুরি।
মো. আলিফ মিয়া : সেন্টার ফর গভার্ন্যান্স স্টাডিজের বাজেট বিভাগের নির্বাহী