শিক্ষার্থীদের করোনা সুরক্ষায় কিছু পরামর্শ
ডা. মনজুর হোসেন
প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
১৮ মাস বন্ধের পর দেশে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হয়েছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ১৮ মাসে তেমন কিছু শিখতে পারেনি। ২০২০ সালে যারা ভর্তি হয়েছিল, তারা শিক্ষা ও স্কুলের ব্যাপারটি বোঝার আগেই স্কুল বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর গ্রামের শিক্ষার্থীদের বড় অংশের পক্ষে টেলিভিশন বা অনলাইনে শিক্ষাগ্রহণ সম্ভব হয়নি। আবার ডিভাইসের অভাবও ছিল অনেকের ক্ষেত্রে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে শিক্ষার পাশাপাশি স্কুলে আসা-যাওয়া, শিক্ষকের সঙ্গে সহজ হওয়া বা অন্যান্য নিয়ম-কানুনের সঙ্গে পরিচয় ঠিকমতো হওয়ার সুযোগ হয়নি।
যা হোক, অবশেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট (পিইসি), সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) এবং উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হবে, বাকি শিক্ষার্থীরা আপাতত সপ্তাহে একবার শারীরিকভাবে ক্লাসে উপস্থিত হবে। ইউনিসেফ বাংলাদেশ সরকারের স্কুল আবারও খোলার সিদ্ধান্তকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে।
শিশুদের ওপর দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধের প্রভাব
কোভিড-১৯ মহামারি লাখ লাখ শিশু-কিশোরের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং বিকাশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। দীর্ঘ ১৮ মাস স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিশুদের শিক্ষা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইসঙ্গে শিশুরা দীর্ঘ সময় ধরে ঘরবন্দি থাকায় অনেকেই শারীরিক, মানসিক ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামাজিক সমস্যায়ও ভুগেছে; অর্থাৎ শিক্ষার ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক যন্ত্রণা ও বিড়ম্বনা, সাংসারিক সহিংসতা এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে তাদের।
এ ছাড়া অপুষ্টি ইতোমধ্যেই শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে স্কুল বন্ধ থাকায় নিুআয়ের পরিবারের শিশু-কিশোরদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা হয়তো কখনোই পূরণ করা যাবে না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিুআয়ের পরিবারের শিশুরা, যাদের দূরবর্তী শিক্ষা সরঞ্জামের সুযোগ নেই। তাদেরই স্কুল থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কা বেশি। স্কুল বন্ধ থাকায় শিশু-কিশোরদের যে ক্ষতি হয়েছে তা হয়তো কখনোই পূরণ করা যাবে না। এসব কারণেই স্কুল খোলার জন্য আর অপেক্ষা করা উচিত হতো না।
টিকা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক
বর্তমানে দেশে যেহেতু টিকা প্রদান অব্যাহত রয়েছে, সেহেতু তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে নাগরিকরা ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উপকৃত হবে। অন্যদিকে, দেশের বাস্তবতায় স্কুল খোলার জন্য সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর টিকা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করাও সম্ভব ছিল না। কারণ, একে তো বিশ্বব্যাপী টিকার অভাব, তার ওপর মধ্যম আয়ের দেশগুলোর টিকাপ্রাপ্তির স্বল্পতা। তাছাড়া ফ্রন্টলাইন কর্মীদের এবং দীর্ঘমেয়াদি ও গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের টিকা দেওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার থাকায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে প্রবেশের আগে টিকাদান বাধ্যতামূলক করা সম্ভবপর নয়।
দেশের প্রায় ৪ কোটি ৭২ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়া এবং স্কুলের পরিবেশ শিশুদের জন্য নিরাপদ করার পর স্কুল খোলা উচিত ছিল বলে অনেকে মনে করেন। তাদের মতে, শিশুদের উপসর্গবিহীন করোনাভাইরাসের বাহক হওয়ার আশঙ্কা যেহেতু বেশি, তাই ওই দুটি পূর্বশর্ত পূরণ না করে স্কুল আবারও চালু করা ঝুঁকিপূর্ণ। আমার মতে, এমন ধারণা সম্ভবত বাস্তবসম্মত নয়। কারণ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শিশুদের টিকা প্রদানের অনুমোদন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত করেনি। তাছাড়া শিশুদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে। গুরুতর কোভিড সংক্রমণ এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে অনেক কম।
পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ঝুঁকি হ্রাস করা যেতে পারে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যবস্থা নিয়ে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে টিকা দিয়ে ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। তাছাড়া পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য শিক্ষাপ্রদানের দায়িত্ব রয়েছে। আমরা কখনোই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অবহেলা করতে পারি না। তাই স্কুল খুলে দেওয়ার পদক্ষেপ অবশ্যই সঠিক হয়েছে।
স্কুলের মিড-ডে মিল শিশুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বাস্তবায়নে যেমন ভূমিকা যেমন পালন করবে, তেমনি পারিবারিক সচ্ছলতার ক্ষেত্রকেও শক্তিশালী করবে। তবে যখন শিশুদের জন্য টিকা দেওয়া সম্ভব হবে, তখন পুষ্টিহীন ও দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্ত শিশুদের অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ এবং রোগ প্রতিরোধ কম বা ঘাটতির (Immunodeficiency) মতো রোগে আক্রান্ত শিশুদের, পাশাপাশি গুরুতর অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
নিরাপদ স্কুল ব্যবস্থাপনা
স্কুলে নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রটোকল অনুসরণ করে শিশুদের মধ্যে কোভিডের সংক্রমণ রোধের চেষ্টা করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা যাতে নিরাপদ থাকে এবং স্কুলগুলো সংক্রমণের কেন্দ্র না হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী সংক্রমণ প্রশমন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নজরদারির (surveillance) মাধ্যমে রোগ নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য স্কুল চত্বরের ভেতরেই রোগের বিস্তার নিরূপণের জন্য পরীক্ষার কিটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্কুলে সংক্রমণের হার কম থাকবে, যদি সেখানে যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। যেমন-মাস্ক পরা, যথাযথ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, নজরদারি পরীক্ষা নিশ্চিত করা এবং উপযুক্ত নিরাপদ পরিবেশ।
সুপারিশ : ক. যদি কোনো শিক্ষার্থীর দেহে করোনার কোনো উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে তাদের স্কুলে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। খ. সংক্রমণ বাড়লে স্থানীয় প্রশাসনকে যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে।
সাবধানতা : যত জনসমাগম, তত সংক্রমণ। শিশু-কিশোরদের টিকা না দেওয়া পর্যন্ত তাই এ ব্যাপারে সচেতনতাই সম্বল। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এ বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে কিছু বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে। সেগুলো হলো-তাপমাত্রা পরীক্ষা করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রবেশের ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা; ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকসহ প্রত্যেকের মাস্ক ব্যবহার করা; সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। শিশুদের সঙ্গে আলোচনা করে শেখাতে হবে কীভাবে একজন থেকে আরেকজন দূরে দূরে দাঁড়াবে, কীভাবে ক্লাসে দূরে দূরে বসবে, টিফিন খাওয়ার সময় কীভাবে আচরণ করতে হবে।
স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ যেমন-হাঁচি-কাশি দেওয়ার নিয়ম, হাত ধোয়ার নিয়ম, বিশেষ করে সবার স্পর্শ লাগে এমন কিছু ছুঁলেই হাত ধুতে হবে। যেমন- ডেস্ক, দরজার হাতল ইত্যাদি। একজন আরেকজনকে বুকে জড়িয়ে ধরা যাবে না, করমর্দন বা হ্যান্ডশেক করা যাবে না, হাতাহাতি তো নয়ই। স্কুলব্যাগে বই-খাতা, কলম, পেনসিল, রং পেনসিল, টিফিন বক্স বা পানির বোতলের সঙ্গে টিস্যু পেপার বা পরিষ্কার রুমাল, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ছোট বোতল রাখতে হবে। শিশুর ব্যাগে পলিথিন প্যাকেটে অতিরিক্ত মাস্ক দিতে হবে। স্কুল থেকে ফেরার পর স্কুলের জামা-কাপড়, ব্যাগ, টিফিন বক্স, বোতল সবই ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। শিশুকে ভালো করে গোসল করিয়ে নিতে হবে। স্কুলে পরে যাওয়া জুতা ঘরে ঢোকানো যাবে না।
সাধারণ সুপারিশ : কোনো শিশু স্কুলে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দ্রুত আইসোলেশনে নিতে হবে। প্রতিটি স্কুলে সিক রুম বা আলাদা আইসোলেশন রুম থাকা বাঞ্ছনীয়। শিশু অসুস্থ হলে কিছুতেই স্কুলে যাওয়া যাবে না। কেউ অসুস্থবোধ করলে তাকে স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। স্থানীয় করোনা পরিসংখ্যান সতর্কভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। স্কুলগুলো খোলা রাখার সিদ্ধান্তটি প্রতি ১৫ দিন পরপর পর্যালোচনা করা উচিত। শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মী, সহায়ক কর্মী, গাড়ি চালক, পরিচালক ও দর্শনার্থীসহ স্কুলে কর্মরত এবং ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত সব প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যকে যে কোনো কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের অন্তত একটি ডোজ প্রদানের কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে।
শিক্ষার্থীদের পরিবারের পিতামাতা এবং অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য, যারা টিকা নেওয়ার যোগ্য, তাদের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের অন্তত একটি ডোজ নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুর (যারা হাঁপানি, কিডনি রোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছে, প্রতিবন্ধী শিশু, স্টেরয়েড পাওয়া শিশু) স্কুলে যোগদানের আগে তাদের শিশু বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন : শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ; সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি