স্মরণীয় কীর্তির বিস্মৃত পুরুষ
ফজলুর রহমান
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বঙ্গীয় রেনেসাঁর অন্যতম স্থপতি র্যাংলার আনন্দমোহন বসু ১৯০৬ সালের ২০ আগস্ট মাত্র ৫৯ বছর বয়সে পক্ষাঘাত রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করেন।
কীর্তিমান এ মানুষটির শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও একজন প্রগতিশীল সমাজকর্মী, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষানুরাগী, বিচক্ষণ কর্মযোগী, রাজনীতিবিদ হিসাবে বঙ্গীয় রেনেসাঁর উত্তরণে তার অবিস্মরণীয় অবদান তাকে অনাদিকাল বাঁচিয়ে রাখবে।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ভারতীয় উমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তনকারী, উনিশ শতকের নারী জাগরণের অগ্রদূত, উপমহাদেশের প্রথম ‘র্যাংলার’ হিসাবে ইতিহাসে তার এক স্বতস্ত্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে।
কিশোরগঞ্জ জেলার প্রান্তসীমায় অবস্থিত হাওড় উপজেলা ইটনার জয়সিদ্ধি গ্রামে ১৮৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বাবা পদ্মলোচন বসু ও মা উমা কিশোরী দেবীর ঘর আলো করে জন্ম গ্রহণ করেন আন্দমোহন বসু। পদ্মলোচন বসু শিক্ষাজীবন শেষে ময়মনসিংহ সিটি কালেক্টরেটে চাকরি নেন।
বর্তমান ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুলটি ছিল আনন্দমোহন বসুর ময়মনসিংহের পৈতৃক নিবাস। দারুণ মেধাবী আনন্দমোহন বসু ১৮৬২ সালে হার্ডিঞ্জ স্কুল (বর্তমান ময়মনসিংহ জিলা স্কুল) থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় নবম স্থান অধিকার করেন। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ ও বিএ উভয় পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে উত্তীর্ণ হন।
এ অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তিনি ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ বৃত্তি লাভ করেন। ফলে উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা বৃত্তি লাভ করেন। ইংল্যান্ডে ক্যাম্ব্রিজের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে তিনি উচ্চতর গণিত বিষয়ে লেখাপড়া করেন।
১৮৭৪ সাল। ইংরেজরা ‘রাজার জাত’ আর ভারতীয়রা ‘স্লেভ্স’ অর্থাৎ দাস-এমন একটি ধারণা ছিল অনেকের মনে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে খবরটা আসে খোদ ইংল্যান্ড থেকেই। ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিষয়ক সর্বোচ্চ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তিনটি বিষয়ে প্রথম শ্রেণি অর্থাৎ সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ‘র্যাংলার’ উপাধি পেয়েছেন একজন ভারতীয়, নাম তার আনন্দমোহন বসু।
ওই বছরই তিনি বার-এট-ল ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে আসেন এবং আইন ব্যবসা শুরু করেন। এর আগে ছাত্রাবস্থায় তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভগবান চন্দ্র বসুর কন্যা অর্থাৎ বিজ্ঞানাচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সহোদরা স্বর্ণপ্রভা দেবীকে বিয়ে করেন।
রাজনীতিতে তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা ও অগ্রদূত। ছাত্রদের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি জাগানোর উদ্দেশ্যে ১৮৭৫ সালে গঠন করেন ‘স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’। ১৮৭৬ সালে তিনি গঠন করেন ভারতবর্ষের জাতীয় কংগ্রেসের পূর্বসূরি সংগঠন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। ১৮৭৮ সালের ১৫ মে তিনি ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সা
ধারণ ব্রাহ্ম সমাজের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এর আগে আনন্দমোহন বসু সস্ত্রীক ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেনের কাছে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেন। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির সঙ্গে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি দু’দু-বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের নিজস্ব ভবন নির্মাণ এবং সমাজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সিটি কলেজ ও সিটি স্কুল স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। এ দেশে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি ময়মনসিংহের পৈতৃক বাড়িটি দান করে ১৮৮৩ সালে সিটি কলেজিয়েট স্কুলের কার্যক্রম শুরু করেন। তখন এটির নাম ছিল ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালে এ বিদ্যালয়ে শহরের সর্বাধিক ৬০৯ জন ছাত্র ছিল।
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, সিনেট সদস্য এবং শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। ময়মনসিংহে কোনো কলেজ না থাকায় ১৮৯৯ সালে ‘ময়মনসিংহ সভা’ ও আঞ্জুমানিয়া ইসলামিয়া’ আনন্দমোহন বসুর কাছে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। ১৯০১ সালে তিনি সিটি স্কুলকে দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজে উন্নীত করেন এবং ১৯০৮ সালে এর নামকরণ করা হয় আনন্দমোহন কলেজ।
পশ্চাৎপদ নারীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে কয়েকজন শিক্ষানুরাগীর সহযোগিতায় ১৮৭৬ সালে স্থাপন করেন বঙ্গমহিলা মহাবিদ্যালয়, যা পরে বেথুন স্কুলের সঙ্গে একীভূত হয়। আনন্দমোহন বসু ও দুর্গামোহন দাসের ঐকান্তিক চেষ্টায় বেথুন স্কুলের সর্বোচ্চ শ্রেণির দুই ছাত্রী কাদম্বিনী বসু ও সরলা দাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ টেস্ট পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার উপযুক্ত বিবেচিত হন। এর ফলে ১৮৭৮ সালে কাদম্বিনী বসু প্রথম এন্ট্রান্স পাস মহিলা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয়।
কেবল তাই নয়, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী, দুর্গামোহন দাস, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখের আন্দোলনে ১৮৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নারীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাভের দাবি মেনে নেয় এবং ১৮৮২ সালে কাদম্বিনী বসু ও চন্দ্রমুখী বসু প্রথম মহিলা স্নাতক হওয়ার সম্মান অর্জন করেন। এ ছাড়া আনন্দমোহন বসু বেঙ্গল প্রভিনসিয়াল কমিটির মাধ্যমে ১৮৮১-৮২ সালে ছাত্রীদের জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করেন।
আনন্দমোহন বসুর স্মৃতিবিজড়িত তার জন্ম স্থান জয়সিদ্ধিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর স্থাপত্য-কীর্তির অনন্য নিদর্শন, তার পূর্বসূরিদের বসতবাড়ি। স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলে থাকা বিশাল আয়তনের এ বাড়িটিতে আনন্দমোহন বসুর আঁতুড়ঘরটিকে বানানো হয়েছে গোবরের গর্ত। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ‘র্যাংলার’ আনন্দমোহন বসুর জন্ম ভিটার এখন বেহালদশা। বাঙালি রেনেসাঁর অন্যতম স্থপতি বিখ্যাত এ সমাজ সংস্কারকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি বেদখল হয়ে আছে। ফলে অরক্ষিত জš§ভিটায় অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে সপ্তদশ শতাব্দীর স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন বসতবাড়িটি।
কয়েক একর আয়তনের বাড়িটিতে রয়েছে কয়েকটি বিশাল ভবন, খোলা মাঠ ও একাধিক পুকুর। বিশাল বসতবাড়িটি পরিণত হয়েছে পরগাছা উদ্ভিদের বাসস্থানে। চারদিকে নির্মিত প্রতিরক্ষা দেওয়ালের অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। দেওয়ালের অনেক জায়গার ইট-পাথর দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে। আনন্দমোহন বসুর আঁতুড়ঘরটিকে বানানো হয়েছে গোবরের গর্ত। এ অবস্থায় ঐতিহ্যের নিদর্শন এসব স্থাপনা বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তনকারী আনন্দমোহন বসুর জন্ম স্থান ও বসতবাড়ি দেখার জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রায়ই দর্শণার্থীরা আসেন। কিন্তু বসতবাড়িটি বেদখল হয়ে থাকায় বাড়িটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকারও সংরক্ষিত পর্যায়ে চলে গেছে। এরপরও বসতবাড়িটি উদ্ধার কিংবা সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ বা আগ্রহ নেই প্রশাসন কিংবা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঐতিহাসিক এ স্থানটিকে সংরক্ষণ করে তার প–ণ্য স্মৃতি ও স্থাপত্যকীর্তির প্রতি সম্মান জানাবে, এ প্রত্যাশা এলাকাবাসীসহ বসুর ঐতিহ্য বাহকদের।
ফজলুর রহমান : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ