বিভ্রান্ত তরুণ, দলকানা নেতাকর্মী
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২১, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের দেশের রাজনীতি পথ হারিয়েছে অনেক আগেই। সুস্থ চিন্তার মেধাবী ছাত্র, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ মানসিকভাবে না হলেও বাহ্যিকভাবে রাজনীতিবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। রাজনীতির প্রতি একটি বিকর্ষণ তৈরি হচ্ছে।
এ ধারার মানুষ বিশ্বাস করেন, দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলে কারও আর ব্যক্তিগত বিবেক কাজ করে না। দলসংশ্লিষ্ট মানুষ নিজ দলের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন এটিই স্বাভাবিক, কিন্তু নিজের বিবেক ও মুক্তচিন্তার ক্ষমতা বিকিয়ে দেওয়াটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্যের বিষয়। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তরুণ নিরপেক্ষভাবে ছাত্র কল্যাণে এগিয়ে আসে না এখন।
নিজ দলের নেতাদের নির্দেশ পালনেই ব্যস্ত থাকে তারা। বিরুদ্ধ মতের সতীর্থ বন্ধুদের মাথা ফাটাতেও দ্বিধা করে না। কোনো আদর্শ নয়, অর্থপ্রাপ্তি আর দাপট দেখিয়ে চলা এবং রাজনৈতিক গুরুদের অন্যায় আদেশ পালন করা এদের লক্ষ্য। সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক সব পেশার রাজনৈতিক দলে নাম লেখানো মানুষ বিবেক আর যুক্তিবুদ্ধি খুইয়ে ফেলেন শুরুতেই। যার যার দলের নেতানেত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এ একটি জায়গায় শিক্ষিত আর স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মধ্যে কোনো ফারাক নেই।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্য, রাজনীতির ছত্রছায়ায় বন্দি তরুণরা ছাত্রস্বার্থের আন্দোলনেও একত্রিত হতে পারে না। বরঞ্চ দলীয় নেতাদের কৃপাভাজন হওয়ার জন্য বন্ধুদের ওপর হামলে পড়ে। না হলে ২০১৮ সালে বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শিক্ষার্থী মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা যখন রাজধানীতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তখন এ আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য ছাত্রলীগকেই লেলিয়ে দেওয়া হয় কোমলমতি সতীর্থ শিক্ষার্থীদের ‘দমন’ করার জন্য। ছাত্রলীগের হামলায় আহত হতে হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যায় জড়িত থাকার জন্য সতীর্থ ছাত্র বন্ধুদের অভিযুক্ত করা হয়।
নষ্ট রাজনীতিতে জড়িয়ে বিবেক কতটা নষ্ট হয়ে যায়, বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে পড়া মেধাবী ছাত্রদের মন থেকে মানবতা ও মনুষ্যত্ব হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা তার উদাহরণ। তারা সতীর্থ ছাত্রদের পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া মেধাবী হবু ডাক্তাররা ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হয়ে অবলীলায় স্থানীয় নেতাদের তাঁবেদার হয়ে যেতে পারে। দলীয় কোন্দলের পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে ক্যাম্পাসে রক্ত ঝরায়। এ বিবেকহীন রাজনীতিসংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে ডাক্তার হবে কোন শপথ নিয়ে!
২০১৮-র লজ্জা আবার ফিরে এলো ২০২১-এর শেষ পর্বে এসে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা পথে নেমেছিল হাফ বাস ভাড়ার দাবিতে। ছাত্রদের এ দাবির যৌক্তিকতা ছিল। অন্তত ছাত্র অধিকারের এ আন্দোলনে দলমত নির্বিশেষে সমগ্র ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণ করার কথা। সেখানেও একইভাবে দলছুট হয়ে গেল ছাত্রলীগ। অভিযোগ রয়েছে, আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসার বদলে তারা লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করেছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর। অথচ কী দুর্ভাগ্য আমাদের, এ সময়ে নষ্ট রাজনীতির পাকে পড়ে ছাত্রলীগের ছেলেরা হয়তো খবরও রাখে না, তাদের পূর্বসূরি ছাত্ররা ১৯৬৯ সালে যে ঐতিহাসিক ১১ দফা উত্থাপন করেছিলেন, তার ভেতর ছাত্রদের জন্য বাস ভাড়া অর্ধেক করার দাবি ছিল। নেতাদের লাঠিয়াল হতে গিয়ে নিজেদের বিবেক বিসর্জন দিয়ে মূল ধারার ছাত্রসমাজ থেকে এরা আলাদা হয়ে গেছে। ছাত্রকল্যাণে নিজেদের যুক্ত না রেখে সতীর্থদের পীড়নে এরা যুক্ত করছে নিজেদের। এখনকার ছাত্রলীগের গাইড ফিলোসফার যারা, তাদের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা উচিত। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, রাজধানীতে আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠি নিয়ে যারা চড়াও হয়েছিল তারা ছাত্রলীগের ছেলে নয়। তাহলে আমাদের সতর্ক হতে হবে-জানতে হবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হওয়া এ তরুণ কারা! কী তাদের উদ্দেশ্য? পত্রপত্রিকায় অনেকেরই মুখচ্ছবি স্পষ্ট। যদিও কেউ কেউ শনাক্ত করেছেন এদের, তবু পুলিশের উচিত সত্য উন্মোচন করে আওয়ামী লীগ নেতার দাবিকে সঠিক বলে নিশ্চিত করা।
সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগ কিছুটা জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেদের যুক্ত করেছে, সেটি আশার কথা। কৃষকের ধান কাটাসহ দুর্যোগে এগিয়ে আসার মতো কোনো কোনো ভালো ঘটনা আমরা দেখেছি। তবে পেশিশক্তি প্রদর্শনের পরিবর্তে ছাত্রলীগকে যদি সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনা যায়, তবে এর চেয়ে ভালো কিছু হবে না।
সমস্যা হলো, ছাত্র রাজনীতির সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতারা বর্তমান ধারার ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের দাবি মন থেকে মানবেন না। তারা সব জেনেও জ্ঞানপাপীর মতো এ ধারার ছাত্র রাজনীতির পক্ষে সাফাই গাইতে থাকবেন। ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবুও বাম দলের নেতারা চাইবেন না এজন্য যে, জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে তাদের যে ক্ষয়িষ্ণু দশা, তাতে প্রাণশক্তি জানান দেওয়ার জন্য বাম মনোভাবাপন্ন ছাত্র রাজনীতির হাতিয়ার দরকার। আর সরকারি দল তো সব পর্বেই সংকটে ছাত্র লাঠিয়ালই ব্যবহার করবে। তাই সব জেনেও না জানার ভান করেন তারা। বিএনপি, জাতীয় পার্টি আর আওয়ামী লীগের সব পর্বেই একই ছক। দলীয় ছাত্র রাজনীতির পক্ষের কেউ কেউ এখন এ যুক্তিও তুলছেন- দলীয় ছাত্র রাজনীতি না থাকলে, চ্যালেঞ্জ থাকবে না বলে অন্ধকারে থাকা ধর্মীয় মৌলবাদী দলগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তার অর্থ এসব মৌলবাদী শক্তিকে দেশ ছাড়া করবে মারকুটে ছাত্ররা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি আগেই আত্মসমর্পণ করে রেখেছে? দলীয় বৃত্তের বাইরে থাকা ছাত্র সংগঠন কি প্রয়োজনে ভূমিকা রাখতে পারবে না?
অনেকদিন আওয়ামী লীগ শাসনক্ষমতায় আছে। তাই ছাত্রলীগ দাপটের সঙ্গেই আছে শিক্ষাঙ্গনে। ক্যাম্পাসে বিরোধীদলীয় ছাত্রসংগঠন সক্রিয় না থাকায় বা না থাকতে পারায় তারা নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দলে প্রায়ই লিপ্ত থেকেছে। যখন ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনের ছেলেমেয়েরা নাটক করছে, আবৃত্তি করছে, সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করছে, বিতর্ক অনুষ্ঠানে নিজেদের যুক্ত রাখছে, মেধাচর্চা করে ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করছে, তখন ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতাকর্মীরা কোনো গঠনমূলক কাজে যুক্ত না থাকায় নিজেদের মধ্যে হল দখলের ঝগড়া, টেন্ডার আর কমিশনবাজির ভাগবাটোয়ারার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছে। হলে হলে গেস্টরুমে টর্চার সেল বানাচ্ছে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীর মনে ভীতি ছড়াচ্ছে। সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন চিত্র থাকার পরও তাদের নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় নেতারা কিছুই জানেন না, এটি মেনে নেওয়া সাধারণ মানুষের জন্য খুব কষ্টের হবে।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সংগ্রামী ঐতিহ্যের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার কৃতিত্ব রয়েছে, সর্বোপরি দলনেত্রী শেখ হাসিনার মতো দূরদর্শী দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দেশপ্রেমিক নেত্রী রয়েছেন। অতি আওয়ামী লীগার এবং জি হুজুর মার্কারা সাধারণত সুপথ দেখাতে পারে না। জটিল করে তোলে নীতিনির্ধারণের জায়গাটি। এ ভাবনা আমাকে শঙ্কিত করছে দীর্ঘদিন থেকে। অতি সম্প্রতি একটি অভিজ্ঞতা আমার ভাবনাটিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ অধ্যাপক দুঃখ করে বলছিলেন, দেখুন মুক্তিযুদ্ধের গৌরব বুকে ধারণ করে বেড়ে উঠেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি টানেনি বলে নির্লিপ্ত থেকেছি। এরপরও স্বার্থের টান পড়ায় আমাকেও জামায়াত সমর্থক বানানোর চেষ্টা চলছে।
আমার অভিজ্ঞতায় একই ঘটনা ঘটেছিল মাস কয়েক আগে। একটি টিভি চ্যানেলে টকশোতে অংশ নেওয়ার জন্য গিয়েছি। একটু আগেই পৌঁছেছিলাম। খানিক পরে এলেন বন্ধুপ্রতিম একজন সিনিয়র সাংবাদিক। কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তিনি আপা সম্বোধন করেন। কথা বলতে গিয়ে একজন বিশিষ্ট লেখক ও শ্রদ্ধেয় প্রবীণ অধ্যাপককে জামায়াত মানসিকতার বলে মন্তব্য করলেন। এ ধরনের মন্তব্য শোনার পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না বলে চমকে উঠলাম। আমি এ শ্রদ্ধেয় অধ্যাপককে কাছে থেকে জানি। আমার মনে হয় দেশবাসীর মনেও অস্পষ্টতা নেই। ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর স্থানীয় তরুণদের সংগঠিত করতে তার পরিবারের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এ অপরাধে জামায়াত ও বিহারিদের প্ররোচনায় তাদের বিশাল বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল পাক বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গ্রামে তাদের পরিবার মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সময়ে খাবার সরবরাহ করত। এ দেশপ্রেমিক অধ্যাপক কারও কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য মোসাহেবি করেননি কখনো। আমি সাংবাদিক বন্ধুকে বললাম, একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে আমি এত তথ্য ঘাটতি আশা করিনি। বললাম, লেখালেখিতে আপনি কী অবদান রেখেছেন জানি না, তবে এ অধ্যাপকের অবদান আমার জানা। তিনি নীরবে কাজ করে যেতে পছন্দ করেন। তার রচিত আঞ্চলিক মুক্তিযুদ্ধের একটি গ্রন্থ সরকারি প্রজেক্টে বহু কপি দেশের নানা স্কুলে বিতরণ করা হয়েছে। তার রচিত বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ বাজারে রয়েছে। ছোটদের জন্যও বঙ্গবন্ধুর জীবনী লিখেছেন তিনি। ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ রচনা করেছেন এ গবেষক অধ্যাপক। আর এমন একজন দেশপ্রেমিক মানুষকে মুহূর্তে জামায়াত মনোভাবাপন্ন মানুষ বানিয়ে ফেললেন আপনি! হয়তো এরই মধ্যে তার চরিত্র হননের চেষ্টাও করেছেন নানা জায়গায়!
আমি এ ঘটনা থেকে প্রবোধ খোঁজার চেষ্টা করলাম। বড়রাই যেখানে মুক্তচিন্তায় মুক্তবিবেক নিয়ে কথা বলতে পারেন না, তরুণরা সেখানে কীভাবে মুক্তচিন্তা করবে? সব ধরনের বিভ্রান্তি থেকে তরুণদের বেরিয়ে আসতে হবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com