
প্রিন্ট: ০২ এপ্রিল ২০২৫, ০১:০০ এএম
একটি কার্যকর ও অর্থবহ জেলা পরিষদের প্রত্যাশায়

ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কার্যকর স্থানীয় সরকার এবং সে সরকারের ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারা প্রতিনিধিরাই মূলত বিকেন্দ্রীকরণের ভিত্তি। উন্নয়নের সাম্য, সর্বজনের সাফল্য এবং সেই সঙ্গে স্থানীয় জনগণের দক্ষতা নির্ভর করে এর ওপর। কার্যকর স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকদের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতির বাস্তবায়ন করতে পারে।
এর ফলে সরকারি পরিষেবার মান যেমন উন্নত হয়, তেমনি স্থানীয় উন্নয়নের সুফলও প্রচার পায়। জেলা পরিষদ (ডিসট্রিক্ট কাউন্সিল/ জেলা পরিষদ, গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর) বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার প্রাচীনতম স্তর। নাগরিকদের মানসম্মত সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এর উন্নতির অনেক সুযোগ আছে, যেহেতু এখানে আগে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল না।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২০১৭ সালে জেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পুনরায় জনগণের সেবাদানের সুযোগ লাভ করেন। জেলা পরিষদ আইন-২০০০ জেলা পরিষদকে তার আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করে বার্ষিক ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে উন্নয়নকাজ পরিচালনার ক্ষমতা দিয়েছে। বিকেন্দ্রীকরণ মানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি এবং এ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসন অফিসের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব কার্যকর স্থানীয় সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। কার্যকর সমন্বয়ের প্রধান অন্তরায় ফ্রন্টলাইন সার্ভিস ডেলিভারি ইউনিটের মধ্যকার দূরত্ব, যার মাধ্যমে নাগরিকদের কাছে সরকারি পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া হয়। কারণ, যেসব কর্মকর্তা স্থানীয় পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন, তারা প্রায়ই জাতীয় সরকারে বসে থাকেন। অতএব, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতারও বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন এবং এর মাধ্যমে সমন্বয়ের ব্যর্থতা হ্রাস ও স্থানীয় পরিষেবার উন্নতি করা সম্ভব।
বর্তমান স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ স্থানীয় নাগরিকদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বল জবাবদিহিতা। একটি বিষয়ে এখন সবাই একমত যে, উন্নয়ন কর্মসূচিকে আরও দরিদ্রবান্ধব করে তুলতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ আরও প্রসারিত করতে এবং প্রয়োজনমাফিক সম্পদ কাজে লাগানোর লক্ষ্যে সময়োপযোগী ও কার্যকর স্থানীয় সরকারব্যবস্থা অত্যাবশ্যক।
বহুবিধ সুফল লাভের পাশাপাশি এর ফলে প্রতিষ্ঠানাদির বরাদ্দবিষয়ক দক্ষতাও বাড়ানো যায়। উদাহরণস্বরূপ, জেলা পরিষদের স্থায়ী কমিটিগুলো সচল নয়। আরও স্পষ্ট করে বললে, স্থায়ী কমিটিগুলোর ৯০ শতাংশই সক্রিয় বা সচল নয়। কারণ, নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য সদস্য এগুলোর কার্যকারিতা ও এখতিয়ার সম্পর্কে সঠিকভাবে সচেতন ও আগ্রহী নন।
জেলা পরিষদকে প্রকৃত অর্থে কার্যকর করার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা যায়। এর অন্যতম হলো, স্থানীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে চিহ্নিত করা এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের যুক্ত করা। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা। ডেডলাইন অনুযায়ী ডিডি-এলজি এবং এলজিডি বরাবর বার্ষিক পরিকল্পনা জমা দেওয়া এবং বার্ষিক পরিকল্পনায় স্থায়ী কমিটির পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত করা।
একই সঙ্গে স্থায়ী কমিটিগুলোর সদস্যদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টির পূর্বশর্ত। কারণ, নাগরিক পরিষেবায় সহযোগিতা ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মীমাংসায় পৌঁছতে এ কমিটিগুলোর সভা ফোরামের মতো ভূমিকা রাখে।
এছাড়া প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করে প্রাথমিক বেসলাইন মূল্যায়ন পরিচালনা করা দরকার। এ কাজে জ্ঞান ও দক্ষতার ইতিবাচক রূপান্তরের লক্ষ্যে এনআইএলজির মতো প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের সীমানা মূল্যায়ন এবং সেই সীমা পেরিয়ে যাওয়া দরকার, যা সেক্টরভিত্তিক, স্থানীয় সরকার ও কমিউনিটিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে পৃথক করে। প্রয়োজন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও পল্লি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
অ্যাকাউন্টিং সিস্টেমকে কম্পিউটারাইজ করা, ট্যাক্স রেকর্ডকে কম্পিউটারাইজ করা এবং কম্পিউটার দ্বারা বিল তৈরি করা, আর্থিক বিবৃতি প্রস্তুত করা এবং অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে জেলা পরিষদের (অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা) স্থায়ী অডিট কমিটি দ্বারা নিরীক্ষা করা প্রয়োজন।
একটি কর্মক্ষমতা ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ, যেমন: অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বাজেট পাওয়ার শর্ত হিসাবে শাসনকাজে সংস্কারকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। জেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে নাগরিক সনদ প্রস্তুত ও উপস্থাপন, জেলা পরিষদের ওয়েবসাইট তৈরি ও হালনাগাদ রাখা, নাগরিক সনদ প্রচার করা এবং সব উন্নয়ন ও আর্থিক নথি প্রকাশ করা; বিভিন্ন জনগুরুত্ববহ ইস্যুতে নিয়মিত গণশুনানি করা, স্থানীয় সম্প্রদায়, সিবিও ও এনজিওগুলোকে জেলা পরিষদের সভায় আমন্ত্রণ জানানো প্রয়োজন। এবং একইভাবে আবশ্যক পর্যায়ক্রমিকভাবে উপজেলা পরিষদের সামাজিক নিরীক্ষা পরিচালনা এবং উন্নয়ন প্রকল্পের পরিবেশগত ও সামাজিক মূল্যায়নে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে এর বিদ্যমান নীতিমালার ক্ষেত্রে সম্মতিসুলভ বোঝাপড়া দরকার, যাতে এ নীতিমালা নাগরিকদের পছন্দসই পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সরকারকে কর্তব্যপরায়ণ থাকতে উৎসাহিত করে। উপরন্তু, সরকারকে সাবধানতার সঙ্গে তার আর্থিক সংস্থান পরিচালনা করা উচিত। কম অর্থ ব্যয়ে বেশি কর্মদক্ষতা এবং সেই সঙ্গে স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঝুঁকিগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নাগরিকদের আস্থা অর্জন করা উচিত।
জনসেবার পরিমাণগত ও গুণগত উন্নতির পাশাপাশি সাধারণ মানুষ যাতে কোনো বিড়ম্বনা ছাড়াই সেসব সেবা-সুবিধা গ্রহণ করতে পারে সে ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নির্বাচনি সংস্কারের মধ্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় সরকারে সিটিজেন চার্টার/নাগরিক সনদ ও সরকারি কর্মচারীদের প্রত্যাহারের (রিকল) ব্যবস্থার মতো আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক চাহিদা পূরণের জন্য এডিপি থেকে একটি বড় বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে, যা তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে এবং তৃণমূলের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের দেওয়া সম্মানি বৃদ্ধি করা উচিত এবং এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা উচিত, যা সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচনের সুযোগ দেয়। অন্যদিকে জেলা পরিষদের অচল স্থায়ী কমিটিগুলোকে পাবলিক এজেন্সি এবং সিভিল সোসাইটি সংস্থার যৌথ পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে সক্রিয় করা যেতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে যে জনসাধারণের যথাযথ উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব, এ ব্যাপারে সব পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনসাধারণের অংশগ্রহণ রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারেনি। বেশির ভাগ দরিদ্র ও নিরক্ষর, বিশেষ করে তৃণমূলের মানুষ তাদের যে কোনো সমস্যায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, যারা তাদের চাহিদা ও অনুভূতি সম্পর্কে সবচেয়ে সচেতন। এবং এ কারণে জনসাধারণ তাদেরকে স্থানীয় অভিভাবক মনে করে।
ঐতিহ্যগতভাবে স্থানীয় পর্যায়ে এ ধরনের বাস্তবতা বিদ্যমান সত্ত্বেও জনসাধারণ ও জনপ্রতিনিধিদের পরস্পরের সহযোগী হিসাবে প্রস্তুত করার কোনো প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি। যদিও জনগণের স্বার্থে গ্রহণ করা সিদ্ধান্তে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ রাষ্ট্রের সব স্তরে জনস্বার্থের রাজনীতি বিকাশের পূর্বশর্ত, যা গণতন্ত্রের শিকড়কে শক্তিশালী করবে।
রাষ্ট্রের সবচেয়ে মৌলিক স্তরে গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দল এবং স্থানীয় জনসাধারণসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারের উচিত হবে এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করা। বিদ্যমান মূলধারার গ্রামীণ উন্নয়ন পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এজন্য প্রয়োজন স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন। ওপর থেকে নিচে উন্নয়ন আরোপ করা থেকে সরে গিয়ে স্থানীয় উন্নয়নকে স্থানীয় চাহিদা ও চরিত্রমুখী করে তুলতে হবে।
ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম : ভিজিটিং স্কলার, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়; সহযোগী অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
mti21@cam.ac.uk