আফগানিস্তান : সামনে কী?
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
মেজর (অব.) সুধীর সাহা
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![আফগানিস্তান : সামনে কী?](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2021/09/18/image-466271-1631908564.jpg)
মার্কিন সেনা আফগান ভূখণ্ড ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তালেবানের দ্বিমুখী চেহারা প্রকট হচ্ছে। একদিকে তারা ঘোষণা করছে- ভয়ের কোনো কারণ নেই, নারী-সংখ্যালঘুসহ দেশের সব মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া হবে; অন্যদিকে অতি উৎসাহী তালেবানরা প্রকাশ্যে রাস্তায় তাণ্ডব চালাচ্ছে। তারা আসলে বদলাতে পারেনি, হয়তো চাইলেও বদলাতে পারবে না। যারা তাদের স্বাভাবিক মিত্র, তারাই তাদের বদলে বাদ সাধবে। নব্বইয়ের দশকে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন তালেবানের প্রথম সরকারের চালিকাশক্তি ছিল আল-কায়েদা। দ্বিতীয় শক্তি ছিল পাকিস্তানের আইএসআই।
তৃতীয় শক্তি ছিল মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন উগ্রপন্থি সংগঠন, যারা ধর্মের নামে অধর্মের রাজত্ব কায়েম করতেই বেশি আগ্রহী। তালেবানের সঙ্গে আল-কায়েদা, আইএস, হিজব-এ মুজাহিদিন, লস্কর-ই-তৈয়বা, ভারতের মুজাহিদিন, মিসরের ইখয়ানুন মুসলিমিন কিংবা ভারতের শিবসেনার লক্ষ্যের তেমন কোনো দূরত্ব নেই। সবাই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ধর্মশাসিত শাসনতন্ত্রের মোহ প্রথম ছড়িয়ে পড়েছিল আবু বক্কর বাগদাদির হাত ধরে।
প্রথমে ইরাক, তারপর সিরিয়া, অতঃপর ছড়িয়ে পড়ে লেবানন, আলজেরিয়া, পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে। আল-কায়েদা খুরামান নিছক কোনো আঞ্চলিক শক্তি নয়, আফগানিস্তানের সব প্রদেশেই লাদেনের ছত্রভঙ্গ সেনারা গোপনে জড়ো হতে থাকে এবং পুরো আফগানিস্তানে ধীরে ধীরে বাহু বিস্তার করতে থাকে। সামনে তালেবান আর পেছনে বহুজাতিক ভয়ানক জঙ্গিরা আফগানিস্তানে দুঃস্বপ্নের সংকেত বয়ে আনছে।
বহু জাতি-উপজাতির নেতত্বে গড়ে ওঠা তালেবানের আদর্শগত ঐক্যের সংকট রয়েছে। রাস্তার সংগ্রাম আর রাষ্ট্র পরিচালনা এক নয়। এরই মধ্যে আফগানিস্তানের তালেবান তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। একদল চায় ধর্মের নামে অনুশাসিত শাসনতন্ত্রের দ্রুত বাস্তবায়ন, অন্য দলের কাম্য ধীরগতিতে রাষ্ট্রশাসনের পরিবর্তন। আমেরিকা আর পশ্চিমা দুনিয়ার ঔপনিবেশিকতাবাদ তাদের নিজেদের দেশে মুক্তচিন্তা আর গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা চাইলেও ইসলামি বিশ্বে অন্ধত্বকে তারা উসকানি দেয়। এতে তাদের বাজারের শক্তি বাড়ে। সিরিয়া, ইরাক, ইরান ও পাকিস্তান নিয়ে রাশিয়া, আমেরিকা ও চীনের পাল্টাপাল্টি অবস্থান আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি। সন্দেহ নেই, আফগানিস্তানে উপদ্রবের চাষাবাদ আরও বেশি দেখব। রক্তখেলার বৃত্ত ইতোমধ্যেই বেড়ে চলেছে।
গান, ছবি আঁকা, অভিনয় সব নিষিদ্ধ হওয়ার পথে। নারীদের দিনযাপনে নানা নিষেধাজ্ঞা ক্রমেই বাড়ছে। কৌতুক শিল্পী নাজার মহম্মদের পর খুন করা হলো লোকসংগীত শিল্পী ফাওয়াদ আন্দারাবিকে। ২৪ বছরের যুবতী সংগীতশিল্পী নেগিন খাপালওয়াক কনসার্টে বসলে দর্শকদের রাত কাবার করে দিতেন। নানা অলংকারে সাজানো থাকত তার ড্রামসেট, মাইক্রোফোন, গিটার, আরও কত কী! সবকিছু একত্রে সাজিয়ে একটি দেশলাই কাঠির আগুনে সব শেষ করে দিয়ে তিনি দেশ ছাড়লেন। এসব বেদনাময় ঘটনার পরও ঘোষিত মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী হলেন মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মুহম্মদ হাসান আখুন্দ। এমন সুবর্ণ সময়ে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই কাবুলে পৌঁছে গেলেন পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই প্রধান লে. জে. ফৈজ হামিদ। তার আশ্বাসবাণী- ‘ভয়ের কিছু নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আফগানিস্তান এক রহস্যময় দেশ। এ দেশের মাটি থেকে বহু সুফির জন্ম হয়েছে। মৌলানা জালাল উদ্দিন রুমি বালখী, হাকিম সানাই, হাকিম জামি, শেখ মুহম্মদ রোহানির মতো সুফি আর মানবতাবাদী দর্শনের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির জন্মস্থান এ আফগানিস্তান। আবার এ আফগানিস্তানেই বামিয়ান বুদ্ধের মূর্তি ধ্বংস করে দিয়েছে তালেবান। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, রবীন্দ্রনাথের গল্পের সেই কাবুলিওয়ালা আর তার ছোট্ট খুকি মিনির কথা!
সেই সুদূর কাবুলে কাবুলিওয়ালার এক মেয়ে থাকে, যার কথা মনে পড়লে তার মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু সেই মিনিরা আজ কাবুলে কেমন আছে? গণতন্ত্র কিংবা সৌন্দর্যের ভাষা কি বোঝে তালেবান? তাদের হাতে তো মারণাস্ত্র! হাজার হাজার মিনি আজ আফগানিস্তান ছেড়ে পালাচ্ছে। আফগানিস্তানের জনপ্রিয় সাংবাদিক শবনম দওয়ান আক্ষেপ করে বলেছেন-‘আমাদের সামনে ভয়ংকর বিপদ; আমাদের জীবন বিপন্ন।’
গত ২০ বছরে আমেরিকা আফগানিস্তানে অবস্থিত তার ৩ লাখ সেনা ও পুলিশ কর্মীর ট্রেনিং ও অস্ত্র জোগাতে খরচ করেছে ৮৪০ কোটি ডলার। সব দিয়ে গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে তাদের মোট খরচ হয়েছে ২ লাখ কোটি ডলারের বেশি। তালেবানের মোট সৈন্য সংখ্যা আনুমানিক ৭৫ হাজার। তাও আবার নিয়মিত সেনাবাহিনীর সদস্য নয় তারা। অন্যদিকে, মার্কিন সহায়তাপুষ্ট আফগান সরকারের সেনা ও পুলিশের সংখ্যা ছিল ৩ লাখের বেশি। তবুও কাবুলে উড়ল তালেবানের পতাকা। কারণ ততদিনে আফগান সরকারের সেনারা বুঝে গিয়েছিল আমেরিকার মনোভাব।
তাই দলে দলে তারা হয় তালেবানের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, নয়তো অস্ত্র ছেড়ে পালিয়েছে। এখন দেখার পালা তালেবানের নতুন দিনের শাসন কি আগের মতোই কট্টর-মৌলবাদী আফগানিস্তান গড়বে? প্রশ্রয় দেবে কি মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ? চাঙ্গা করবে কি আল-কায়েদাকে? উদ্বিগ্ন সারা বিশ্ব। এসব প্রশ্ন আফগানিস্তানকে ঘিরে বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ একটা বাঁকের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানে পালিত হয়েছে ‘তালেবান বিজয়োৎসব’। পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, ‘দুদশক পরে আফগানরা দেশকে বিদেশিমুক্ত করল।’ বেইজিং সঙ্গে সঙ্গে দোতারায় সুর তুলল- ‘তালেবানের পেছনে জনসমর্থন আছে, এটাই প্রমাণিত হলো।’
গত দুদশকে আফগানিস্তানের লাভের মধ্যে বিশেষ কিছু ছিল না। তবে মিলেছিল মুক্ত বাতাস। নারী সমাজকে শৃঙ্খলামুক্ত করে স্বাধীন করার কাজটি করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বহু আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং আধুনিক জীবনের উপযুক্ত দ্রব্যসামগ্রী, শপিংমল, সিনেমা হল ইত্যাদি। মেয়েরাও উপযুক্ত পোশাকে ফুটবল, ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলায় মেতে উঠেছিল। নবীন হলেও ক্রিকেটে আফগানিস্তান এখন একটি বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে। আফগানিস্তানের বর্তমান সংবিধান ২০০৪ সালে বিদেশি শক্তির তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছিল। আফগান সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে প্রত্যেকের সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৬ অনুযায়ী, অপরাধমূলক কার্যকলাপে শাস্তি দিতে পারে শুধু আদালত।
সংবিধান নিশ্চিত করেছে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের নিশ্চয়তা। অনুচ্ছেদ ৩৪-এ বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক আফগানের শিক্ষার অধিকার রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা প্রত্যেকের জন্য বাধ্যতামূলক।’ এখন প্রশ্ন উঠেছে, আফগানিস্তান কি এ সংবিধান পরিবর্তন করে ১৯৬৪ সালের সংবিধানে ফিরে যাবে? ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত শাসনকালে শরিয়ত কার্যকর করেছিল তালেবান। নারীদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং বালিকাদের স্কুলে পড়া নিষিদ্ধ ঘোষণাসহ নারীদের বাইরে বেরোনোর পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তালেবানের মাঝে নারীরা ঠিক ভরসার জায়গাটি খুঁজে পাচ্ছে না এবারও।
সম্প্রতি পড়াশোনার অধিকারের দাবিতে হেরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন, যেখানে ৫০ জন নারী যোগ দিয়েছিলেন। দাবি তোলা হয়, ‘বোরকা পরতে রাজি আছি। কিন্তু চাকরি করতে দিন। আমাদের মেয়েদের স্কুলে যেতে দিন।’ শুধু হেরাটেই নয়, কাবুলের রাস্তায়ও নেমেছেন নারীরা। মিছিলে পুরুষরা থাকলেও বোরকা পরিহিত নারীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড, আফগানিস্তানের পতাকা। মুখে ছিল পাকিস্তান আর আইএসআইর বিরুদ্ধে স্লোগান।
একসময় অনেক নারী বিচারকের রায়ে তালেবানদের কারাদণ্ড হয়েছিল। তালেবানরা ক্ষমতায় এসে জেল থেকে তাদের বের করে এনেছে। এ অবস্থায় তালেবান-অধিকৃত আফগানিস্তানে প্রাণভয়ে দিন কাটাচ্ছেন অন্তত ২৫০ জন নারী বিচারক। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন নারী বিচারক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। শুধু নারী বিচারকই নন, বর্তমান আফগানিস্তানে নারী আইনজীবী, নারী পুলিশ সবাই প্রাণভয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
জেল থেকে বাইরে আসা বন্দিরা সরাসরি হুমকি দিয়েছে- ‘আমাদের নজর এড়িয়ে কেউ পালাতে পারবে না।’ ইতোমধ্যে তালেবানের হাত থেকে বাঁচতে বিয়েকে অস্ত্র করে পালানোর চেষ্টা করেছেন বহু আফগান নারী। এমনকি যেসব পরিবারের আর্থিক জোর রয়েছে, তারা হাজার হাজার ডলার দিয়ে বিদেশি নাগরিকত্ব থাকা পাত্র কিনছেন। তাদের একটাই উদ্দেশ্য- তালেবানের হাত থেকে রক্ষা পেতে দেশত্যাগ।
২০০১ সালে তালেবান জমানা শেষ হতেই বেসরকারি উদ্যোগে আফগানিস্তানে বহু টেলিভিশন চ্যানেলের পাশাপাশি ১৬০টিরও বেশি রেডিও স্টেশন তৈরি হয়েছিল। এ সংস্থাগুলোর হাত ধরে আফগানিস্তানের সংস্কৃতিরও বদল ঘটেছিল। আমেরিকান আইডলের ধাঁচে গানের প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন সোপ অপেরা, এমনকি দেশে নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটেরও আয়োজন করা হতো। বহু নারী শামিল হয়েছিলেন এ কর্মযজ্ঞে।
কিন্তু তালেবানের প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসেছে দমবন্ধ পরিবেশ ও আতঙ্ক। আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় টিভি নেটওয়ার্ক ‘টোলো নিউজ’র সিইও সাদ মহসেনি বলেছেন, ‘কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছি। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, একটা প্রজন্ম, যারা সাংবাদিক হয়ে ওঠার জন্য তিলে তিলে নিজেদের গড়ে তুলেছিলেন, তারা হয় দেশ নয়তো পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। আগামী দুদশকেও এ শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব নয়।’
মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক