সবল শিক্ষা-ঐতিহ্যের দেশে বিভ্রান্ত আমরা
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![সবল শিক্ষা-ঐতিহ্যের দেশে বিভ্রান্ত আমরা](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2021/09/30/image-470621-1632949956.jpg)
আমি স্মরণ করছি ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের এক বিকালের কথা। পর্তুগালের প্রাচীন এভোরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একটি বক্তৃতার আয়োজন করেছিল এখানকার রিসার্চ ইনস্টিটিউট। আমি কথা বলব বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে। ইনস্টিটিউটের পরিচালক ফিলিপ বারাতা সভাপতিত্ব করছেন।
প্রসঙ্গক্রমে আমি জানালাম, মধ্যযুগের ইউরোপে ৯ শতকে প্রথম গির্জাকেন্দ্রিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়েছিল। আর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল ১১ শতকের শুরু থেকে।
অন্যদিকে ইউরোপের হাজার বছর আগে আমাদের দেশে তিন ধারার প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার ঘটেছিল। আর একাধিক পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। এ কথা শুনে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠেছিলেন অধ্যাপক বারাতা। বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, এমন বিশাল তথ্য আমরা জানতে পারি না কেন? আমি বললাম, এ দায় আমাদের। আমাদের ইতিহাসচর্চা খুব গতি পায়নি।
আমরা রাজনৈতিক ইতিহাসচর্চা থেকে বের হতে পারিনি অনেক কাল। এখন চেষ্টা চলছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখার। আশা করছি, অচিরেই সেসব স্বর্ণালি দিনের কথা তোমরা জানতে পারবে। আমি সেদিন অনুভব করেছিলাম, আমার এ আলোচনার পর সেই সেমিনারে উপস্থিত পর্তুগিজ অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও গবেষক ছেলেমেয়েদের চোখে একটি উজ্জ্বল ঐতিহ্যের বাংলাদেশের ছবি ভাসছিল। আমি অনেক বেশি সম্মানিত হয়ে উঠেছিলাম।
কিন্তু এ আধুনিক সময়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাস পাঠের প্রস্তাবনায় স্বতন্ত্র আবশ্যিক বিষয় হিসাবে ইতিহাস পাঠের স্থান না দেখে বুঝতে পারলাম-না, আমরা এগুচ্ছি না; পেছাচ্ছি। আমরা বোধ হয় ভুলে যাচ্ছি, হাতে-কলমে শেখানোর বিদ্যা প্রাত্যহিক জীবনের জীবিকা অর্জনে সাহায্য করতে পারে, তবে এমন জ্ঞান জীবনকে আলোকিত করতে পারে না।
তথ্যসূত্রের অভাবে বাংলার ইতিহাসচর্চা তেমন এগোয়নি। বলা যায়, প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার কোনো সমকালীন ইতিহাস গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। ফলে আমাদের অনেক গৌরব ও অহংকারের সঙ্গে আমরা নিজেরা যুক্ত হতে পারিনি; বিশ্ববাসীর কাছেও এ গৌরবগাথা প্রচার করতে পারিনি।
সাত শতকের শেষদিক থেকেই বাংলায় পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সাত থেকে দশ শতকের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এ সূত্রে বলা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ধারা সূচিত হয়েছে এরও অনেক আগে। এভোরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা প্রসঙ্গে সে আভাসই দিয়েছিলাম।
বৌদ্ধবিহারগুলো ছিল ওই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলো ছিল প্রধানত আবাসিক শিক্ষায়তন। বিহারে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন এবং বিদ্যালয় হিসাবে বিহারকে ব্যবহার করা হতো। সাত শতকের আগে থেকেই বাংলাদেশে যে বিহার স্থাপিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। চৈনিক বিবরণে এসব বিহারের বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়। কালের আঘাত সহ্য করতে না পেরে এসব স্থাপত্য এখন আর টিকে নেই।
পাহাড়পুরের বিখ্যাত সোমপুর মহাবিহার নির্মিত হওয়ার অনেক আগে এ অঞ্চলে একটি জৈনবিহার ছিল বলে সমকালীন সূত্রে জানা যায়। আট শতকে বিখ্যাত পাল রাজা ধর্মপাল একই স্থানে সোমপুর মহাবিহারটি নির্মাণ করেন। সাধারণ্যে এটি পাহাড়পুর বিহার নামে পরিচিত। শিক্ষার্থীদের আবাসনসহ ভারত উপমহাদেশে আবিষ্কৃত বিহার স্থাপত্যের মধ্যে পাহাড়পুর বিহার ছিল অন্যতম বৃহৎ স্থাপনা।
পাহাড়পুর বিহার ছাড়াও কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভেতর বেশ কয়েকটি বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, ইটাখোলামুড়া বিহার, ভোজ বিহার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উত্তর বাংলায় হলুদ বিহার, সীতাকোট বিহার ইত্যাদি নিদর্শনের চিহ্নও পাওয়া গেছে।
মালদহ জেলার জগদ্দল নামক স্থানে এককালে স্থাপিত হয়েছিল জগদ্দল মহাবিহার। অক্ষত অবস্থায় পাওয়া না গেলেও এসব বিহারের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাচীনকালে বিহার স্থাপত্যের উজ্জ্বল ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। শুধু ধর্ম কথা নয়, এসব বিহারে বিজ্ঞান, ব্যাকরণ, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদিও অধ্যয়ন করা হতো। বিখ্যাত পণ্ডিত শান্তি রক্ষিত, শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর প্রমুখ শিক্ষার ধারাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়েছিলেন।
এগারো শতকের মাঝামাঝি পাল শাসনের অবসান ঘটে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের ব্রাহ্মণ সেন শাসকদের হাতে। এর আগে সেনরা পাল রাজাদের সৈন্য বাহিনীতে চাকরি করত। পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা বাংলার সিংহাসন কেড়ে নেয়। দখলদার শক্তি হিসাবে সেনরা শুরু থেকেই সন্ত্রস্ত ছিল।
নিজেদের অন্যায় ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে বিদ্রোহের আশঙ্কা করেছিল। একারণেই সেন রাজারা কড়াকড়িভাবে বর্ণপ্রথা আরোপ করেন। শূদ্র বর্ণের আড়ালে সাধারণ বাঙালিকে সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখেন। ক্রমে তাদের শিক্ষার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল। পাঠশালায় সীমিতভাবে পড়ার অধিকার থাকলেও হিন্দুদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান টোল শুধু ব্রাহ্মণদের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেল। এভাবে পাল যুগে শিক্ষার যে বিকাশমান রূপ দেখিয়েছিল ইতিহাস, সেনযুগে তার অবক্ষয় ঘটে।
তেরো শতকের শুরুতে বহিরাগত মুসলমানদের হাতে বাংলার রাজদণ্ড চলে যায়। এ সময় থেকে এ ভূখণ্ডে মধ্যযুগের যাত্রা শুরু হয়। মুসলমান শাসকদের আগমন প্রচলিত জীবন ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তনের ছোঁয়া এনেছিল। অবশ্য এগারো শতকের শুরু থেকে মুসলমান সুফি সাধকদের কর্মভূমিকা এ রূপান্তরের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
তের শতকের সূচনাকাল থেকে ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত খলজি মালিকদের তত্ত্বাবধানে বাংলার মুসলিম সমাজ-বিকাশের ভিত্তি প্রস্তুত হয়েছিল। ফলে পরবর্তী দুই শতক স্থায়ী স্বাধীন সুলতানদের শাসনকাল এদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে আনে নবজাগরণের জোয়ার। সেন শাসন যুগের অধিকার বঞ্চিত মানুষ এবার স্বাভাবিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন ফিরে পায়। মধ্যযুগের বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়টি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এ সময়ে গড়ে ওঠা শিক্ষা কাঠামোর বিশেষত্ব রয়েছে। ওই সময় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে নতুন মাত্রার সংযোগ ঘটেছিল, একে জানতে হলে শুধু সমকালীন শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ অন্বেষণ করলেই চলবে না, তার উৎস ও বিকাশের সঙ্গে যে অর্থনৈতিক অবস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তাকেও খুঁজে নিতে হবে ইতিহাসের পাতা থেকে।
অবশ্য মধ্যযুগের সমকালীন প্রাথমিক সূত্রে এ সংক্রান্ত যথেষ্ট বক্তব্য পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে সমকালীন শিলালিপি থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। যেহেতু মুসলমান সুলতান এবং তাদের অধীনস্ত কর্মকর্তারাই শিলালিপিগুলোর প্রধান উৎকীর্ণকারী, তাই এ সূত্র থেকে মুসলিম শিক্ষার ধারণা কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে।
সুলতানি যুগে বাংলার শিক্ষার স্বরূপ উদ্ঘাটনকারী কোনো ব্যাপক গবেষণার তথ্য আমাদের হাতে নেই। এ দেশীয় শিক্ষা কাঠামোর ওপর ১৮৮৩ সালে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পর সর্বপ্রথম একটি সাধারণ চিত্র আমরা দেখতে পাই। এতে দেখা যায়, বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানের দুটি স্বতন্ত্র ধারার শিক্ষাব্যবস্থা ছিল।
হিন্দুর উচ্চশিক্ষালয় টোলে ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। তবে তাদের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাঠশালায় বর্ণ নির্বিশেষে সবাই পড়তে পারত। ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে দুটি ধারায় এ দেশের শিক্ষা কাঠামো লক্ষ করা যায়। প্রথমটি টোল আর মাদ্রাসায় সংস্কৃত ও আরবি-ফার্সি শিক্ষার ধারা। ধনী অভিজাত শ্রেণির সদস্যরা এ ধারার শিক্ষাগ্রহণের অধিকারী ছিল। দ্বিতীয়টি পাঠশালা ও মক্তবে সাধারণ শিক্ষার ধারা। এ দুই ধারার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক তেমন ছিল না। ধারা দুটি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ।
সেন শাসন যুগে সাধারণ হিন্দুর জন্য শিক্ষার দরজা ছিল রুদ্ধ। এবার সুলতানি যুগে তা অবারিত হয়ে যায়। ফলে নিুশ্রেণির হিন্দুরাও শিক্ষার সমান সুযোগ লাভ করে। এ জন্যই শিক্ষার আলো বঞ্চিত নিচু শ্রেণির হিন্দু সমাজ থেকে প্রতিশ্রুতিশীল লেখকের আবির্ভাব সম্ভব হয়। এর সুস্পষ্ট প্রমাণও রয়েছে সমকালীন সাহিত্যে। ধারণা করা যায়, রাজ আনুকূল্যের কারণে হিন্দু সমাজ তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটিয়ে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার মতো সামর্থ্য অর্জন করতে পেরেছিলেন।
বাংলার মুসলমানদের শিক্ষার ধারা ভারতবর্ষের সমকালীন ধারারই অনুষঙ্গী ছিল। এগুলোর ব্যয় নির্বাহে রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা লক্ষ করা যায়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন বাড়িতেই গড়ে উঠেছিল প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্রগুলো।
সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদির মধ্য দিয়ে মুসলমান সংস্কৃতির ক্রমোন্নয়ন স্পষ্ট ছিল। মুসলিম শক্তি কর্তৃক এদেশ অধিকৃত হওয়ার পর বহিরাগত মুসলমান পণ্ডিতরা তাদের কর্মভূমিকার মাধ্যমে এদেশে উচ্চতর শিক্ষার পথকে বিকশিত করেছিলেন। এ ধারাই পরবর্তী সময়ে গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়।
শুধু বাঙালির শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাস নয়; হাজার বছরের সমাজ-সংস্কৃতি বিকাশের ধারাক্রমও খুঁজে পাওয়া যাবে ইতিহাসের পাতায়। একজন শিশু শিক্ষার্থীর বেড়ে ওঠার সময় প্রতিদিনের জীবন চলায় নানা জাগতিক প্রশিক্ষণ তাকে ও সমাজকে উপকৃত করবে ঠিকই; কিন্তু দেশকে চেনা, ঐতিহ্য জানার মধ্য দিয়ে নিজেকে, পারিপার্শ্বকে এবং দেশকে আলোকিত করার জ্ঞানচর্চা ইতিহাস পাঠ ছাড়া সম্ভব নয়।
অথচ ২৫ সেপ্টেম্বর যুগান্তরের পাতায় প্রকাশিত সরকারি নীতিনির্ধারকদের ভাষ্য পড়ে বিস্মিত হতে হলো। তারা ইতিহাস বিষয়কে আলাদা থিম হিসাবে পাঠ্য করার প্রয়োজন বোধ করেন না। সমাজবিজ্ঞান বইতে অন্যতম সমন্বিত বিষয় হিসাবে থাকলেই নাকি যথেষ্ট।
আজ সময় এসেছে গতানুগতিক ক্লান্তিকর ইতিহাস পাঠ নয়; স্কুল শিক্ষার্থীর সামনে পূর্বপুরুষের কৃতিত্বগাথা, আনন্দময় করে উপস্থাপন করার। এ দায়িত্ব নিতে হবে দক্ষ ইতিহাস লেখকদের। স্কুল শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষিত হতে হবে ইতিহাস পাঠদানকে আনন্দময় করে তোলার জন্য। কিন্তু যে দেশে স্কুল শিক্ষার্থীদের কারিকুলামে নিজ দেশের ইতিহাস পাঠকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, সেদেশে এতসব স্বপ্ন দেখে কী লাভ!
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com