যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, অবশেষে তা-ই হলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্কুল বেশিদিন একটানা বন্ধ থাকলে বাল্যবিয়ে বেড়ে যেতে পারে- এ আশঙ্কা বিভিন্ন অভিজ্ঞ মহল আগেই করেছিল। করোনা মহামারির কারণে দেশের সব স্কুল একটানা দেড় বছর বন্ধ থাকার পর ১২ সেপ্টেম্বর খুলেছে, ক্লাসও শুরু হয়েছে। প্রথম দিন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতি কম। গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে ছাত্রী উপস্থিতি আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। কারণ একটাই- বাল্যবিয়ে। স্কুলে অনুপস্থিত ছাত্রীদের বিয়ে দেওয়া হয়েছে করোনাকালের দীর্ঘ ছুটির সময়ে।
জাতীয় সংবাদপত্রগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই গত দেড় বছরে দেশের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রীদের বিয়ে, অর্থাৎ বাল্যবিয়ের খবর ছাপা হচ্ছে। এসব খবর এতদিন পাওয়া যায়নি, কারণ স্কুল বন্ধ ছিল। স্কুল খোলা থাকাকালে কোনো ছাত্রী যদি বেশ কয়েকদিন অনুপস্থিত থাকে, তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষ খবর নেয়। যদি কর্তৃপক্ষ জানতে পারে মেয়েটির বিয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে বা হয়ে গেছে, তাহলে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। কারণ দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক, তার বিয়ে হতে পারে না। এ বিয়ে বাল্যবিয়ে, যা আইনত অবৈধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ।
এখন পর্যন্ত বাল্যবিয়ের যে খবর এসেছে এবং আসছে, তাতে বিনা দ্বিধায় বলা যায়, এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। করোনাকালে শুধু রাজশাহী জেলাতেই পাঁচ শতাধিক স্কুলছাত্রীর বিয়ে হয়েছে, যাদের সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। সাতক্ষীরার একটি বালিকা বিদ্যালয়ের অন্তত ৫০ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। তারা আর ক্লাসে ফিরে আসেনি। কুড়িগ্রামের একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে নয়জন ছাত্রী ছিল। দেড় বছর পর স্কুল খুললে দেখা যায় মাত্র একজন ক্লাসে ফিরে এসেছে, বাকিদের বিয়ে হয়ে গেছে। স্কুলটিতে ২২৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৩ জন ছাত্রী ছিল। তাদের বেশিরভাগেরই বিয়ে হয়েছে।
একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) জরিপে বলা হয়েছে, করোনাকালে বাল্যবিয়ে আগের তুলনায় বেড়েছে ৫০ শতাংশ। দেশের ৮৪টি উপজেলায় চালানো জরিপের ভিত্তিতে এ তথ্য দেওয়া হয়। গত বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর- সাত মাসের জরিপ চিত্রে দেখা যায় ৮৪ উপজেলায় প্রায় ১৪ হাজার বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে।
করোনাকালের দীর্ঘ ছুটি শেষে স্কুলছাত্রীদের বাল্যবিয়ের যে খবর সংবাদপত্রে আসছে, তা প্রকৃত পরিস্থিতির একটি অংশ মাত্র। আরও খবর আসবে, অনেক এলাকার অনেক খবর হয়তো আসবেই না, গোপন রাখা হবে। প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলের খবর তো কমই আসে। সারা দেশের অর্থাৎ ৬৪ জেলায় দেড় বছরের বাল্যবিয়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র স্বাভাবিকভাবেই প্রকট অথবা ভয়াবহ হবে।
বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে একটি পুরোনো সামাজিক ব্যাধি ও জাতীয় সমস্যা। প্রাচীনকাল থেকে বাল্যবিয়েকে স্বাভাবিক বিষয় হিসাবে সমাজ গণ্য করছে। বাল্যবিয়ের কুফল, বিশেষ করে শিশুকন্যা বা কিশোরীর প্রজননস্বাস্থ্যের কথা অভিভাবক বা সমাজ বিবেচনা করেনি। পিছিয়ে থাকা সমাজের অধিকাংশ মানুষ ছিল অজ্ঞ, অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত এবং অসচেতন। কোনো মেয়ের বয়স ১২-১৩ বছর হলেই সমাজের চাপে অভিভাবক সেই মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হতেন।
বাল্যবিয়ের কারণে আগে প্রসবকালে মায়ের মৃত্যু এবং শিশু মৃত্যুর হার ছিল ব্যাপক। তখন দেশে চিকিৎসাব্যবস্থাও উন্নত ও পর্যাপ্ত ছিল না। তাছাড়া বাল্যবিয়ের কারণে শিশুকন্যা ও কিশোরীরা শিক্ষার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হতো। ফলে দেশ ও জাতির অগ্রগতির ধারা থেকে অনেক দূরে থাকতেন নারীরা। সময়ের সঙ্গে মানুষের চিন্তাধারার পরিবর্তন এসেছে, সচেতনতা বেড়েছে। শিক্ষার সুযোগ ও সুবিধা বেড়ে যাওয়ায় নারী শিক্ষার হারও বেড়ে চলেছে। তবে সচেতনতা যেটুকু বেড়েছে, তা শহরাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। গ্রামাঞ্চলের মানুষ মেয়েকে লেখাপড়া শিখতে স্কুলে পাঠায় ঠিকই, কিন্তু সুযোগ পেলেই অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনো মেয়েকে পরিবারে অতিরিক্ত বোঝা মনে করা হয়, তাই তাকে পাত্রস্থ করে বিদায় করার প্রবণতা।
বাল্যবিয়ে বন্ধ করার লক্ষ্যে সরকার ২০১৭ সালে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ করেছে। ২০১৮ সালে এ আইনকে কার্যকর করার জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এ আইনে বিয়ের জন্য পাত্রীর নিুতম বয়স ১৮ বছর ও পাত্রের ২১ বছর নির্ধারণ করা হয়। আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নির্ধারিত এ বয়সের কম বয়সিদের বিয়ে ‘বাল্যবিবাহ’ হিসাবে গণ্য হবে এবং তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনে নির্দেশনা রয়েছে, বাল্যবিয়ে বন্ধ ও নিরুৎসাহিত করার জন্য জাতীয় থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। নির্দেশনা অনুযায়ী সর্বত্র কমিটি গঠন করা হয় এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় কমিটিগুলো অনেক এলাকায় বেশকিছু বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। এ কার্যক্রম বাল্যবিয়ে নিরুৎসাহিত করতে অবদান রাখে এবং অনেক অভিভাবক অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যাকে বিয়ে না দিয়ে স্কুলে পাঠান।
আইন ও বিধিমালা প্রণীত হওয়ার পর গত বছর মার্চে করোনা সংক্রমণ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ কমিটিগুলো কমবেশি সক্রিয় ছিল এবং বাল্যবিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে ছিল। বাল্যবিয়ে হলেও তা গোপনে হতো। মেয়েকে অন্য গ্রামে নিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করা হতো।
স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা আসত না, মেয়েদের বিয়ের খবরও স্কুল কর্তৃপক্ষ পেত না। তদুপরি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটিগুলো সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে। এ পরিস্থিতিতে বহু অভিভাবক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। ফলে করোনাকালে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। প্রতিরোধ কমিটিগুলোর সক্ষমতা, জনবল ও দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সব পর্যায়ের কমিটিগুলোকে আরও দক্ষ ও সক্রিয় করতে হবে এবং তাদের কাজের পরিধিও বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের সার্বক্ষণিক নজরদারি বেশি জরুরি।
কিশোরীদের উত্ত্যক্ত করাকেও বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। বখাটেরা সুযোগ পেলেই কিশোরীদের উত্ত্যক্ত করে, ফলে অভিভাবকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ সৃষ্টি হয়। মা-বাবার মধ্যে আতঙ্ক থাকে মেয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় কিনা। এ জন্য তারা মনে করেন, মেয়েকে বিয়ে দিলেই এ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। বখাটেদের উপদ্রব বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের ভূমিকাই প্রধান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে বখাটেদের দমন করা সম্ভব। তাহলে কিশোরীদের নিরাপত্তা নিয়ে অভিভাবকদের চিন্তিত হতে হয় না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বখাটে ছেলেদের দমন করতে পারেন।
দারিদ্র্য দেশে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। করোনা মহামারি দরিদ্রের সংখ্যা আরও বাড়িয়েছে। অভাবের কারণে দরিদ্র পরিবারের অভিভাবক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসারের খরচ কমাতে চান। বিয়ের পর মেয়েটির স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা, প্রতি মাসে উপবৃত্তি প্রদান নিশ্চিত করা এবং দুপুরের খাবার নিয়মিত দেওয়া হলে দরিদ্র অভিভাবকরা মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হবেন। তারা তখন আর মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবেন না। এতে বাল্যবিয়ে কমবে, নারী শিক্ষার হারও বাড়বে।
বাল্যবিয়ে স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ করতে প্রথমেই প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। বাল্যবিয়ের কুফল সব অভিভাবককে বুঝতে হবে, অথবা তাদের বোঝাতে হবে। ছেলেমেয়েদেরও বোঝাতে হবে যে, অল্প বয়সে বিয়ে করা ভালো নয়। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সর্বত্র প্রচার-প্রপাগান্ডা চালিয়ে যেতে হবে। যেসব কারণে বাল্যবিয়ে হয়, তা দূর করার জন্য অভিভাবক, সমাজ ও সরকারকে সমন্বিতভাবে কাজ করে যেতে হবে। একইসঙ্গে জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটিগুলোকে কার্যকরভাবে সক্রিয় রাখা প্রয়োজন।
বাল্যবিয়ে বন্ধ করাকে সরকার অগ্রাধিকারমূলক কর্মসূচি হিসাবে গুরুত্ব দিয়েছে। জাতীয় উন্নয়ন, নারী শিক্ষার প্রসার এবং নারীর সমতাভিত্তিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com