Logo
Logo
×

বাতায়ন

গোবিন্দগঞ্জের সেই যুদ্ধের কাহিনি

Icon

একেএম শামসুদ্দিন

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গোবিন্দগঞ্জের সেই যুদ্ধের কাহিনি

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্ব। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হলে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি অভিযানে মার খেতে খেতে পাকিস্তানি হানাদাররা ইতোমধ্যেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।

বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক, ব্রিজ, কালবার্ট, রেললাইন, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংসের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে তাদের হেড কোয়ার্টার থেকে ফ্রন্ট লাইনে অবস্থানরত ব্যাটালিয়নগুলোতে যুদ্ধ সরঞ্জাম ও লজিস্টিক সরবরাহ ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে যৌথ বাহিনীর সর্বাত্মক অভিযানের অগ্রযাত্রা ভালোভাবেই শুরু হয়ে যায়।

যুদ্ধ শুরুর সম্ভাবনা ও বাংলাদেশকে পাকিস্তানের দখলমুক্ত ত্বরান্বিত করা হতে পারে আঁচ করে ইতঃপূর্বে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। প্রথমে একটি বিশেষ ইস্যু নিয়ে যৌথ কমান্ড গঠনে মতানৈক্যে পৌঁছতে কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে যৌথ কমান্ডের যুগ্ম সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ জেনারেলরা খুশি ছিলেন না।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জে এন দীক্ষিত তার ‘লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড : ইন্ডো-বাংলাদেশ রিলেশন্স’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও মনে করেন, সকলের কাছে প্রবাসী সরকারের বিশ্বাসযাগ্যতা ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা ও আনুগত্য বজায় রাখার জন্য জেনারেল ওসমানীসহ মুক্তিবাহিনীর শীর্ষ দলপতিদের যৌথ কমান্ডের উচ্চপদে রাখতে হবে।

জে এন দীক্ষিত লিখেছেন, ‘ভারতীয় বাহিনী প্রত্যক্ষ অভিযানে অংশ নিলে একটি সমন্বিত কেন্দ্রীয় চেইন অব কমান্ড গঠনের প্রয়োজন আছে ঠিকই; কিন্তু তাই বলে একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা যিনি পদবিতেও ছিলেন অনেকের নিচে এমন একজনকে যৌথ কমান্ডের যুগ্ম সর্বাধিনায়ক করা অনেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনের যুক্তি মেনে নিয়ে সেরকম একটি বন্দোবস্ত করতে ডিপি ধরের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিনিয়র জেনারেলদের রাজি করান।

জে এন দীক্ষিত আরও লিখেছেন, ‘যৌথ কমান্ড গঠনের উদ্দেশে দিল্লি থেকে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা কলকাতায় এসে ভারত সরকারের পক্ষে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে মতৈক্যে পৌঁছান। এ আলোচনা হয় ২৮ থেকে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে। ঠিক হয় জেনারেল ওসমানী ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডিং ইন চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সমান্তরালে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন।’

জে এন দীক্ষিত উল্লেখ করেন, ‘ভারত আগে থেকে ধরেই নিয়েছিল যে একবার যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে তারাই হবে এ যুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি। অর্থাৎ যুদ্ধ শুরু হলে এর নেতৃত্ব দিল্লি ও কলকাতার সামরিক সদর দপ্তরের হাতেই থাকবে। যৌথ কমান্ড গঠন করা হয়েছে কেবল বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও অস্তিত্বের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য।’ আলোচনায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, যৌথ অভিযান শুরু হলে ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতিও দেবে। অতঃপর ১ থেকে ৩ ডিসেম্বরের মধ্য যৌথ কমান্ড গঠনের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, মূল চালিকাশক্তি কিংবা যুদ্ধের নেতৃত্ব যাদের হাতেই থাকুক না কেন, মুক্তিবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া যৌথ বাহিনীর পক্ষে এত দ্রুত ঢাকা পৌঁছানো সম্ভব হতো না। বক্সিং প্রতিযোগিতায় যেমন ছোট ছোট আঘাতে প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়ে পড়ে, শরীরে তখন প্রতিরোধ শক্তি তেমন থাকে না, এমন দুর্বল মুহূর্তে যদি সুযোগসন্ধানী কোনো শক্ত পাঞ্চ করা যায়, তাহলে প্রতিপক্ষ ধরাশায়ী হতে বাধ্য।

২৫ মার্চের পর পুরোটা সময় ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খেতে খেতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অবস্থাও তাই হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে এসে শক্ত সেই পাঞ্চটি মেরেছিল মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী। ফলে পাকিস্তান হানাদাররা এত সহজেই হার মেনে নিতে বাধ্য হয়। যৌথ অভিযানে মুক্তিবাহিনী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করেছিল তা হলো ভারতীয় সামরিক কলামগুলোকে সঠিকভাবে পথ দেখিয়ে শত্রুর অবস্থানের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

হানাদার বাহিনীর জনবল ও অস্ত্রবল, ভারি অস্ত্রের অবস্থান, শত্রুর শক্ত ও দুর্বল দিক এবং প্রতিরক্ষা অবস্থানের বিন্যাস, শত্রুর সদস্যদের মনোবল ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে ভারতীয় বাহিনীকে সরবরাহের কাজটিও করে দিয়েছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা; যা ভারতীয় জেনারেলদের রণকৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। ফলে একের পর এক সামরিক অভিযানে সাফল্য এসেছে।

এ কথা সত্য, মুক্তিবাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে মাত্র ১৩ দিনেই ঢাকা পৌঁছান সম্ভব হতো না। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, দেশে ও বিদেশে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর চূড়ান্ত অভিযানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে যত আলোচনা হয়, সেসব আলোচনায় মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা তেমন গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয় না।

৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যেভাবে সহযোগিতা করেছে তা একটি ঘটনার বর্ণনার মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি। দিনটি ছিল ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। উত্তর-পশ্চিম সেক্টরে ভারতের ৩৩ কোরের অধীন ২০ মাউন্টেইন ডিভিশনের ৩৪০ মাউন্টেইন ব্রিগেড বগুড়া অভিমুখে অগ্রাভিযান করে গোবিন্দগঞ্জের করতোয়া নদীর উত্তর পাড়ে এসে পৌঁছে।

পাকিস্তানের ৩২ বেলুচ ও ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট অর্থাৎ পাকিস্তানের একটি ব্রিগেড তখন করতোয়া নদীর দক্ষিণে নদীকে সামনে রেখে বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে প্রতিরক্ষায় অবস্থান নিয়ে বসে আছে। নদীর এপার থেকে শত্রুর বাঙ্কারগুলো দেখা যাচ্ছিল। নদীর ওপর একটি বড় ব্র্রিজ যেটা কাটাখালী ব্রিজ নামে পরিচিত। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্রিজটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, ব্রিজটি দখল করতে পারলে সব অ্যালিমেন্টসসহ ২০ মাউন্টেইন ডিভিশন নির্বিঘ্নে বগুড়ার মহাস্থান গড় পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারবে।

কিন্তু ব্রিজ অতিক্রম করা এত সহজ ছিল না। ব্রিজটি পাকিস্তানিদের রিজার্ভ ডেমিলেশনে রাখা ছিল অর্থাৎ যে কোনো সময় তারা ব্রিজটিকে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারে। তা ছাড়া আর্টিলারি টার্গেট হিসাবেও রেজিস্টার্ড করা ছিল ব্রিজটি। সর্বক্ষণিক পাহারা তো ছিলই। ৩৪০ মাউন্টেইন ব্রিগেড ব্রিজের হাজার গজের মধ্যে পৌঁছানো মাত্র প্রচণ্ড শব্দে শত্রুর আর্টিলারি গোলা তাদের আশপাশে এসে পড়তে লাগল।

আর্টিলারি শেলিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর অবস্থান থেকে ভারি মেশিনগানগুলোও গুলিবর্ষণ শুরু করে। গোলাবর্ষণের পরিমাণ এত ঘন ছিল যে কেউ মাথা উঁচু করে সামনে কী হচ্ছে তা দেখার সুযোগ পাচ্ছিল না। এরই মধ্যে শত্রুর একটি গোলা ৩৪০ মাউন্টেইন ব্রিগেডের সঙ্গে সংযুক্ত ৬৩ ক্যাভালরির একটি পিটি-৫৫ ট্যাংকের ওপর পড়ে তা ধ্বংস করে দেয়। শত্রুর এমন আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিল এটা শত্রুর একটি শক্ত ঘাঁটি। এমন পরিস্থিতিতে ২০ মাউন্টেইন ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং জেনারেল লচমন সিং শত্রুর ওপর সম্মুখ থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়ে বিকল্প পরিকল্পনার কথা চিন্তা করতে থাকেন।

এমতাবস্থায় মাউন্টেইন ডিভিশনের সঙ্গে সংযুক্ত মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার হামিদুল হোসেন তারেক তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্ব শুরুর প্রথম থেকেই তারেক ও তার দল ৬ গার্ড ব্যাটালিয়নের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন এবং তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে যুদ্ধ করে রংপুরের পীরগঞ্জ, পলাশবাড়ী ও গাইবান্ধা এলাকা শত্রুমুক্ত করেন।

জেনারেল লচমন সিং তার লেখা ‘ইন্ডিয়ান সর্ড স্ট্রাইকস ইন ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ের ১২৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘যুদ্ধের শুরুতেই আমি আমার অধীন প্রতিটি ব্রিগেডকে একশ’র ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের সংযুক্ত করে দিয়েছি যেন তারা আমাদের সঠিকভাবে গাইড করে, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সমন্বয় করে এবং শত্রু সম্পর্কে সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমাদের অপারেশন প্ল্যান আপডেট করতে সাহায্য করতে পারে।’ উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর হামিদুল হোসেন তারেককে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বীর বিক্রম উপাধি দেওয়া হয় এবং তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে মেজর হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন।

ওদিকে শত্রুর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে ব্রিজ দখল করা অসম্ভব হয়ে পড়ে! এমতাবস্থায় ৬ গার্ড রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল দত্ত তারেককে বললেন, ‘শত্রুর পজিশন বাইপাস করে দূরে কোথাও ক্রসিং সাইট আছে কিনা এবং সেদিক দিয়ে আমরা ক্রস করে শত্রুর পিছনে উপস্থিত হতে পারব কিনা এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তারেক সঙ্গে সঙ্গেই কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে চলে যান এবং গ্রামবাসীর সাহায্যে বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেন যা এ অপারেশনের সাফল্যের পেছনে সাহায্য করেছিল। তিনি সন্ধান পান সেখান থেকে ৮ কিলোমিটার পূর্বে কাজলা গ্রামের পাশে একটি ফেরিঘাট আছে। এ ফেরিঘাট দিয়েই অনায়াসে নদী পার হয়ে শত্রুর অবস্থানের পেছনে যাওয়া যাবে।

তারেক গ্রামের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে অতি সতর্কতার সঙ্গে ফেরিঘাট এলাকা ভালোভাবে দেখে কোন জায়গা দিয়ে যৌথ বাহিনীর ট্যাংকসহ ভারি ইকুইপমেন্ট পার হতে পারবে তা রেকি করেন। রেকি শেষে তিনি ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট করেন। তারেকের রিপোর্ট পাওয়ার পর যৌথ বাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনাই সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। সিদ্ধান্ত হয়, ৬ গার্ড রেজিমেন্ট নদীর এপারে থেকে গোলাবর্ষণের মাধ্যমে শত্রুকে ব্যস্ত রাখবে আর অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা গাইড করে যৌথ বাহিনীর মূল দলকে কাজলা ফেরিঘাটে নিয়ে যাবে এবং নদী পার হয়ে শত্রুকে পেছন দিক দিয়ে আক্রমণ করবে।

৬৯ আর্মার্ড রেজিমেন্ট ও ৫/১১ গুর্খা রেজিমেন্ট সমন্বয়ে একটি ব্রিগেড গ্রুপ ১১ ডিসেম্বর অপরাহ্নের মধ্যে নির্বিঘ্নে নদী পার হয়ে শত্রুর পেছনে অবস্থান নেয়। তারেক ও তার দলও পিটি ৭৬ ট্যাংকে (উভচর ট্যাংক) চড়ে নদী পার হয়ে যান। যৌথ বাহিনীর ফলোআপ দলগুলোও নদী পার হয়ে শত্রুর পেছনে অবস্থান নেয়। বিকাল ৫টা নাগাদ যৌথ বাহিনী শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ; উভয় পক্ষের ট্যাংকের গোলার শব্দ, আর্টিলারি শেলিং, ভারি মেশিনগান, রিকোয়েলেছ রাইফেল, রকেট প্রপেলেন্টের ভারি শব্দে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবেশ ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। নদীর উত্তর দিক থেকে ৬ গার্ড রেজিমেন্টও শত্রুর ওপর প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। সামনে ও পেছনের দুমুখো আক্রমণে শত্রুপক্ষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। যৌথ বাহিনী যাতে ব্রিজ দখল করে সম্মুখ দিয়ে তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে চলে আসতে না পারে এজন্য বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্রিজটি ধ্বংস করে দেয়।

তার পরও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। উভয়মুখী আক্রমণে শেষ রাত পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলেও ১২ ডিসেম্বর খুব ভোরে পাকিস্তানিরা তাদের তিনটি ট্যাংক, ৫৫টি গাড়ি, বিপুল পরিমাণ ভারি অস্ত্রশস্ত্রসহ যুদ্ধ সরঞ্জাম ফেলে যে যেভাবে পারে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যায়। কয়েকজন অফিসার ও বেশ কিছুসংখ্যক সৈনিক অবশ্য আত্মসমর্পণ করে।

এভাবেই মুক্তিবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেদিন গোবিন্দগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়েছিল। এটা যৌথ বাহিনীর বগুড়া দখলের পথকে সহজতর করে দিয়েছিল।

গোবিন্দগঞ্জ যুদ্ধের সাফল্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে জেনারেল লচমন সিং তার ‘ইন্ডিয়ান সর্ড স্ট্রাইকস ইন ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ের ১২৫ ও ১২৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মুক্তিবাহিনী ক্রস সাইট সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিল বলেই আমরা সহজে শত্রুকে পরাস্ত করতে পেরেছিলাম। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। বিশেষ করে এ অভিযানে। যে মুক্তিযোদ্ধারা দক্ষতার সঙ্গে আমাদের গাইড করেছে তাদের ক্রস সাইট ও গোবিন্দগঞ্জে যাওয়ার পথ সম্পর্কে বেশ ভালো জ্ঞান ছিল। এ জন্য নদী পার হতে শত্রু মোকাবিলা করতে হয়নি এবং পথে কোনো দুর্ঘটনাও ঘটেনি।’

জেনারেল লচমন সিং-এর মন্তব্য থেকে সহজেই বলা যায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যারাই ‘ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ’ বলে প্রচার করার চেষ্টা করুক না কেন, এ যুদ্ধে পাকিস্তানকে এত সহজে পরাস্ত করা সম্ভব হতো না যদি আমাদের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ না থাকত।

বিজয়ের এ মাসে তাদের এই অবদানকে আমাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে। যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে এ দেশের জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন; সবকিছুর ঊর্ধ্ব থেকে আমরা যদি প্রকৃত অর্থেই তাদের সেই উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারি, তাহলেই মৃত্যুঞ্জয়ী সেসব মুক্তিযোদ্ধার প্রতি আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা জানান হবে।

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম